বাস্তুতন্ত্র বা ইকোলজি বলতে কী বােঝ? আমাদের জীবনে পরিবেশের প্রয়ােজনীয়তা সম্পর্কে লেখ

বাস্তুতন্ত্র বা ইকোলজি বলতে কী বােঝ? আমাদের জীবনে পরিবেশের প্রয়ােজনীয়তা সম্পর্কে লেখ। এই প্রসঙ্গে পরিবেশ দূষণ প্রতিরােধের বিষয়ে আলােচনা কর। Class 12 | Sociology (সাম্প্রতিক কালের সামাজিক বিচার্য বিষয়) | 8 Marks

উত্তর:

ইকোলজি বা বাস্তুতন্ত্র

এ ব্যুৎপত্তিগত অর্থ : ‘ইকোলজি’ শব্দটি ১৮৬৯ সালে সর্বপ্রথম ব্যবহার করেন জার্মান প্রাণীবিজ্ঞানী আর্নেস্ট হেকেল (Earnest Hacckel)। ইংরেজি ‘ইকোলজি’ শব্দটির সৃষ্টি হয়েছে দুটি গ্রিক শব্দের সমাহারে। সংশ্লিষ্ট গ্রিক শব্দ দুটি হল ওইকস’ (Oikos) এবং ‘লােগস’ (logos)। “ওইক’ শব্দটির অর্থ হল বাসস্থান। বা ঘরবাড়ি। লােগস’ শব্দটির মানে হল জ্ঞান বা শাস্ত্র। সুতরাং ব্যুৎপত্তিগত অর্থে ইকোলজি বলতে বােঝায়। জীবসমূহের বিভিন্ন বাসস্থান বা বাস্তু সম্পর্কিত জ্ঞান বা অধ্যয়ন। তবে এ হল ইকোলজির সংকীর্ণ অর্থ।

ব্যাপক অর্থ : ব্যাপক অর্থে ইকোলজি বা বাস্তুতন্ত্র হল বিভিন্ন জীবের পারস্পরিক সম্পর্ক এবং প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের সমীক্ষণ বা অনুশীলন। পৃথিবী, এই বাসস্থানটিতে পরিপালিত জীবসমুহের সঙ্গে পরিবেশের সম্পর্ক বিষয়ক বিজ্ঞানই হল বাস্তুতন্ত্র বা ইকোলজি। পৃথিবীতে মানুষের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন জীব, উদ্ভিদ এবং সুক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম প্রাণী একসঙ্গে বসবাস করে। একসঙ্গে বসবাসের সুবাদে প্রত্যেকে পরস্পরের সঙ্গে অবিচ্ছিন্ন, অদৃশ্য, কিন্তু গভীর এক সম্পর্ক বন্ধনে আবদ্ধ। মানুষ, অন্যান্য জীব ও উদ্ভিদ—এদের কেউই বিচ্ছিন্নভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। টিকে থাকার তাগিদে এরা পরস্পরের উপর নির্ভরশীলতার ভিত্তিতে জীবনযাপন করে। প্রত্যেকটির জন্ম, বৃদ্ধি ও বিকাশের সঙ্গে অন্যগুলির কোনাে-না-কোনাে সম্পর্ক বর্তমান। এ সবের অধ্যয়ন-অনুশীলন বা জ্ঞানই হল ‘ইকোলজি।

দীর্ঘকালীন প্রেক্ষিতে একটি অঞলের ইকোলজি মানুষের ক্রিয়াকর্মের দ্বারা পরিশীলিত ও পরিবর্তিত হতে পারে এবং হয়ও। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে আঞ্চলিক রুক্ষতা বা বন্যাপ্রবণতার কথা বলা যায়। এ বিষয়ে মানুষের দায়িত্ব অনস্বীকার্য। নদীর অববাহিকার অপেক্ষাকৃত উপরিভাগের অরণ্য অঞ্চল ধ্বংস করলে সংশ্লিষ্ট নদীটি অধিকতর বন্যাপ্রবণ হয়ে পড়তে পারে। প্রকৃতির উপর মানুষের প্রতিকূল আচরণের পরিণামে পৃথিবীব্যাপী উয়ায়নের প্রক্রিয়া কাজ করছে। ইকোলজিমূলক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক ও মানবীয় উপাদানসমূহের প্রভাব দীর্ঘকালীন প্রেক্ষিতে পৃথক করা, চিহ্নিত করা দুরূহ ব্যাপার।

