বন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ | মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা

বন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ  – মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা

বন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ

উত্তর:

বন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ

‘নিজের ছায়ায় দাঁড়িয়ে আছে
দুরন্ত এক জংলি গাছ
চারপাশে তার শানায় কুড়ল ।
ধােপদুরস্ত ফন্দিবাজ।”

–সুমন চট্টোপাধ্যায়

আদিম অরণ্যবৃক্ষ প্রাণের ধাত্রী হিসেবে পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছিল বহু কোটি বছর আগে। তারপর এককোশী প্রাণী থেকে মানুষের আবির্ভাব ঘটতে অনেক সময় লেগেছে। আদিম মানুষকে নিজের অকৃপণ স্নেহচ্ছায়ায় লালন করেছে বিশ্বপ্রকৃতি। অরণ্যচারী মানুষ প্রকৃতি থেকেই সংগ্রহ করেছে। আহার্য, আবার প্রকৃতিই তাকে দিয়েছে আশ্রয়। সভ্যতার বিকাশ ঘটেছে, কিন্তু অরণ্যের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক, অরণ্যের প্রতি নির্ভরতাকে অস্বীকারের কোনাে সুযােগ আজও নেই আপাত-উদ্ধত এই মানবসভ্যতার কাছে।

একটা সময়ে অরণ্য ছিল সভ্যতার ধাত্রী। প্রাচীন ভারতবর্ষে বৈদিক সভ্যতা ছিল অরণ্যভিত্তিক। তপােবন ছিল শিক্ষাবিস্তারের কেন্দ্র। বাণপ্রস্থে বনে যাওয়ার রীতি ছিল। মন্দাক্রান্তা ছন্দে প্রবাহিত সেদিনের জীবনযাত্রায় অরণ্যের এই গুরুত্বের কথা স্বীকৃত হয়েছে বেদে, মহাভারতে এবং রামায়ণের মতাে প্রাচীন গ্রন্থগুলিতে। শুধু অরণ্য নয়, অরণ্যের পশুরাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে। কখনও তারা আহার্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে, কখনও জীবিকাপূরণে সাহায্য করেছে। কখনও এই পশুই হয়েছে বিনিময়ের মাধ্যম। মানুষও অভিজ্ঞতা আর বিশ্বাসের যুগ্ম নিরিখে আঁকড়ে ধরতে চেয়েছে এই অরণ্যপ্রকৃতিকে বৃক্ষ এবং পশুদের দেবতাজ্ঞানে পুজো করেছে।

কৌমসভ্যতার কোলে ধীরে ধীরে জন্ম নিয়েছে আধুনিক মানুষ। সভ্যতার চরিত্রবদল হয়েছে। শিল্পবিপ্লবের বলে বলীয়ান মানবসভ্যতা একটা সময়ে অরণ্যপ্রকৃতির অবদানকে ভুলতে শুরু করেছে সভ্যতার বিকাশে। সভ্যতার গতি যত বেশি করে বহির্মুখী হয়েছে, ততই সে অস্বীকার করতে চেয়েছে অরণ্যপ্রকৃতির সঙ্গে তার আত্মার বন্ধন। ফলে নতুন জনপদ সৃষ্টি, শিল্পস্থাপন কিংবা নগরায়ণের দোহাই দিয়ে নির্বিচারে বৃক্ষনিধন চলেছে। আর এই অরণ্য ধ্বংসের কারণে অসংখ্য প্রজাতির পশুপাখি চিরকালের জন্য পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

