বাংলা ভাষা উদ্ভবের ইতিহাস সংক্ষেপে বর্ণনা করো

বাংলা ভাষা উদ্ভবের ইতিহাস সংক্ষেপে বর্ণনা করো

উত্তর:

বাংলা ভাষা উদ্ভবের ইতিহাস

পৃথিবীতে প্রায় চার হাজার ভাষা প্রচলিত আছে। এই ভাষাগুলিকে তাদের মূলীভূত সাদৃশ্যের ভিত্তিতে তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বের পদ্ধতির সাহায্যে কয়েকটি ভাষাবংশে বর্গীকৃত করা হয়। এর মধ্যে একটি ভাষাবংশ হল ইন্দো-ইউরােপীয় ভাষাবংশ। এই ইন্দো-ইউরােপীয় ভাষাবংশের লােকেদের আদি বাসস্থান ছিল রাশিয়ার উরাল পর্বতের পাদদেশে। সেখান থেকে আনুমানিক ২৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের কাছাকাছি সময়ে তারা বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। এই বিস্তারের ফলে তাদের ভাষায় ক্রমশ আঞ্চলিক পার্থক্য বৃদ্ধি পায়। ফলে ইন্দো-ইউরােপীয় ভাষাবংশ থেকে প্রথমে পাঁচটি প্রাচীন ভাষার জন্ম হয়। এর মধ্যে একটি হল ইন্দো-ইরানীয় ভাষা বংশ।

ইন্দো-ইরানীয় ভাষাভাষীর জনগােষ্ঠীর লােকেরা নিজেরা ‘আর্য’ নামে অভিহিত করত বলে সংকীর্ণ অর্থে এই শাখাটিকে আর্যশাখা বলা হয়। এই আর্যভাষা থেকেই বাংলা ভাষার উদ্ভব। তবে আর্য থেকে বিবর্তণের পরবর্তী ধাপেই বাংলা ভাষার উদ্ভব ঘটেনি বেশ কয়েকটি স্তর অতিক্রম করে বাংলা ভাষার উদ্ভব ঘটেছে। আনুমানিক ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত ভারতীয় আর্যভাষাকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়—

১) প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা— কালসীমা ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। 

২) মধ্য ভারতীয় আর্যভাষা— কালসীমা ৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৯০০ খ্রিস্টাব্দ। এবং

৩) নব্য ভারতীয় আর্যভাষা— কালসীমা ৯০০ খ্রিস্টাবদ থেকে বর্তমান সময়। 

প্রাচীন ভারতীয় আর্যের দু’টি রূপ ছিল সাহিত্যিক ও কথ্য। কথ্যরূপটির চারটি আঞ্চলিক উপভাষা ছিল প্রাচ্য, উদীচ্য, মধ্যদেশীয় ও দাক্ষিনাত্য। এই কথ্য উপভাষাগুলি লােকমুখে স্বাভাবিক পরিবর্তণ লাভ করে যখন প্রাকৃত ভাষার রূপ নেয় তখন মধ্য ভারতীয় আর্যভাষার যুগ সূচিত হয়। প্রাকৃতের প্রথম স্তরে তার চারটি আঞ্চলিক কথ্য উপভাষা ছিল। প্রাচীন ভারতীয় ভারতীয় আর্যের কথ্যরূপগুলি থেকে চারটি প্রাকৃত উপভাষার জন্ম হয়। যেমন প্রাচ্য থেকে প্রাচ্যা প্রাকৃত এবং প্রাচ্য-মধ্যা প্রাকৃত, উদীচ্য থেকে উত্তর-পশ্চিমা প্রাকৃত এবং মধ্যদেশীয় ও দাক্ষিণাত্য থেকে পশ্চিমা বা দক্ষিণ-পশ্চিমা প্রাকৃত। এরপর প্রাকৃত ভাষা যখন বিবর্তণের দ্বিতীয় স্তরে পড়ে তখন মূলত এই চার রকমের মৌখিক প্রাকৃত থেকে পাঁচ রকমের সাহিত্যিক প্রাকৃতের জন্ম হয়। যেমন- উত্তর-পশ্চিমা থেকে পৈশাচী, পশ্চিমা বা দক্ষিণ-পশ্চিমা থেকে শৌরসেনী ও মহারাষ্ট্রী, প্রাচ্য মধ্যা থেকে অর্ধ মাগধী এবং প্রাচ্যা থেকে মাগধী।

