বিশ্ব উষ্ণায়ন | মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা

বিশ্ব উষ্ণায়ন – মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা

বিশ্ব উষ্ণায়ন

উত্তর:

বিশ্ব উষ্ণায়ন

“তুমি আলাে যেইখানে সাগর-নীলিমা আজ মানুষের সন্দেহে কালাে,
ভাইরা ব্যথিত হলে ভাইদের ভালাে,
মানুষের মরুভূমি একখানা নীল মেঘ চায়।”
–জীবনানন্দ

শতকের মানবসভ্যতা জ্ঞানে ও মেধায় মানুষের ব্ৰত্মাণ্ড জয়ের উপাখ্যান। বিজ্ঞানের অজস্র আবিষ্কার একদিকে যেমন সভ্যতাকে সমৃদ্ধ করেছে, অন্যদিকে মানুষের জীবনেও এনেছে স্বাচ্ছন্দ্য। কিন্তু এরই মধ্যে বিজ্ঞানের অনিয়ন্ত্রিত প্রয়ােগ, পরিকল্পনাহীন উন্নয়ন মানুষের সভ্যতায় অশনিসংকেতের সৃষ্টি করেছে। আতঙ্কের যেসব আবহ বিপন্ন করে তুলেছে আধুনিক পৃথিবীকে তার অন্যতম হল বিশ্ব উষ্ণায়ন।

বিশ্ব উষ্ণায়ন বলতে সারা পৃথিবীর উষ্ণতার ক্রমবর্ধমান অবস্থাকে বােঝানাে হয়। এর পরিচিত ইংরেজি প্রতিশব্দ হল Global Warming। ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে নােবেলজয়ী সুইডিশ বিজ্ঞানী আরথেনিয়াস বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ বাড়ার সঙ্গে পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির সম্ভাবনা বিষয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেন। সেই আশঙ্কা প্রগতির অনিয়ন্ত্রিত প্রবাহে আজ রূপান্তরিত হয়েছে আতঙ্কে।

বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য দায়ী করেছেন গ্রিনহাউস গ্যাসগুলিকে। গ্রিনহাউস গ্যাস, যেমন—কার্বন ডাইঅক্সাইড, মিথেন, নাইট্রোজেনের অক্সাইডসমূহ, ক্লোরােফ্লুরাে কার্বন, জলীয় বাষ্প ইত্যাদির তাপ ধরে রাখার ক্ষমতা আছে। বলা বাহুল্য, এর মধ্যে পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে প্রধান ভূমিকা কার্বন ডাইঅক্সাইডের। পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, শিল্পবিপ্লবের সাতশাে বছর আগে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ ছিল ২৪০ পিপিএম। ২০০৫ খ্রিস্টাব্দে এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩৭৯ পিপিএম। বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা যে, ২০৫০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ এই পরিমাণ বেড়ে হতে পারে ৪৫০ পিপিএম। যেখানে পৃথিবীতে গ্রিনহাউস প্রভাব সৃষ্টিতে কার্বন ডাইঅক্সাইডের ভূমিকা প্রায় ৫০ শতাংশ, সেখানে এই পরিসংখ্যান যথেষ্টই আশঙ্কার কারণ।

এই গ্রিনহাউস এফেক্ট পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধিতে প্রথম এবং প্রধান দায়িত্ব মানুষেরই। যথেচ্ছভাবে জীবাশ্মজনিত জ্বালানির ব্যবহার, অরণ্য ধ্বংস ইত্যাদি বাতাসে কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। সিমেন্ট, সে ফোম ইত্যাদির কারখানাও কার্বন ডাইঅক্সাইডের জোগান দিচ্ছে পরিবেশে। একইভাবে এয়ারকন্ডিশনার ও রেফ্রিজারেটর শিল্প, গ্যাস-তেলকয়লার উৎপাদন ও পরিবহণ পরিবেশে মিথেনের পরিমাণ বাড়িয়ে তুলছে। রাবাহিকভাবে রাসায়নিক সারের ব্যবহার এবং অরণ্য ধ্বংস করার ফলে পরিবেশে নাইট্রাস অক্সাইডের পরিমাণ ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। এইভাবে মানষের অনিয়ন্ত্রিত কাজকর্ম পৃথিবীর উষ্ণতাবৃদ্ধিকে নিশ্চিত করে তাকে পরিচালিত করছে এক সমূহ সর্বনাশের দিকে।

