উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণ সম্পর্কে একটি নিবন্ধ রচনা করাে।

অথবা, বাংলার নবজাগরণের বৈশিষ্ট্য বা চরিত্র এবং সীমাবদ্ধতা আলােচনা করাে। [ প্রশ্নের মান]

ইংরেজদের আগমন, ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠা এবং পাশ্চাত্য সভ্যতার সংস্পর্শ বাংলা তথা ভারতকে দারুণভাবে প্রভাবিত করে। ফলে উনিশ শতকে বাংলার সমাজ, ধর্ম, শিক্ষা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনীতি সর্বক্ষেত্রে এক আলােড়ন সৃষ্টি হয় এবং বাংলা নতুন করে জেগে ওঠে। উনিশ শতকের বাংলার এই জাগরণ সাধারণ ভাবে বঙ্গীয় রেনেসাঁ বা নবজাগরণ নামে পরিচিত।

বিতর্ক : উনিশ শতকের বাংলার জাগরণকে সাধারণভাবে নবজাগরণ আখ্যা দেওয়া হলেও এর নানা দিক নিয়ে পন্ডিতমহলে বিতর্ক আছে। একে প্রকৃতই নবজাগরণ বলা যায় কিনা, এর ভিত্তি কী ছিল, স্রষ্টা কারা প্রভৃতি প্রশ্নে ঐতিহাসিকরা পক্ষে, বিপক্ষে মতামত পপাষণ করেছেন। যদুনাথ সরকার, সুশােভন সরকার এই জাগরণকে নবজাগরণ আখ্যা দিয়েছেন। অপরদিকে বিনয় ঘােষ, অশােক মিত্র, সুমিত সরকার প্রমুখরা নবজাগরণ আখ্যা দিতে নারাজ এবং তারা বাংলার নবগাজরণের স্রষ্টা বিষয়েও একমত নন।

বৈশিষ্ট্য : বাংলার নবজাগরণের কিছু বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়।

1) ভিত্তি : বাংলার নবজাগরণের প্রধানতম ভিত্তি ছিল প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যবাদীআদর্শ।

2) কলকাতা কেন্দ্রিকতা : বাংলার নবজাগরণের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হল এর কলকাতা কেন্দ্রিকতা। বলাবাহুল্য কলকাতার গন্ডি পেরিয়ে বিশেষত গ্রামাঞ্চলে এর তেমন প্রভাব পড়েনি। 

3) বৈদেশিক শাসন নির্ভরতা : বিদেশী বিশেষত ইংরেজশাসক ও তার। মদতপুষ্ট ব্যক্তিরাই ছিল বাংলা নবজাগরণের উৎগাতা ও হােতা। এই নবজাগরণে সাধারণ মানুষের তেমন অবদান ছিল না। 

4) জনসাধারণ থেকে বিচ্ছিন্নতা :সাধারণ মানুষের সঙ্গে বাংলার নবজাগরণের সম্পর্ক তেমন ছিল না। স্বভাবতই বঙ্গীয় নবজাগরণ ছিল। জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন। 

5) অনুসন্ধানী মানসিকতা: পাশ্চাত্য সভ্যতা ও সংস্কৃতিক প্রভাবে সংঘটিত।হয় বাংলার নবজাগরণ। ফলে পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত বুদ্ধিজীবীরা।

তাদের চিরাচরিত রক্ষণশীল মানসিকতা দূর করে এবং যুক্তি মানবতাবাদী আদর্শের সঞ্চার হয়। ফলে বাঙালী সমাজের অনুসন্ধানী মানসিকতার উদ্ভব হয়।

স্বতন্ত্র নবজাগরণ : অনেকে ইতালীর রেনেসাঁসের সঙ্গে বাংলার নবজাগরণের তুলনা করেছেন এবং সাদৃশ্য তুলে ধরেছেন। কিন্তু প্রকৃত বিচারে নানা ক্ষেত্রেই দুটি নবজাগরণের তুলনা হয় না। প্রকৃতপক্ষে বাংলার নবজাগরণ ছিল একটি স্বতন্ত্র নবজাগরণ।

সীমাবদ্ধতা : বাংলার নবজাগরণের বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা পরিলক্ষিত হয়। যথা – 

1) উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণ ছিল কলকাতা কেন্দ্রিক। এর সূচনা, ব্যাপ্তি সবকিছুই কলকাতাতেই সীমাবদ্ধ ছিল।

2) নবজাগরণ তথা বাংলার সমাজ, ধর্ম সংস্কার আন্দোলন মূলত হিন্দু সমাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।

3) বাংলার নবজাগরণে মানবতাবাদ ছিল অনুপস্থিত এবং স্থাপত্য ভাস্কর্যের দিকটিও ছিল অবহেলিত।

4) কলকাতার মধ্যবিত্ত শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী, জমিদার, পেশাজীবী ব্যক্তিরা লাভবান হলেও দেশের সাধারণ মানুষ এবং মুসলিমরা এর কোন সুবিধা পায়নি। 

5) ইতালীর নবজাগরণের প্রাণশক্তি বাংলার নবজাগরণে অনুপস্থিত। 

6) বাংলার নবজাগরণের প্রবক্তারা বাংলার সমাজ কাঠামাে, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, জাতিভেদ প্রথা, রাজনৈতিক আদর্শ প্রভৃতি ক্ষেত্রে তেমন কোন পরিবর্তন আনতে পারেননি।
উপসংহার: সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বাংলার সমাজ, ধর্ম, রাজনীতি, সংস্কৃতির ক্ষেত্রে নবজাগরণ ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিল। বলা যায় বাংলা তথা ভারতের মাটিতে এক সর্বব্যাপী বৌদ্ধিক জাগরণ এনে দিয়েছিল এই নবজাগরণ। আর এর উপর ভিত্তি করেই জন্ম নয়ে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের। যা ভারতীয় ইতিহাসের গতিপথকে নতুন পথে চালিত করে।

আরো পড়ুন

উনিশ শতকে বাংলার নবজাগরণের চরিত্র ও প্রকৃতি আলোচনা করো

Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।

Leave a Comment