পৈশাচী, মহারাষ্ট্রী, শৌরসেনী, অর্ধমাগধী এবং মাগধী ছিল শুধু সাহিত্যে ব্যবহৃত প্রাকৃত। প্রাকৃতের বিবর্তণের তৃতীয় স্তরে এইসব সাহিত্যিক প্রাকৃতের ভিত্তি স্থানীয় কথ্যরূপগুলি থেকে অপভ্রংশের জন্ম হয় এবং অপভ্রংশের শেষ স্তরে আসে অবহটঠ। প্রত্যেক শ্রেণীর প্রাকৃত থেকে সেই শ্রেণীর অপভ্রংশ-আবহটঠের জন্ম হয়েছিল। যেমন পৈশাচী প্রাকৃত থেকে পৈশাচী অপভ্রংশ-অবহট্ঠ, মহারাষ্ট্রী প্রাকৃত থেকে মহারাষ্ট্রী অপভ্রংশ-অবহট্ঠ, শৌরসেনী প্রাকৃত থেকে শৌরসেনী অপভ্রংশ-অবহট্ঠ, অর্ধমাগধী প্রাকৃত থেকে অর্ধমাগধী অপভ্রংশ-অবহট্ঠ এবং মাগধী প্রাকৃত থেকে মাগধী অপভ্রংশ-অবহট্ঠ।

এরপর ভারতীয় আর্যভাষা তৃতীয়যুগে পদার্পন করে। এই সময় এক একটি অপভ্রংশ-অবহট্ঠ থেকে একাধিক নব্য ভারতীয় আর্যভাষা জন্মলাভ করে। যেমন- পৈশাচী অপভ্রংশ-অবহঠট থেকে পাঞ্জাবি, মহারাষ্ট্রী অপভ্রংশ-অবহট্ঠ থেকে মারাঠি, শৌরসেনী অপভ্রংশ-অবহট্ঠ থেকে হিন্দি, অর্ধমাগধী অপভ্রংশ-অবহট্ঠ থেকে অবধি, আর মাগধী অপভ্রংশ-অবহট্‌ঠ পশ্চিমা ও পূর্বী নামে দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এরমধ্যে পূর্বী ভাষাটি থেকে বঙ্গ-অসমীয়া এবং ওড়িয়া এই দু’টি ভাষার জন্ম হয়। পরবর্তীকালে বঙ্গ-অসমীয়া ভাষাটি বিভক্ত হয়ে বাংলা ভাষার উদ্ভব ঘটে।

এভাবে বিবর্তনের নানা স্তর পেরিয়ে ইন্দো-ইউরােপীয় বা মূল আর্য ভাষাবংশ থেকে বাংলা ভাষার উদ্ভব ঘটে। অনেকেই বাংলা ভাষার জননী হিসাবে সংস্কৃত ভাষাকে বললেও তা যুক্তিগ্রাহ্য নয়। কারন সংস্কৃত ছিল আর্যভাষার লিখিত রূপ, আর বাংলা ভাষার উদ্ভব আর্যভাষার কথ্যরূপ (প্রাকৃত) থেকে।

প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা

পৃথিবীতে প্রায় চার হাজার ভাষা প্রচলিত আছে। এদের মূলীভূত সাদৃশ্যের ভিত্তিতে প্রধ্যণত তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বের পদ্ধতির সাহায্যে কয়েকটি ভাষাবংশে বগীকৃত করা হয়। এই ভাষাবংশের একটি শাখা ভারতবর্ষ ও ইরান-পারস্যে প্রবেশ করলে তাদের ইন্দো-ইরানীয় বা সংকীর্ণ অর্থে আর্য শাখা বলা হয়। এই শাখাটি দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে একটি যায় ইরান-পারস্যে, অপরটি আসে ভারতবর্ষে। ভারতবর্ষে যে শাখাটি প্রবেশ করে তাদের ভাষাকেই ভারতীয় আর্যভাষা বলে। ঘটনাটি ঘটেছিল আনুমানিক ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। সেই সময় থেকে এখনও পর্যন্ত ভারতীয় আর্যভাষাকে তিনটি স্তরে ভাগ করা হয় —

১) প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা— বিস্তারকাল আনুমানিক ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থকে ৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। 

২) মধ্যভারতীয় আর্যভাষা— বিস্তারকাল আনুমানিক ৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৯০০ খ্রিস্টাব্দ এবং

