প্রাচীন ভারতীয় শিক্ষার গ্রহণযােগ্য বৈশিষ্ট্য

প্রাচীন ভারতীয় শিক্ষার গ্রহণযােগ্য বৈশিষ্ট্য
অথবা, প্রাচীন ভারতীয় শিক্ষার কোন কোন বৈশিষ্ট্য আধুনিক শিক্ষায় গ্রহণ করা যেতে পারে বলে তুমি মনে করো

উত্তর : 

প্রাচীন ভারতীয় শিক্ষার গ্রহণযােগ্য বৈশিষ্ট্য : 

প্রাচীন যুগের বৈদিক, ব্রাহ্মণ্য এবং বৌদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থায় এমন অনেক বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা আধুনিক ভারতের শিক্ষার বিকাশের জন্য অপরিহার্য। আধুনিক যুগের বিভিন্ন শিক্ষা পরিকল্পনাতে প্রাচীন ভারতীয় শিক্ষার প্রতিফলন লক্ষ করা যায়। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের তপােবন শিক্ষা পরিকল্পনা, মহাত্মা গান্ধির গ্রামীণ শিক্ষা পরিকল্পনা, রামকৃয় মিশনের শিক্ষা পরিকল্পনাতেও প্রাচীন ভারতীয় শিক্ষার বহু বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। 1964–1966 খ্রিস্টাব্দে কোঠারি শিক্ষা কমিশনেও বিজ্ঞানচর্চার সঙ্গে প্রাচীন ভারতীয় অধ্যাত্মবাদের মিশ্রণকে গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এখানে প্রাচীন ভারতীয় সক্ষার গ্রহণযােগ্য বৈশিষ্ট্যগুলি উল্লেখ করা হল —

[1] শিক্ষার লক্ষ্য : প্রাচীন ভারতের শিক্ষার লক্ষ্য ছিল আত্মােপলব্বি, চরিত্রগঠন এবং মনুষ্যত্বের পরিপূর্ণ বিকাশ সাধনে শিক্ষার্থীকে সহায়তা করা। প্রাচীন ভারতীয় শিক্ষার এই লক্ষ্যটি আধুনিক যুগের শিক্ষাক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রয়ােজনীয়। ছাত্রছাত্রীদের চরিত্রগঠন করতে এবং তাদের মধ্যে নৈতিক ও অধ্যাত্মিক মূল্যবােধের বিকাশ ঘটাতে না-পারলে, শিক্ষার মধ্য দিয়ে ব্যক্তি, সমাজ ও দেশের প্রকৃত মঙ্গলসাধন করা কখনােই বাস্তবায়িত হবে না। 

[2] অভিজ্ঞতাভিত্তিক ও কর্মকেন্দ্রিক শিক্ষা : প্রাচীন ভারতের ব্রাহ্মণ্য শিক্ষাব্যবস্থায় গুরুকুল বা আশ্রমজীবন এবং বৌদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থায় সংঘ বা বিহার জীবনকে কেন্দ্র করে বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জনের মধ্য দিয়ে যে-ধরনের কর্মকেন্দ্রিক শিক্ষাদানের প্রথা প্রচলিত ছিল তার উদাহরণ অনুসরণ করে যদি বর্তমান সময়ের বিদ্যালয়গুলিতে শিক্ষার্থীদের সময়ােপযােগী অভিজ্ঞতাভিত্তিক ও কর্মকেন্দ্রিক শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা। হয়, তাহলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মনির্ভরশীলতা, দায়িত্ব ও কর্তব্যবােধ, ব্যাবহারিক কর্মকুশলতা ও শ্রমের মূল্যবােধ প্রভৃতির সৃষ্টি হবে। 

[3] শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন : প্রাচীন ভারতের ব্রাহ্মণ্য এবং বৌদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থায় গুরু ও শিষ্যের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপনের মধ্য দিয়ে যে আবাসিক ও ব্যক্তিকেন্দ্রিক শিক্ষাদানের রীতি প্রচলিত ছিল, আধুনিক যুগের বর্তমান শিক্ষাক্ষেত্রে আমরা যদি তার বাস্তব প্রয়ােগ ঘটাতে পারি, তাহলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে মধুর সম্পর্ক গড়ে উঠবে এবং প্রতিটি শিক্ষার্থীর সার্বিক বিকাশ ত্বরান্বিত হবে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার যথেষ্ট উন্নতি ঘটবে। 