ইকোলজির জৈব ও ভৌতিক উপাদান ও প্রক্রিয়া মানুষের ক্রিয়াকর্মের কারণে অল্পবিস্তর রূপান্তরিত হতে পারে এবং হয়ও। এ ক্ষেত্রে উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, নদীর প্রবাহপথ ও প্রকৃতি মানুষের ভূমিকার কারণে। পরিবর্তিত হতে পারে। মানুষের তৈরি অন্যান্য ইকোলজিমূলক উপাদানের কথা বলা যায়। নগর-মহানগরের বিভিন্ন ইমারত, অট্টালিকা, বিবিধ সৌধ, পরিকাঠামােমূলক বিভিন্ন নির্মাণ প্রভৃতি তৈরি হয় বিভিন্ন প্রাকৃতিক উপাদান-উপকরণ নিয়ে। কিন্তু মানুষই এ সব তৈরি করে। সুতরাং শহরের এই ইকোলজির সৃষ্টিতে মানুষের অবদান অনস্বীকার্য। এ প্রসঙ্গে কোনাে একটি অঞ্চলের কৃষিব্যবস্থার কথাও উদাহরণ হিসাবে উল্লেখযােগ্য। সংশ্লিষ্ট অঞলের সেচব্যবস্থা, মাটি পরীক্ষা, প্রয়ােজনীয় রাসায়নিক সারের প্রয়ােগ, কীটনাশকের ব্যবহার, কৃষিবিজ্ঞানীদের দ্বারা তৈরি উন্নতমানের অধিক ফলনশীল বীজ, বিভিন্ন কৃষি উপকরণ, বৃক্ষরােপণ প্রভৃতি ইকোলজির উপাদানসমূহ মানুষেরই সৃষ্টি।

পরিবেশের প্রয়ােজনীয়তা

জীবনের জন্য পরিবেশ অপরিহার্য। পরিবেশের উপাদানসমূহের উপর জীবনের নির্ভরশীলতা অনস্বীকার্য। খাদ্যের জন্য প্রাণীকে পরিবেশের উপর নির্ভর করতে হয়। জীবনধারণের উপযােগী খাদ্যের জন্য অন্যান্য প্রাণী ও উদ্ভিদের উপর, বসবাসের জন্য মাটি, অন্যান্য সজীব ও অজীব উপাদানসমূহের উপর, নিশ্বাসপ্রশ্বাসের জন্য বাতাসের অক্সিজেনের উপর প্রাণীকে একান্তভাবে নির্ভর করতে হয়। পরিবেশের এই সমস্ত উপাদান স্থির নয়, পরিবর্তনশীল। তবে সূর্যালােকের ক্ষেত্রে এ কথা খাটে না। পরিবেশের এই সমস্ত । উপাদানের পরিমাণের হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটলে অথবা উপাদানগুলির বিশুদ্ধতা বা গুণগত মান হ্রাস পেলে সংশ্লিষ্ট পরিবেশের মধ্যে বসবাসকারী প্রাণীসমূহের জীবনযাপনে বিবিধ সমস্যার সৃষ্টি হবে। অনেক প্রাণী স্থানান্তরে

কমন করে বেঁচে থাকার চেষ্টা করবে, আবার কোনাে কোনাে প্রজাতি অবলুপ্ত হয়ে যাবে। এ সবের ফলে বিদ্যমান পরিবেশের ভারসাম্য বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে।

উদ্ভিদসমূহও পরিবেশের উপর একান্তভাবে নির্ভরশীল। মাটির জল; খাদ্য-সংশ্লেষের প্রয়ােজনে অত্যাবশ্যক নিজ লবণসমূহ বা প্রাণীর বর্জ্য পদার্থসমূহ; সালােকসংশ্লেষের প্রয়ােজনে সূর্যালােক; বাতাসের অক্সিজেন o কার্বন ডাইঅক্সাইড প্রভৃতির উপর উদ্ভিদ নির্ভরশীল। আবার অনেক উদ্ভিদের বংশবিস্তারের স্বার্থে পরাগ সংযােগের প্রয়ােজনে পতঙ্গদের সাহায্য দরকার।