৩) নব্যভারতীয় আর্যভাষা— বিস্তারকাল আনুমানিক ৯০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে বর্তমান সময়।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে প্রাচীনভারতীয় আর্যভাষার বিস্তারকাল আনুমানিক ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত। এই ভাষার মূল নিদর্শন হিন্দুদের প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ ‘বেদ’। ‘বেদ’ আবার চারটি ঋক, সাম, যজু ও অথর্ব। এছাড়াও প্রত্যেক বেদের আবার চারটি অংশ আছে সংহিতা, ব্রাহ্মন, উপনিষদ এবং আরণ্যক। প্রাচীনভারতীয় আর্যের দু’টি রূপ ছিল বৈদিক ও সংস্কৃত। এর বৈশিষ্ট্যগুলি হল —

ধ্বনিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য: 

১) ঋ, ঋঋ, ৯, এ, ঐ সহ সমস্ত স্বরধ্বনি এবং শ, ষ, স সহ সমস্ত ব্যঞ্জণধূনি এই ভাষায় প্রচলিত ছিল।

২) স্বরাঘাতের স্থান পরিবর্তনের ফলে শব্দের অন্তর্গত স্বরধ্বনির বিশেষ ক্রম অনুসারে পরিবর্তন হত। এই পরিবর্তনের তিনটি ক্রম ছিল— গুন, বৃদ্ধি ও সম্প্রসারন। স্বরধ্বনি অবিকৃত থাকলে তাকে গুন বলে, স্বরধ্বনি দীর্ঘ হয়ে গেলে তাকে বৃদ্ধি বলে এবং স্বরধ্বনি যখন ক্ষীণ হয়ে লােপ পায় তখন এই পরিবর্তনকে সম্প্রসারন বলে।

৩) সন্নিহিত দুই ধূনির মধ্যে যেখানে সন্ধি সম্ভব সেখানে সন্ধি প্রায় সব ক্ষেত্রেই অপরিহার্য ছিল।

৪) প্রাচীন ভারতীয় আর্যের বৈদিক ভাষার স্বর তিন প্রকার ছিল উদাত্ত (high\acute), অনুদাত্ত (low\grave), এবং স্বরিত (circumplex)। 

৫) প্রাচীন ভারতীয় আর্যে যুক্ত ব্যঞ্জণের স্বচ্ছন্দ ব্যবহার প্রচলিত ছিল। যেমন – ঐ, ক্ল, ক্ত, ভূ, র্ম, দার, ষ্ট্র, ঘ্ন ইত্যাদি।

রূপতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য:

১) একবচন, দ্বিবচন এবং বহুবচন নিয়ে প্রাচীনভারতীয় আর্যে তিনটি বচন ছিল।

২) মূল ইন্দো-ইউরােপীয় ভাষায় প্রাচীনভারতীয় আর্যে আটটি কারক ছিল কতৃকারক, কর্মকারক, করণকারক, নিমিত্তকারক, সম্প্রদানকারক, অপাদানকারক, সম্বন্ধকারক, অধিকরণকারক এবং সম্বােধনকারক।

৩) প্রাচীনভারতীয় আর্যে লিঙ্গ তিনপ্রকার ছিল পুং লিঙ্গ (masculine), স্ত্রীলিঙ্গ (feminine) এবং ক্লীবলিঙ্গ (neuter)।

৪) প্রাচীনভারতীয় আর্যে শব্দরূপের চেয়ে ক্রিয়ারূপের বৈচিত্র্য বেশি ছিল। কর্তৃবাচ্য (Active Voice) কর্ম-ভাব বাচ্য (Middle Voice) এই দুই বাচ্যে ক্রিয়ারূপ পৃথক হত।

৫) ক্রিয়ারূপ পরৈস্মপদ ও আত্মনেপদ— এই দুইরূপে বিভক্ত ছিল। ধাতুও তিনভাগে বিভক্ত ছিলপরৈস্মপদী, আত্মনেপদী ও উভয়পদী।

৬) প্রাচীনভারতীয় আর্যে তিনপুরুষে (উত্তমপুরুষ, মধ্যমপুরুষ ও প্রথমপুরুষ) ক্রিয়ারূপ পৃথক হত।

৭) এই ভাষায় ক্রিয়ার পাঁচটি কাল ছিল। এগুলি হল- লট্, লঙ্‌, নৃট্‌ (Present Perfect, Future), লিট্‌ (Perfect) লুঙ্‌ (Past)। এর মধ্যে লঙ্‌, লুঙ্‌ ও লিট্‌ ছিল অতীত কালের ই প্রকারভেদ।

