বাংলার ব্রত – উচ্চমাধ্যমিক বাংলা প্রবন্ধ রচনা

প্রিয় ছাত্রছাত্রীরা, এখানে আমরা বাংলার ব্রত – উচ্চমাধ্যমিক বাংলা প্রবন্ধ রচনা নিয়ে আলোচনা করলাম। খুব সুন্দর করে গুছিয়ে এই প্রবন্ধ রচনাটি লেখা হয়েছে। আশা করি তোমাদের সবারই ভালো লাগবে। ধন্যবাদ

বাংলার ব্রত

ব্রত বাঙালির প্রাণের সম্পদ। ব্রতপালন মূলত মেয়ে দের আচরণের বিষয়। ভারতে আর্যদের আগমনের বহু আগে থেকেই সম্ভবত এই ব্রতপালনের বিষয়টি প্রচলিত ছিল। এইসব ব্রতপালনের মূলে রয়েছে জীবনযাপনের সঙ্গে জড়িত অসংখ্য আকাঙ্ক্ষা। ব্রত আচরণে একজনের কামনা দশজনের মধ্যে প্রবাহিত হয়ে অনুষ্ঠানের চেহারা নেয়। এগুলি কিন্তু শাস্ত্রীয় অর্থে যাকে পূজা বলা হয়, তা নয়। কিছুটা ধর্মীয় আচরণ, তার সঙ্গে উৎসব, ছবি আঁকা, গান, কখনও নাটক ইত্যাদি মিলে ব্রতপালন করা হয়। কখনও পুকুরের জল না শুকানোর জন্য, কখনও বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করে এইসব ব্রত উদযাপন করা হয়। যেমন ‘ভাদুলি’ নামের একটি ব্রত পালন করা হয় যার পিছনে আছে সমুদ্রযাত্রা থেকে আত্মীয়পরিজনের নিরাপদে ফিরে আসার প্রার্থনা। তবে গ্রাম্যদেবতাদের কেন্দ্র করেও কিছু ব্রত পালন করা হয়। যেমন, অরণ্যষষ্ঠী, শীতলষষ্ঠী, ঘেঁটুষষ্ঠী ইত্যাদি।

এইসব লৌকিক ব্রতের পাশাপাশিই সমাজজীবনে প্রচলিত আছে শাস্ত্রীয় ব্রত, যেগুলির পৌরাণিক ভিত্তি রয়েছে। কিন্তু এই ধরনের ব্রত আচরণের সঙ্গে লৌকিক বা মেয়েলি ব্রতগুলির প্রধান পার্থক্য হল মেয়েলি ব্রতগুলিতে বৈচিত্র্য অনেক বেশি। সব শাস্ত্রীয় ব্রতই একই প্রক্রিয়াতে চলে। আসলে এগুলির উদ্দেশ্যই হল ধর্মকে তন্ত্র ও পুরাণের জটিলতা থেকে মুক্ত করে সাধারণের উপযোগী করে তোলা। ফলে মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে এগুলি সহজে মেলে না, সেখান থেকে এগুলির উৎপত্তিও ঘটে না। আরও উল্লেখযোগ্য যে এইসব ব্রতপালনে পুরোহিত বা ব্রা য়ণরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। তাদের দ্বারা সৃষ্ট হয়ে বা তাদের ব্যাখ্যানির্ভর হয়েও ব্রতপালন চলে। আরও একটা কৌতুকের বিষয় হল, ব্রাক্ষ্মণরা তাদের বাণিজ্যিক লাভের আশায় লৌকিক ব্রতগুলিরও দখলদারি নিতে চেয়েছেন। মেয়েদের নিজস্ব পালনীয় ব্ৰততে ব্রাক্ষ্মণদের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। ব্রাক্ষ্মণসেবা আবশ্যিক হয়ে উঠেছে। এইভাবে লৌকিক ব্রত তার নিজস্বতা হারিয়েছে।

বাংলাদেশের ব্রত উদ্যাপনে আলপনার ভূমিকা গুরুত্ব পূর্ণ। ব্রতের বৈচিত্র্যের মতোই আলপনারও বৈচিত্র্য আছে। কখনও তা শুধুই নানারকমের ফুল, লতাপাতা, কখনও চন্দ্র, সূর্য, তারা। লক্ষণীয়, নির্দিষ্ট ব্রতর উদ্দেশ্য নির্দিষ্ট হলেও আলপনা শুধু সেটুকুরই প্রতিনিধিত্ব করে না, শিল্পসৌন্দর্যেরও বাহক হয়। এর সঙ্গে গান আর নাটকের মেলবন্ধনে ব্রত যেন হয়ে ওঠে লোকসংস্কৃতির অসামান্য ধারক।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে লোকসংস্কৃতির এই সমৃদ্ধ ধারাও আজ নানা পরিবর্তন এবং সমস্যার সম্মুখীন। প্রথমত আধুনিক নগরজীবনের নানা প্রভাব অন্যান্য লোকসংস্কৃতির ধারার মতোই প্রভাবিত করেছে সংস্কৃতির এই ধারাটিকেও। দ্বিতীয়ত আধুনিকতার নামে ঐতিহ্যকে অবজ্ঞা করার মানসিকতা ব্রতচর্চার ক্ষেত্রটিকে ক্রমশ সংকুচিত করে তুলছে। এভাবে চলতে থাকলে প্রাচীন এই লোকসংস্কৃতির ধারা তার তাৎপর্য হারাবে। ব্রত মানুষের মনস্কামনার সরল শিল্পিত প্রকাশ। মানুষের বিশ্বাস আর জীবনভাবনার সঙ্গে তার অন্তরের যোগ। বাঙালির সামাজিক ও সংস্কৃতির ইতিহাসে ব্রতচর্চার গুরুত্বকে তাই কোনোভাবেই অস্বীকার করা যায় না।

Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।

Leave a Comment