বৃদ্ধি কাকে বলে | বৃদ্ধির ধারণা ব্যক্ত করাে | বৃদ্ধির বৈশিষ্ট্যগুলি আলােচনা করাে | Growth in Bengali

বৃদ্ধি কাকে বলে | বৃদ্ধির ধারণা ব্যক্ত করাে | বৃদ্ধির বৈশিষ্ট্যগুলি আলােচনা করাে | Growth in Bengali 1+2+5

উত্তর:

বৃদ্ধি:

বৃদ্ধির সংজ্ঞা:

বৃদ্ধি বলতে জীবদেহের আকার, আয়তন, ওজন ও উচ্চতার স্বতঃস্ফুর্ত ও স্থায়ী পরিবর্তনকেই বােঝায়। অথবা, মানবশিশুর জন্মগ্রহণের পর সময়ের নির্দিষ্ট পরিসীমার মধ্যে শিশুর দেহের গঠনগত অর্থাৎ আকার বা আয়তন, ওজন ও উচ্চতার নির্দিষ্ট, স্বাভাবিক ও স্থায়িত্বপূর্ণ এবং পরিমাপগত পরিবর্তনসাধনের প্রক্রিয়া হল বৃদ্ধি। 

বৃদ্ধির ধারণা:

মানবশিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর এক সৃষ্টিশীল জীবন-পরিবেশের সম্মুখীন হয়। এই পরিবেশে শিশুর জীবনে প্রতিনিয়ত রূপান্তরমূলক পরিবর্তনসাধন হয়। এইরূপে পরিবর্তন দুটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সংঘটিত হয়। একটি হল বৃদ্ধি এবং অপরটি হল বিকাশ। বৃদ্ধির ধারণা ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে মনােবিদ পেজ ও থমাস বলেছেন, মানুষের দৈহিক কাঠামাে ও আকৃতির স্বাভাবিক পরিবর্তন হল বৃদ্ধি। অর্থাৎ, বৃদ্ধি হল এমন এক সহজাত প্রক্রিয়া যা মানবশিশুর ইন্দ্রিয়সমূহের কার্যকারিতার উন্নয়নে সাহায্য করে তথাপি ইন্দ্রিয়গুলির ক্রিয়াগত পরিবর্তনকে অগ্রগতি প্রদান করে। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায়, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সঠিকভাবে সঞ্চালনের জন্য বৃদ্ধির ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ, শিশুর দৈহিক বৃদ্ধি যথাযথভাবে সংগঠিত হলে সে দৌড়াতে সক্ষম হয়। বুদ্ধি অভীক্ষার দ্বারাও প্রমাণিত হয়েছে যে, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বুদ্ধির বৃদ্ধি ঘটে। বুদ্ধি যতই বাড়ে সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে শিশু ততই আগের চেয়ে বেশি দক্ষতার পরিচয় দেয়। অর্থাৎ তার কর্মক্ষমতার পরিবর্তনের পরিচয় পাওয়া যায়। বুদ্ধির বৃদ্ধি ঘটে। বুদ্ধির বৃদ্ধির ফলেই এখানে বুদ্ধির বিকাশ পরিস্ফুট হচ্ছে। সুতরাং বলা যেতে পারে, ভবিষ্যৎ জীবনের পরিপক্বতা ও পরিপুষ্টতার পশ্চাতে বৃদ্ধির ভূমিকা অনস্বীকার্য।

বৃদ্ধির বৈশিষ্ট্য:

শিশুর জীবন বিকাশের ক্ষেত্রে বৃদ্ধির বৈশিষ্ট্যগুলি নিম্নে আলােচিত হল—

[1] বৃদ্ধি এক স্বতঃস্ফুর্ত দৈহিক পরিবর্তনের প্রক্রিয়া: শিশুর জন্মের পর তার জীবনে প্রথম স্বতঃস্ফুর্তভাবে পরিবর্তন আসে বৃদ্ধির মাধ্যমে। তবে বৃদ্ধি স্বতঃস্ফূর্তভাবে সংঘটিত হলেও অনুশীলনের প্রভাবকে অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু তা সত্ত্বেও সর্বোপরি বৃদ্ধি স্বাভাবিকভাবেই শিশুর দৈহিক পরিবর্তনসাধন করে। অর্থাৎ, শিশু জন্মগ্রহণ করার পর থেকেই দৈহিক আকার বা আয়তনের পরিবর্তন হয়। এই পরিবর্তন স্বাভাবিক ও সহজভাবেই ঘটে।