৮) প্রাচীনভারতীয় আর্যের বৈদিকে ক্রিয়ার পাঁচটি ভাগ ছিল- অভিপ্রায় (লেট্‌), নিবন্ধ, নিদের্শক, সম্ভাবক (বিধিলিঙ্‌) এবং অনুজ্ঞা (লােট্‌)।

৯) প্রাচীনভারতীয় আর্যে প্র, পরা, অপ, সম, অনু, অব, নির, দুর, বি, অধি, সু, উৎ, অতি, নি, পরি, অপি, অপ, আ— এই কুড়িটি উপসর্গ ছিল। যারা ধাতুর পূর্বে যুক্ত হয়ে নতুন শব্দ গঠন করত।

১০) প্রাচীনভারতীয় আর্যে প্রত্যয় যােগেও নতুন নতুন শব্দ গঠন করা হত। এই প্রত্যয় ছিল দুই প্রকার কৃৎ প্রত্যয় ও তদ্ধিত প্রত্যয়। ( ধাতুর সাথে যে প্রত্যয় যােগ করা হত তাকে বলা হত কৃৎ প্রত্যয়। যেমন- বৃৎ+শানচ্‌= বর্তমান, মন+উ= মনু, আর শব্দের সাথে যে প্রত্যয় যােগ করআ হত তাকে বলা হত তদ্ধিত প্রত্যয়। যেমন- মন+অন্ মানব।)।

বাক্যগঠনগত বৈশিষ্ট্য:

প্রাচীনভারতীয় আর্যে কর্তা, কর্ম প্রভৃতি কারক ও ক্রিয়ার বিভিন্ন রূপের বিভক্তি সুনির্দিষ্ট ছিল জন্য বাক্যের মধ্যে সেগুলি যেখানেই বসুক কর্তা, কর্ম, ক্রিয়া প্রভৃতি সহজে চিনে নেওয়া যেত। ফলে বাক্যের অন্তর্গত পদগুলির অবস্থান উল্টে পাল্টে দিলেও তাতে বাক্যের অর্থ বিঘ্নিত হত না।

ছন্দোরীতিগত বৈশিষ্ট্য:

প্রাচীনভারতীয় আর্যের বৈদিকের ছন্দ ছিল অক্ষরমূলক অক্ষরের সংখ্যা লঘুগুরু বিচার করে এখানে ছন্দ নির্ণয় করা হত। পরবর্তীকালের মাত্ৰামূলক ছন্দের সাথে এই ছন্দের পার্থক্য এখানে যে, মাত্ৰামূলক ছন্দ পদ্ধতিতে অক্ষর উচ্চারণের কাল বা মাত্রা অনুযায়ী ছন্দ নির্ণয় করা হত।

মধ্যভারতীয় আর্যভাষা 

পৃথিবীতে প্রচলিত সমস্ত ভাষাকে যে কয়েকটি ভাষাবংশে বিভক্ত করা হয় তার মধ্যে একটি হল। ইন্দো-ইউরােপীয় ভাষাবংশ। এই ইন্দো-ইউরােপীয় ভাষাবংশের একটি শাখা হল ইন্দো-ইরানীয় শাখা, যাকে সংকীর্ণ অর্থে আর্য শাখা বলা হয়। এই আর্য শাখার একটি দল আনুমানিক ১৫০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে ভারতবর্ষে প্রবেশ করলে ভারতীয় আর্যভাষার যুগের সূচনা ঘটে। সে সময় থেকে এখন পর্যন্ত প্রচলিত এই আর্যভাষাকে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়—

১) প্রাচীনভারতীয় আর্যভাষা— কালসীমা ১৫০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ থেকে ৬০০ খ্রিস্টাব্দ। 

২) মধ্যভারতীয় আর্যভাষা— কালসীমা ৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৯০০ খ্রিস্টাব্দ এবং 

৩) নব্যভারতীয় আর্যভাষা— কালসীমা ৯০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে বর্তমান কাল।

প্রাচীনভারতীয় আর্যের লিখিত ভাষা ছিল বৈদিক ও সংস্কৃত। কিন্তু এ সময়কার মুখের ভাষা প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে ক্রমে ক্রমে পরিবর্তিত হয়। আনুমানিক ৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের কাছাকাছি সময়ে এই ধ্বনিগত তথা ব্যকরণগত স্বরূপের পরিবর্তন ঘটে এক নতুন যুগের সূচনা হয়। এই যুগটির নাম দেওয়া হয় মধ্যভারতীয় আর্যভাষা। এই ভাষা ৯০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রচলিত ছিল। এই সময়কার ভাষাগুলি হল— ক্ল্যাসিক্যাল সংস্কৃত, বৌদ্ধ সংস্কৃত বা মিশ্র সংস্কৃত, অপভ্রংশ, অবহট্ঠ প্রভৃতি। স্বাভাবিকভাবে ১৫০০ বছরে এর মধ্যেও নানা পরিবর্তণ এসেছে। আমরা সেই বিভাগের আলােচনায় না গিয়ে মধ্যভারতীয় আর্যভাষার সাধারন বৈশিষ্ট্যের মধ্যেই আমাদের আলােচনা সীমাবদ্ধ রাখব। এই মধ্যভারতীয় আর্যভাষার বৈশিষ্ট্যগুলি হল —