পরিবেশের প্রভাবকে মানুষ এড়িয়ে যেতে বা এড়িয়ে থাকতে পারে না। অনুকূল পরিবেশ মানুষের সার্বিক বিকাশের সহায়ক। অনুরূপভাবে প্রতিকূল পরিবেশ মানুষের জীবনযাপনকে বিপন্ন করে তােলে। সামগ্রিক বিচারে মানুষের অস্তিত্ব, বিকাশ এবং এমন কি বিনাশও বহুলাংশে পরিবেশের উপর নির্ভরশীল। মানুষের সমগ্র জীবনধারার উপর পরিবেশের প্রভাব-প্রতিক্রিয়া বিরােধ -বিতর্কের ঊর্ধ্বে। তবে আধুনিককালে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভাবনীয় বিকাশ ও বিস্তার ঘটেছে। তারফলে পরিবেশের উপর মানুষের নিয়ন্ত্রণ অল্পবিস্তর পরিলক্ষিত হচ্ছে। আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রভাবে মানুষ আজকাল প্রতিকূল পরিবেশকে অনুকুলে ব্যবহার করার ব্যাপারে উদ্যোগ-আয়ােজন গ্রহণ করেছে। | পরিবেশ দূষণের ফলে বাস্তুতন্ত্রের সংকট বর্তমানে প্রধান বিষয়। বায়ু, ভূমি, মৃত্তিকা এবং জল— এগুলি মানুষের বেঁচে থাকার জন্য একান্ত প্রয়ােজন। দুর্ভাগ্যবশত এই সমস্ত বস্তুগুলি দূষিত হচ্ছে। যা বর্তমানে প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।।

পরিবেশ দূষণের জন্য শিল্পোন্নত দেশগুলি প্রধানত দায়ী। এছাড়া অরণ্যের ধ্বংস এবং কৃষিজাত দ্রব্য দহনের ফলে পরিবেশ দূষিত হয়। আধুনিক প্রযুক্তিবিদ্যা এবং জনসংখ্যার অতিমাত্রায় বৃদ্ধি পরিবেশ সংকটের অন্যতম কারণ।

পরিবেশ দূষণ প্রতিরােধের বিভিন্ন ব্যবস্থা : পৃথিবীতে মানুষের টিকে থাকার জন্য পরিবেশ দূষণের মাত্রা বৃদ্ধি রােধ করা একান্ত প্রয়ােজন। একদিনে বা দুদিনে এই দূষণের সৃষ্টি হয়নি, ক্রমাগত অজ্ঞভাবে পরিবেশকে ব্যবহারের ফলে দূষণ সৃষ্টি হয়েছে, বৈজ্ঞানিকগণ ও পরিবেশবিদগণ এ বিষয়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ। গ্রহণ করেছেন। পরিবেশ বিষয়ক বিভিন্ন ব্যবস্থাগুলি হল—

(১) উপযুক্ত জাতীয় শিল্পনীতি গ্রহণ করা প্রয়ােজন। (২) অনিয়ন্ত্রিত শহরীকরণ বন্ধ করা। (৩) গাড়ির মালিককে কাঠোরভাবে নির্দেশ দিতে হবে দূষণ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র বসানাের জন্য। (৪) শহরে নদৰ্মা পদ্ধতির পুনরাবৃত্তি করতে হবে। (৫) অজৈব এবং অবক্ষয়হীন বর্জ্য পদার্থের স্থূপ সংগ্রহ করে দূরে স্থানান্তরিত করতে হবে। অবক্ষয়হীন পদার্থের পুনর্ব্যবহার করতে হবে। (৬) বর্জ্য পদার্থের স্তুপ প্রত্যহ পরিষ্কার করতে হবে। (৭) পরিবেশকে রক্ষা করতে বিভিন্ন আন্দোলন ও সংগঠিত প্রচারকার্য চালাতে হবে। (৮) অরণ্য সংরক্ষণের জন্য উৎসাহ দিতে হবে। (৯) ওজোন স্তরকে রক্ষা করার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে। (১০) পরিবেশকে রক্ষা করার জন্য অর্থনৈতিক দিক থেকে বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে। (১১) শিশুদের মধ্যেও পরিবেশ বিষয়ক সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। (১২) পরিবেশ বিষয়ক শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করতে হবে। (i) পরিবেশ বিষয়ক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দান করা। (ii) উন্নত বিজ্ঞানের ফলে বায়ু, জল, মৃত্তিকার অবক্ষয় নিয়ে পরিবেশ বিজ্ঞানকে কাজ করতে হবে। (iii) পরিবেশের উপর যন্ত্রবিজ্ঞানের প্রভাব পরিবেশীয় যন্ত্রবিজ্ঞান আলােচনা করবে।

Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।

Leave a Comment