এই মুহূর্তে গােটা পৃথিবীর স্থলভাগের মাত্র ২৭ শতাংশ বনভূমি। অরণ্যহ্রাসের ভয়াবহ পরিণামে মানবসভ্যতার বিলােপসাধন অসম্ভব নয়। এর প্রত্যক্ষ প্রভাবে বাতাসে অক্সিজেনের মাত্রা কমে কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে ভয়াবহভাবে, তীব্র হচ্ছে দুষণ। গাছের পরিমাণ কমে যাওয়ায় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে যাচ্ছে, ফলে মরুভূমির বিস্তার ঘটছে। সৃষ্টি হচ্ছে ‘গ্লোবাল ওয়ার্মিং’-এর, মেরুপ্রদেশের বরফ গলে যাচ্ছে। ভূমিক্ষয় বেড়ে যাচ্ছে, জমির উর্বরাশক্তি নষ্ট হচ্ছে। অজস্র বন্য জন্তু ও পাখি, সরীসৃপ, কৃয়সার হরিণ, ভারতীয় বন্যগাধা, কস্তুরীমৃগ, তুষারচিতা, লজ্জাবতী বাঁদর, ধনেশ পাখি ইত্যাদির বিনাশ অথবা সংখ্যা কমে যাওয়ায় একদিকে অরণ্যের স্বাভাবিক সৌন্দর্য বিনষ্ট হচ্ছে, জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের মুখােমুখি হচ্ছে—পাশাপাশি এদের কেন্দ্র করে আবর্তিত হওয়া মানুষদের জীবন ও জীবিকাও ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে প্রাকৃতিক ভারসাম্য, বাস্তুতন্ত্র।

মানবসভ্যতায় অরণ্যের গুরুত্ব উপলদ্ধি করে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সচেতন। মানুষদের উদ্যোগ কার্যকরী হয়েছে সব যুগেই। রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনের আশ্রমবাসীদের নিয়ে বনমহােৎসবের প্রচলন করেন। স্বাধীনতার পরে সরকারি উদ্যোগে এই উৎসবের সূচনা হয়েছে। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন পরিকল্পনায় বৃক্ষরােপণ ও বনসৃজন প্রকল্পে ব্যয়বরাদ্দ বৃদ্ধি করা হয়েছে। ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে প্রণয়ন করা হয়েছে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন—যাতে নির্দিষ্ট প্রজাতির পশুপাখিদের হত্যা নিষিদ্ধ করে তাদের যথাযথ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা যায়।

বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের জন্য তাদের বাসভূমি চিহ্নিত করতে হবে বা কৃত্রিম বাসভূমি তৈরি করতে হবে। চোরাশিকার বন্ধ করতে হবে। অভয়ারণ্যে ‘অভয়’ এবং ‘অরণ্য’ দুটোই যাতে থাকে সেদিকে নজর দিতে হবে। অভয়ারণ্যে জীবজন্তুদের খাদ্য ও জলের জোগান পর্যাপ্ত রাখতে হবে, রাখতে হবে চিকিৎসার ব্যবস্থাও। অভয়ারণ্যের কাছাকাছি জনবসতি ও কলকারখানা স্থাপন করা চলবে না। আর প্রশাসনকে বন্যপ্রাণী আইন। কঠোরভাবে কার্যকরী করতে হবে।

অন্যদিকে, অরণ্য সংরক্ষণের ক্ষেত্রে অপরিণত বৃক্ষচ্ছেদন বন্ধ করতে হবে। প্রতিরােধ করতে হবে দাবানল। সর্বোপরি সুসংহত বনসৃজনে সর্বাধিক গুরুত্ব আরােপ করতে হবে। সেই সঙ্গে বনভূমিতে গৃহপালিত পশুচারণ নিষিদ্ধ করতে হবে। কাঠের বিকল্প জ্বালানি এবং আসবাবপত্র নির্মাণে বিকল্প দ্রব্যের ব্যবহার করতে হবে। কাঠের চোরাকারবার বন্ধে যথেষ্ট বনরক্ষী নিয়ােগ করতে হবে।

মানবসভ্যতায় বন ও বন্যপ্রাণীদের অবদান ও প্রয়ােজনীয়তাকে ভুলে যাওয়ার অর্থ নিশ্চিত ধ্বংসকে আহ্বান করা। তাই সচেতন মানুষ চেতনার গুণে তার ভুলের, পাপের উৎসকে অতিক্রম করে যাবে—এটাই যুগসন্ধিক্ষণের শ্রেষ্ঠতম আশা। বেঁচে থাকার, নিশ্বাস নেওয়ার অমলিন ভরসাও বটে।

Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।

Leave a Comment