ধ্বনিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য:

১) প্রাচীনভারতীয় আর্যভাষার দু’টি অর্ধ-ব্যঞ্জণধ্বনি ‘ঋ’ ও ‘৯’ মধ্যভারতীয় আর্যে লােপ পায়। ‘৯’ একেবারে লােপ পায়, আর ‘ঋ’ এক এক প্রাকৃতে এক এক রকম ধূনিতে পরিণত হয়। যেমন— মগ<মৃগ, বুড্‌ঢ়<বৃদ্ধ, ইসি<ঋষি।

২) ঐ’ এবং ঔ’-এই দু’টি যৌগিকস্বর একক স্বর ‘এ’ এবং ‘ও’ ধ্বনিতে পরিবর্তিত হয়। যেমন— ধর্মানুশত্থিয়ে<ধর্মানুশস্তৈ (এ<ঐ), ওষধানি<ঔষধানি (ও<ওঁ)।

৩) “অয়” এবং “অব’ সংকোচনের ফলে ‘এ’ এবং ‘ও’ ধ্বনিতে পরিণত হয়। যেমন— পূজেতি<পূজয়তি, ভােদি<ভবতি।

৪) পদান্তেস্থিত অনুস্বারের পূর্ববর্তী এবং যুক্তব্যঞ্জণের পূর্ববর্তী দীর্ঘস্বর হ্রস্বস্বরে পরিবর্তিত হয়। যেমন— কন্তং<কান্তাম্‌।

৫) পদের শেষে অবস্থিত অনুস্বার সাধারণত রক্ষিত হয়েছে। যেমন— নরং<নরাম্‌, এছাড়াও বাঁকি সব ব্যঞ্জণধ্বনি লােপ পেয়েছে। যেমন- নরা<নরাৎ।

৬) মধ্যভারতীয় আর্যভাষার দ্বিতীয়স্তরে দুইস্বরের মধ্যবর্তী একক ব্যঞ্জণ অল্পপ্রাণ হলে লােপ পেয়েছে এবং তার জায়গায় কখনাে য়-শুতি, কখনাে ব-তি হয়েছে। যেমন — সয়ল<সঅল<সকল। আর মহাপ্রাণ হলে ‘হ’ কারে পরিণত হয়েছে। যেমন- মুহ<মুখ।

৭) ঋ, র, ষ ধূণির পরবর্তী দন্ত্যধ্বনি (ত, থ, দ, ধ, ন) পরিবর্তিত হয়ে মূর্ধণ্যধ্বনির (ট, ঠ, ড, ঢ, ণ) রূপ লাভ করেছে। যেমন— কট<কৃত। 

৮) পদের মধ্যে অবস্থিত সংযুক্ত ব্যঞ্জণের বিষমধুনিগুলি সমধুনিতে পরিণত হয়েছে। যেমন— ভত্ত<ভক্ত।

রূপতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য :

১) মধ্যভারতীয় আর্যে ‘আ’-কারান্ত, ‘ই’-কারান্ত ও ‘উ’-কারান্ত শব্দ ছাড়া বাকি সব শব্দের রূপ | ‘অ-কারান্ত শব্দের মত হয়। যেমন— ‘নর’।

২) মধ্যভারতীয় আর্যে দ্বিবচন লােপ পেয়ে শব্দরূপে শুধু একবচন ও বহুবচনের রূপভেদ থাকে। 

৩) প্রাচীনভারতীয় আর্যে বিশেষ্য ও সর্বনামে শব্দরূপ পৃথক হত, মধ্যভারতীয় আর্যে কোথাও কোথাও বিশেষ্যের শব্দরূপ সর্বনামের শব্দরূপের মত হতে দেখা যায়।