[2] বৃদ্ধি হল একক প্রক্রিয়া: শিশুর বৃদ্ধি এককভাবেই ঘটে। অর্থাৎ, অঙ্গপ্রত্যঙ্গের যে উন্নয়ন বৃদ্ধির মাধ্যমে ঘটে তা পৃথক পৃথকভাবে ঘটে না। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, শিশুর ওজন ও উচ্চতা একসঙ্গেই বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়; এরকম নয় যে, প্রথমে ওজনের বৃদ্ধি হয় ও পরে উচ্চতা বাড়ে। ওজন ও উচ্চতার বৃদ্ধির হারের মধ্যে তারতম্য থাকতে পারে কিন্তু যুগপত্তাবেই এগুলির বৃদ্ধি হয়। 

[3] বৃদ্ধি হল ক্রমােচ্চমান উন্নয়নমূলক প্রক্রিয়া::মানবজীবনে বৃদ্ধি ক্রমােচ্চভাবে দৈহিক উন্নয়ন ঘটায়। বয়সবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধি ধাপে ধাপে সংগঠিত হয়। অর্থাৎ বয়সবৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মানবজীবনে বৃদ্ধি ক্রিয়াশীল হয়। 

[4] বৃদ্ধি-বংশধারা ও পরিবেশের সমন্বয়ের ফল: বংশধারা ও পরিবেশের মিথস্ক্রিয়ার ফলেই বৃদ্ধি ঘটে। যদিও বংশধারা ও পরিবেশের প্রভাব সম্পর্কে মনােবিদদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। কোনাে কোনাে মনােবিজ্ঞানী বংশধারার সপক্ষে মতপ্রকাশ করেছেন আবার কেউ কেউ পরিবেশের প্রভাবকেই এককভাবে স্বীকার করেছেন। তবে, বেশিরভাগ মনােবিজ্ঞানীই বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বংশধারা ও পরিবেশের মিথস্ক্রিয়াকেই স্বীকার করেছেন। শিশুর জীবনে এই দুই উপাদানের প্রভাবকে অনস্বীকার্য বলেই মনে করা হয়। সুতরাং, বংশধারা ও পরিবেশ বৃদ্ধি প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে। শিক্ষক-শিক্ষিকাগণকে বংশধারা ও পরিবেশের প্রভাব সম্পর্কে সচেতন হতে হবে এবং শিশুর বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে। 

[5] বৃদ্ধির হার বিভিন্ন বয়সে পৃথকভাবে পরিলক্ষিত হয়: বিভিন্ন বয়সে বৃদ্ধির হারের মধ্যে পার্থক্য উল্লেখযােগ্যভাবে পরিলক্ষিত হয়েছে। এইচ ভি মেরেডিথ (HV Meredith) বৃদ্ধি হারের ওপর লম্ব অধ্যয়ন সম্পর্কে গবেষণা করেছেন। লম্ব অধ্যয়ন পদ্ধতি একই শিশু বা একদল শিশুকে দীর্ঘ সময় ধরে অধ্যয়ন করা। উদাহরণের সাহায্যে বলা যেতে পারে—

(i) জন্ম থেকে 2.5 বছর বয়স পর্যন্ত শিশুর দেহ এবং মস্তিষ্কের অভাবনীয় বৃদ্ধি ঘটে। 

(ii) আবার, 2–11 বছর বয়সে শিশুর উচ্চতা বৃদ্ধি পায়, কিন্তু চেহারা শীর্ণ হয়। 

(iii) 11–18 বছর বয়সে শৈশবের পরে আবার দ্রুত বৃদ্ধি ঘটে এবং প্রাপ্তবয়স্ক স্তরে শিশুর বৃদ্ধি সম্পূর্ণ হয়। শিক্ষাক্ষেত্রে শিক্ষক-শিক্ষিকাবৃন্দ শিশুর বৃদ্ধির হারের তারতম্য অনুযায়ী খাদ্যতালিকা নির্ধারণ করবেন এবং শিক্ষাক্ষেত্রে পাঠক্রম ও পদ্ধতির পরিকল্পনা করবেন। শিক্ষাক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের বিশেষভাবে দৈহিক অনুশীলনের প্রতি যত্নবান হবেন এবং শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সামাজিক ও সেবামূলক কাজে অনুপ্রেরণার জাগরণ ঘটাবেন।