[4] শিক্ষাক্ষেত্রে স্বাধীনতা : প্রাচীন ভারতের ব্রাহ্মণ্য ও বৌদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থায় গুরুরা শিক্ষাদান, শিক্ষা-সংক্রান্ত গবেষণা ও শিক্ষা কার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে যে-ধরনের স্বাধীনতা ভােগ করতেন, আধুনিক শিক্ষাক্ষেত্রেও সেই ধরনের স্বাধীনতা বিশেষভাবে প্রয়ােজনীয়। 

[5] প্রাকৃতিক পরিবেশে শিক্ষাদান : প্রাচীন ভারতের শিক্ষাব্যবস্থায় গুরুরা সাধারণত প্রকৃতির কোলে শান্ত পরিবেশে শিষ্যদের পাঠদান করতেন। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থাতে এই বৈশিষ্ট্যটি অপরিহার্য। কারণ শহরের কোলাহল থেকে দূরে উন্মুক্ত প্রকৃতির মাঝে শিক্ষা ছাত্রছাত্রীদের স্বাভাবিক আত্মবিকাশে অধিকভাবে সহায়ক হয়। 

[6] শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতা : প্রাচীন ভারতের ব্রাহ্মণ্য ও বৌদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থাতে গুরু এবং শিষ্য-উভয়কেই শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতা কঠোরভাবে মেনে চলতে হত। এই বৈশিষ্ট্যটি আধুনিক শিক্ষার ক্ষেত্রে খুবই প্রাসঙ্গিক এবং গ্রহণযােগ্য। 

[7] মেধানুযায়ী শিক্ষার ব্যবস্থা : প্রাচীন ভারতের শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থীর মেধাকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হত। মেধার ভিত্তিতেই শিক্ষার্থীকে উচ্চতর শিক্ষার জন্য সুযােগদান করা হত। এই বিষয়টি আধুনিক যুগের শিক্ষার ক্ষেত্রেও বিশেষভাবে গ্রহণযােগ্য। 

[8] বিশেষজ্ঞ ও গুণী ব্যক্তিদের সমাবেশ : প্রাচীন ভারতের শিক্ষাব্যবস্থায় পরিষদগুলি বিশেষজ্ঞ ও গুণী ব্যক্তিদের সমাবেশ ঘটিয়ে শিক্ষার্থীদের উন্নয়নের চেষ্টা করত। সেই দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে আমরা যদি বিশেষজ্ঞ এবং গুণী ব্যক্তিদের সমাবেশ ঘটিয়ে বিভিন্ন ধরনের সামাজিক ও শিক্ষা-সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানের ব্যবস্থা করতে পারি, তাহলে তার দ্বারা আমরা উপকৃত হতে পারব। 

[9] সর্বজনীন ও গণতান্ত্রিক শিক্ষার আদর্শ : প্রাচীন যুগের বৌদ্ধ শিক্ষা ছিল সর্বজনীন। জাতিধর্মবর্ণনির্বিশেষে মেধাসম্পন্ন সকল শিক্ষার্থী শিক্ষালাভের সুযােগ পেত। শিক্ষার এহেন সর্বজনীনতা আধুনিক শিক্ষায় বিশেষভাবে গ্রহণযােগ্য। বৌদ্ধযুগের শিক্ষার গণতান্ত্রিক আদর্শ অনুসরণযােগ্য। 

[10] রাজনৈতিক প্রভাবহীন শিক্ষা : প্রাচীন কালের শিক্ষাব্যবস্থায় বিত্তবান, জমিদার, রাজা প্রভৃতিরা শিক্ষার ব্যয়ভার গ্রহণ করলেও শিক্ষার ওপর তাদের কোনােরূপ হস্তক্ষেপ থাকত না। অর্থাৎ প্রাচীন কালের শিক্ষাব্যবস্থা ছিল রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত। এই বৈশিষ্ট্যটিও আধুনিক শিক্ষার ক্ষেত্রে গ্রহণযােগ্য।

Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।

Leave a Comment