৪) প্রাচীনভারতীয় আর্যে বহুবচনে প্রায়ই প্রথম ও দ্বিতীয়ায় স্বরান্ত শব্দের রূপ পুংলিঙ্গে পৃথক ছিল। যেমন— ‘নর’ শব্দের প্রথমার রূপ ‘নরাঃ এবং দ্বিতীয়ায় রূপ ছিল ‘নরান্‌; মধ্যভারতীয় আর্যে এই পার্থক্য লােপ পায়।

৫) প্রাচীনভারতীয় আর্যে ক্রিয়ারূপে আত্মনেপদ ও পরস্মৈপদ এই দুই প্রকারভেদ ছিল। মধ্যভারতীয় আর্যে আত্মনেপদ প্রায় লােপ পায়, সর্বক্ষেত্রেই প্রায় পরস্মৈপদের ব্যবহার প্রচলিত হয়।

৬) প্রাচীনভারতীয় আর্যে ক্রিয়ার ধাতু ভবাদি, দ্বিভাদি প্রভৃতি গণ বা শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল। কিন্তু মধ্যভারতীয় আর্যে সাধারণত সব ধাতুর রূপ ভবাদি গণের মত ধাতু হয়ে যায়।

৭) প্রাচীনভারতীয় আর্যে ক্রিয়ার ভাব ছিল পাঁচটি নির্দেশক, অনুজ্ঞা বা লােট, অভিপ্রায়, নিবন্ধ ও সম্ভাবক বা বিধিলিঙ্‌। মধ্যভারতীয় আর্যে এগুলির মধ্যে অভিপ্রায় ও নিবন্ধ ভাব লােপ পায়। প্রাকৃতে শুধু নির্দেশক, অনুজ্ঞা ও সম্ভাবক ভাব থাকে। 

৮) প্রাচীনভারতীয় আর্যে ক্রিয়ার কাল ছিল পাঁচটি লট্‌, লঙ্‌, লৃট্‌, লিট্‌ এবং লুঙ্‌। এদের মধ্যে লঙ্‌, লুঙ্‌ ও লিট ছিল অতীতকালের প্রকারভেদ। মধ্যভারতীয় আর্যে এই তিনপ্রকার অতীতের মধ্যে লিট একেবারে লােপ পায়, আর লঙ্‌ ও লুঙ্‌ মিলে একটি রূপ লাভ করে।

বাক্যগঠনগত বৈশিষ্ট্য: 

প্রাচীনভারতীয় আর্যে বাক্যের পদবিন্যাসে বাঁধাধরা নিয়মের অপরিহার্যতা ছিলনা, কিন্তু মধ্যভারতীয় আর্যে অনেক বিভক্তি চিহ্ন লােপ পায় ফলে বাক্যের মধ্যে শব্দের নির্দিষ্ট স্থানে শব্দের অবস্থানের উপর বাক্যে তাদের ভূমিকা ও পদ পরিচয় অনেকখানি নির্ভর করে। তাই বাক্যের পদবিন্যাস ক্ৰমের নিয়মের গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। এখানে বিভক্তি লােপ পাওয়ার ফলে বিভক্তির অর্থে কিছু স্বতন্ত্র শব্দ ও প্রত্যয়ের ব্যবহারের প্রচলনের পাশাপাশি অনুসর্গেরও প্রচলন হয়।

ছন্দোরীতিগত বৈশিষ্ট্য:

প্রাচীনভারতীয় আর্যে ছন্দ অক্ষরমূলক হলেও মধ্যভারতীয় আর্যে ছন্দ হয়ে যায় মাত্ৰামূলক। ফলে ছন্দের বিন্যাস অক্ষরের সংখ্যার উপরে নয়, অক্ষর উচ্চারণের কাল পরিমাপ বা মাত্রার উপর নির্ভর করতে হয়। কবিতার চরণ বা পঙক্তিগুলি প্রথমে বিষমমাত্রিক থাকলেও সমমাত্রিক দ্বিবিধ চরণে পরিণত হত। এই সময় থেকেই অন্ত্যানুপ্রাস বা পঙ্‌ক্তির চরণের শেষে মিল রচনা শুরু হয়।

নব্য ভারতীয় আর্যভাষা

নব্য ভারতীয় আর্যভাষার সাধারণ লক্ষণ

১) ব্যঞ্জনধ্বনির সরলতা : প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষার (OIA) যে যুবব্যঞ্জনগুলির মধ্যভারতীয় আর্যভাষায় প্রধানত সমীভবনের ফলে যুগ্ম ব্যঞ্জনে পরিণত হয়েছিল এখানে তা দাঁড়িয়েছে একটিমাত্র ব্যঞ্জনে। আগের হ্রস্বস্বর হয়েছে দীর্ঘ। ফলত প্রাচীন ভারতীয় আর্যের ‘পক্ক’ প্রাকৃতে হয়েছে ‘পক্‌ক’-বাংলা বা হিন্দীতে তার রূপান্তর হয়েছে ‘পাক’-এ। এইরকম আর একটি দৃষ্টান্ত ‘মধ্য’—মগঝ’—“মাঝ’ ।