[6] বৃদ্ধির সঙ্গে অনুশীলনের সম্পর্ক: বৃদ্ধি প্রক্রিয়ার সঙ্গে অনুশীলনের সম্পর্ক ভীষণভাবে নিবিড় ও পরিপুরক। বিভিন্ন মনােবিদদের গবেষণার দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে যে, বৃদ্ধির ওপর অনুশীলনের প্রভাব অপরিসীম, অপরপক্ষে বৃদ্ধিও অনুশীলনকে কার্যকারী করে তােলে। উদাহরণস্বরুপ উল্লেখ যে, একটি ছেলে বা মেয়ের উপযুক্তভাবে দৈহিক বৃদ্ধি হলে তবেই অনুশীলনে সে সক্ষম হয়। তাই বিদ্যালয়ে ব্যায়াম, জিমন্যাসটিক্স, বিভিন্ন প্রকারের খেলাধুলা ইত্যাদি ব্যবস্থার মাধ্যমে শিশুর বৃদ্ধি ও অনুশীলনের মধ্যে যে সম্পর্ক রয়েছে তা ফলপ্রসূ করে তুলতে হবে। 

[7] বৃদ্ধি ও দক্ষতা: উপযুক্ত বৃদ্ধি মানুষকে দক্ষতা অর্জনে সাহায্য করে। প্রত্যেক মানুষের মধ্যে কোনাে-না কোনাে কর্মে দক্ষতা অর্জনের ক্ষমতা বিদ্যমান থাকে। তবে এই ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ তখনই সম্ভব যখন বৃদ্ধি যথাযথ সময়ে উপযুক্তভাবে সুসম্পন্ন হবে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, কোনাে ছেলে যদি সঞ্চালনমূলক কাজে দক্ষ হয় তবে তার পশ্চাতে বৃদ্ধির প্রভাব খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষাপরিকল্পনার ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত পার্থক্যকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করে শিশুর দক্ষতার বিকাশকে ত্বরান্বিত করার জন্য যথাযথ বৃদ্ধির ব্যবস্থা করতে হবে। 

[8] একই বয়সে বৃদ্ধির হারের মধ্যে পার্থক্য: সমবয়স্ক শিশুদের বৃদ্ধির হারের ক্ষেত্রে পার্থক্য দেখা যায়। একটি নির্দিষ্ট বয়সে কোনাে শিক্ষার্থীর বৃদ্ধি দ্রুত হয় আবার কোনাে কোনাে শিক্ষার্থীর বৃদ্ধি শ্লথ গতিতে হয়। তাই বিদ্যালয়ের শিক্ষাপরিকল্পনা এমনভাবে রচনা করতে হবে যাতে, সকল শিক্ষার্থীই তার দ্বারা উপকৃত হয়। 

[9] ব্যক্তিভেদে বৃদ্ধির হারের সমতা: সাধারণত দেখা যায়, ব্যক্তিভেদে বৃদ্ধির সমহার বজায় থাকে। অর্থাৎ, যে শিশুর বৃদ্ধির হার প্রথমদিকে যতটা থাকে বৃদ্ধি যতদিন পর্যন্ত থাকে ওই একই হার বজায় থাকে। তাই, শিক্ষার ক্ষেত্রে বিভিন্ন কর্মসুচি চয়নের সময়ে ব্যক্তিগত প্রভেদের কথা বিবেচনা করে বিভিন্ন শিশুর বৃদ্ধির হারের সাথে সামঞ্জস্য রেখে কর্মসূচি নির্ধারণ করতে হবে।

[10] বৃদ্ধি অবিচ্ছিন্ন ও ধারাবাহিক প্রক্রিয়া: বৃদ্ধির ক্ষেত্রে অবিচ্ছিন্নতা ও ধারাবাহিকতা এক অন্যতম শর্ত। অর্থাৎ বৃদ্ধি যখন শুরু হয় তখন কোনাে বয়সে বৃদ্ধি থেমে যায় না, চলতে থাকে। তাই শিক্ষাপরিকল্পনা রচনা করার সময় বৃদ্ধির এই বৈশিষ্ট্যের কথা মনে রেখে শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে ধারাবাহিকতা অক্ষুন্ন রাখতে হবে।

উপসংহারে বলা যায়, উপরে আলােচিত বৈশিষ্ট্যগুলি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে যদিও খুবই গুরুত্বপূর্ণ তথাপি বৃদ্ধি এমন এক সর্বজনীন প্রক্রিয়া যা কোনাে নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ করা যুক্তিযুক্ত নয়। যদিও নির্দিষ্ট বয়সের পর বৃদ্ধির পরিসমাপ্তি ঘটে তথাপি মানবজীবনের পরিপূর্ণতা বৃদ্ধির ওপরই নির্ভরশীল।

Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।

Leave a Comment