গ্রিনহাউস প্রভাবের ফল সুদূরপ্রসারী। ১৮৫০ থেকে ১৯০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতা ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। বিজ্ঞানীরা অনুমান করেছেন, ২০৩০ খ্রিস্টাব্দে এই বৃদ্ধির হার হবে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এই উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে ২০৪০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে মেরুপ্রদেশের বরফ সম্পূর্ণ গলে যেতে পারে। এর ফলে সমুদ্রের জলস্তর বেড়ে যাবে এবং উপকূলবর্তী এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল চিরকালের মতাে সমুদ্রে তলিয়ে যাবে। পৃথিবীর প্রায় ৫০ কোটি লােক বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়বে। তৈরি হবে খাদ্য ও পানীয় জলের সংকট। এর পাশাপাশি জলবায়ুর ব্যাপক পরিবর্তন হবে। হয়তাে কোথাও গ্রীষ্মকাল দীর্ঘ হবে, আবার কোথাও শীত। নতুনভাবে অতিবৃষ্টি ও খরাপ্রধান অঞ্চল সৃষ্টি হবে। বাড়বে ঘূর্ণিঝড়, তুষারপাত, সুনামি ইত্যাদি বিভিন্নরকম প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এই উষ্ণায়নের প্রভাবে হৃদযন্ত্রের অসুখ, রক্তচাপ এসব যেমন বাড়বে তেমনি ক্রান্তীয় অঞ্চলে ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, ভাইরাল এনকেফেলাইটিস ইত্যাদি অসুখের প্রকোপও বাড়বে। অসংখ্য উদ্ভিদ ও প্রাণী চিরতরে পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাবে, দাবানল বৃদ্ধি পাবে। জলস্তর বাড়ায় ম্যানগ্রোভ শ্রেণির অরণ্য ধ্বংস হওয়া নিশ্চিত। এভাবে বিশ্ব উষ্ণায়ন নানাভাবে আমাদের পরিচিত পৃথিবীকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।

গ্রিনহাউস গ্যাসসমূহের নির্গমন রােধ করার উদ্দেশ্য নিয়ে ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরােতে অনুষ্ঠিত হয়েছিল বসুন্ধরা শীর্ষ সম্মেলন। ২০০২ খ্রিস্টাব্দে জোহানেসবার্গেও একই উদ্দেশ্যে সম্মেলন হয়। কিন্তু উন্নত পশ্চিমী দেশগুলির অসহযােগিতায় কোনােক্ষেত্রেই কোনাে সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে পৌঁছােনাে যায়নি। ২০০৫ খ্রিস্টাব্দে জাপানের কিয়েটো শহরে পৃথিবীর ১৫৬টি দেশ গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণ কমানাের জন্য নির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। কিন্তু এখানেও আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়া চুক্তিতে সই করতে অস্বীকার করে। ২০০৭ খ্রিস্টাব্দে ইন্দোনেশিয়ার বালিতে অনুষ্ঠিত সম্মেলনেও একই ঘটনা ঘটে। ২০১১ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বরে বিশ্বের ১৯১ টি দেশ গ্রিনহাউস সংক্রান্ত চুক্তিপত্রে সই করে। যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই চুক্তিতে সই করেনি। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলির একাংশের ধারাবাহিক অসহযােগিতা সত্ত্বেও আশার কথা এই যে অধিকাংশ রাষ্ট্র এবং বিশ্বজনমত এখন বিশ্ব উষ্ণয়নের বিষয়ে সচেতন হচ্ছে।

আরো পড়ুন

দেশপ্রেম বনাম বিশ্বপ্রেম | মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা

সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরােধে ছাত্রসমাজের ভূমিকা | মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা

বিজ্ঞান আশীর্বাদ না অভিশাপ | মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা

ছাত্রজীবনে সৌজন্য ও শিষ্টাচার | মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা

নিরক্ষরতা দূরীকরণে ছাত্রসমাজ | মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা

Read More »

Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।

Leave a Comment