২) সংস্কৃত ধ্বনি : প্রতিষ্ঠা হয়েছে অ-কারের সংস্কৃত উচ্চারণ রীতির। পরে যুগ্ম ব্যঞ্জন হয়েছে সরল এবং আগের হ্রস্ব অ-কার রূপান্তরিত হয়েছে দীর্ঘ অ-কারে। যেমন সর্ব—সব্ব—সব ; অষ্ট—অট্‌ট—অঠ প্রভৃতি। ব্যতিক্রমও আছে। কেননা উত্তর-পশ্চিমা উপভাষার ধ্বনিতে পরিবর্তন এভাবে আসেনি। পুরনাে রীতি অনুসারে সেখানে কোনাে কোনাে সময় যুগ্ম ব্যঞ্জন থেকে গিয়েছে। ‘অদ্য’ হয়েছে ‘অজ্জ। 

৩) অনুনাসিক ধ্বনির ক্রমাবলুপ্তি : নব্য ভারতীয় আর্যভাষার যুগ্ম ব্যঞ্জনের ঠিক আগেকার নাসিক্য ধ্বনিগুলি ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে এসে শেষে পূর্ববর্তী স্বরধ্বনিগুলিকেও অনুনাসিক করে দিয়েছে। পরে এই অনুনাসিক ধ্বনিগুলিই লুপ্ত হয়েছে। দন্ত’-এর প্রাচীন বাংলায় রূপান্তর হয়েছিল ‘দান্ত হিসেবে। আধুনিক বাংলায় এরই রূপান্তরিত আকার দাঁত।‘কম্প হয়েছে ‘কাঁপ; দণ্ড হয়েছে ‘দাঁড়’। এইরকম আরাে অনেক দৃষ্টান্ত।

৪) ই, ঈ, বা উ, ঊ, জনিত পরিবর্তন : পদের ভেতরকার ই বা ঈ-র সঙ্গে অ বা আ এবং উ ঊ-এর সঙ্গে অ বা আ যথাক্রমে ই, ঈ, উ, ঊ হয়েছে। এই ধারাতেই প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষার ‘ঘৃত প্রাকৃতে হয়েছে ‘ঘিঅ । বাংলায় এর থেকে এসেছে ‘ঘী। অনুরূপভাবে মৃত্তিকা হয়েছে ‘মাটি’ বা মাটী’। 

৫) লিঙ্গ সংক্রান্ত পরিবর্তন : পদের শেষের স্বরধ্বনি বিকৃত অথবা লুপ্ত হয়েছে। এর ফলে আগেকার লিঙ্গ সংক্রান্ত পার্থক্য প্রায়ই থাকেনি। ক্লীবলিঙ্গ রয়ে গেছে কেবল গুজরাটি আর মারাঠি-তে। অন্য ভাষাগুলিতে পুংলিঙ্গা-স্ত্রীলিঙ্গভেদ আছে। কিন্তু সেই ভেদ আর প্রাচীন লিঙ্গ প্রকরণ এক নয়। একই পুংলিঙ্গ-স্ত্রীলিঙ্গা শব্দ কোথাও হয়েছে, পুংলিঙ্গা, কোথাও বা স্ত্রীলিঙ্গ। যে সব শব্দ অ-কারান্ত, তার শেষ লিঙ্গ পরিবর্তন খুবই কম হয়েছে।

৬) প্রাচীন শব্দরূপ, কারক, অনুসর্গ প্রভৃতির নতুনতর বিন্যাস :  প্রাচীন বা মধ্যভারতীয় আর্যভাষার প্রথম দিককার শব্দরূপের চিহ্ন অপভ্রংশ যেটুকু বিদ্যমান ছিল, পদান্তরে স্বরধ্বনির পরিবর্তনের ফলে তাও লুপ্ত হয়েছে। এইরকম লুপ্ত প্রাচীন কারক-বিভক্তির জায়গায় দেখা দিল অনুসর্গ এবং অনুসর্গ থেকে তৈরি হওয়া কয়েকটি নতুন কারক-বিভক্তি। পুরনাে বিভক্তি কিছু থেকে গিয়েছে। যেমন প্রথমায় ই, উ, এ ; তৃতীয়ায় ‘ঐ, এ এবং সপ্তমীতে ই এ। ব্যতিক্রমও আছে। তবে তা উল্লেখ করার মতাে নয়। ফলত ষষ্ঠী-চতুর্থী-র, সপ্তমী-তৃতীয়া বা পঞমীর অর্থে যে সমস্ত প্রত্যয়, প্রত্যয়স্থানীয় শব্দ অথবা অনুসর্গ ব্যবহার করা হয়েছিল, নতুন কারক-বিভক্তিগুলি অধিকাংশই তার থেকে তৈরি হয়েছে। কয়েকটি বিভক্তির মূল হচ্ছে স্থান বা অঙ্গাবাহক শব্দ। যেমন সপ্তমীতে ‘অন্ত’ থেকে বাংলা বা অসমীয়ায় এসেছে ‘ত’, পঞ্জাবীতে তার রূপ হ’ল ‘আঁত। নব্য ভারতীয় আর্যভাষায় কারক বলতে দু’টি। কর্তা বা মুখ্য কারক এবং তির্যক বা গৌণ কারক। পুরনাে কর্তৃকারকের অর্থে ব্যবহৃত প্রথমা এবং তৃতীয় বিভক্তি একসঙ্গে মিশে গিয়ে হয়েছে মুখ্য কারক ; ষষ্ঠী। ও সপ্তমীর মিশ্রণের ফলে হ’ল গৌণ কারক। অনুসর্গ, অনুসর্গ থেকে জাত বিভক্তিগুলির ব্যবহার গৌণ কারকেই। 

৭) বচন : সিন্ধী, মারাঠী এবং পশ্চিমী হিন্দী ছাড়া অন্য ক্ষেত্রে মুখ্য কারকে একবচন বহুবচনের পার্থক্য দূর হওয়ায় বহুত্বজ্ঞাপক শব্দের সাহায্যে বা সম্বন্দ্বপদ থেকে সৃষ্টি হয়েছে বহুবচনের। যেমন বাংলায় সম্বন্ধপদ থেকে জাত ‘লােকেরা। কোথাও কোথাও অবশ্য তৃতীয়ার বহুবচনের পদ থেকে গেছে। যেমন ওড়িয়া, পূর্বীহিন্দী, পশ্চিমী হিন্দী। 

৮) ক্রিয়ার কাল : নব্য ভারতীয় আর্যভাষায় ক্রিয়ার কাল এবং ভাবের মধ্যে শুধু কর্তৃ ও কর্মর্ভাববাচ্যে বর্তমান কালের এবং অনুজ্ঞার পুরােনাে রূপ থেকে গেছে। কোনাে কোনাে সময় দেখা যায় ভবিষ্যৎকালের রূপের বদল ঘটেনি। সব ক্ষেত্রেই নিষ্ঠা এবং শতৃ প্রত্যয় যােগ করে অতীতকালের এবং কোনাে কোনাে সময় কৃত্য, তব্য বা শতৃ প্রত্যয় যুক্ত করে ভবিষ্যত্বাল তৈরি করা হয়েছে। যেমন ‘চলা’ ধাতুকে অবলম্বন করে চলিত বাংলায় হয়েছে ‘চলি’, ‘ভবন্ত থেকে বাংলায় হয়েছে ‘হইত’, মৈথিলীতে ‘হােত। নব্যভারতীয় আর্যভাষার মধ্যপর্ব থেকে প্রধানত ‘অস্, ‘ভূ বা ‘স্থা ধাতুর পদ মূল ধাতুর অসমাপিকার সঙ্গে যুক্ত করে যৌগিক কালের প্রয়ােগ দেখা দিল। এইভাবে গত’-র সঙ্গ ‘অ-এর মিশ্রণে বাংলায় হ’ল গিয়াছে। আবার হিন্দীতে এই ‘গত’-র সঙ্গে ‘ভূ’ বা ‘অস্ যােগ করে হ’ল ‘গয়া হৈ’। এইরকম ‘জানন্ত’-র সঙ্গে ‘অস্-ধাতুর সঙ্গে যুক্ত করে বাংলায় হ’ল জানিতেছিল ; হিন্দীতে ‘জানন্ত’-র সঙ্গে ‘ভূ যােগ করে হয়েছে ‘জান্‌তা হৈ’।

Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।

2 thoughts on “বাংলা ভাষা উদ্ভবের ইতিহাস সংক্ষেপে বর্ণনা করো”

Leave a Comment