রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধিজির শিক্ষাচিন্তার তুলনামূলক আলােচনা করাে।

রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধিজির শিক্ষাচিন্তার তুলনামূলক আলােচনা করাে।

উত্তর:

রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধিজির শিক্ষাচিন্তার তুলনামূলক আলােচনা

ভারতের দুই মনীষী রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধিজির শিক্ষাচিন্তার মধ্যে যথেষ্ট সাদৃশ্য আছে। আবার ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে কিছু পার্থক্যও লক্ষ করা যায়। তাদের শিক্ষাচিন্তার তুলনামূলক আলােচনা নিম্নে করা হল –

[1] শিক্ষাদর্শন : রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাদর্শন প্রধানত ভাববাদ ও প্রকৃতিবাদ দ্বারা প্রভাবিত। অপরদিকে গান্ধিজির শিক্ষাদর্শনেও ভাববাদ, প্রকৃতিবাদ পরিলক্ষিত হয়। 

[2] শিক্ষার লক্ষ্য : রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধিজি উভয়েই ব্যক্তির সম্পূর্ণ বিকাশকেই শিক্ষার লক্ষ্য বলে মনে করে। তবে কিছু দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য লক্ষ করা যায়—গান্ধিজির শিক্ষার লক্ষ্য অপেক্ষাকৃত মূর্ত কিন্তু কবিগুরুর শিক্ষার লক্ষ্য কিছুটা বিমূর্ত। রবীন্দ্রনাথের শিক্ষার লক্ষ্যের মধ্যে জাতীয় চেতনার সাথে আন্তর্জাতিক চেতনার ইঙ্গিত আছে। গান্ধিজি জাতীয় চেতনার সাথে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন সমাজতান্ত্রিকতাকে। 

[3] শিক্ষার পাঠক্রম : রবীন্দ্রনাথের মতে, শিশুর জীবনের সবদিক স্পর্শ করে এমন পাঠক্রম প্রণয়ন করা উচিত। তার জন্য তাকে ভাষা, সাহিত্য, ইতিহাস, ভূগােল, বিজ্ঞান, নৃত্য, সংগীত, শিল্পকলা, নাটক সব কিছুর শিক্ষা দিতে হবে। এ ছাড়া ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় ঘটাতে সংস্কৃত ভাষা, রামায়ণ, মহাভারত, উপনিষদের বাণী পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

গান্ধিজি শিশুর জীবনের সম্পূর্ণ বিকাশের জন্য পাঠক্রম রচনার কথা বলেছেন। পাঠক্রমে জীবনের জন্য প্রয়ােজন এরূপ একটি কারিগরি শিল্পকে (craft) বেছে নেওয়ার কথা বলেছেন। যাকে কেন্দ্র করে শিশুর ইতিহাস, ভূগােল, গণিত ধারণা ইত্যাদি বিষয়ে পাঠলাভ করবে। গান্ধিজি পাঠক্রম প্রণয়নে গ্রামীণ আর্থিক বিকাশের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। শিক্ষার্থী পড়াশােনার মধ্য দিয়ে এসব জিনিস উৎপাদন করবে। যা বিক্রি করে তার ব্যয়ভার কিছুটা লাঘব হবে।

যদিও রবীন্দ্রনাথ তাঁর পাঠক্রম পরিকল্পনায় এই তাৎক্ষণিক আর্থিক উপার্জনের কথা বলেননি।

[3] শিক্ষার মাধ্যম : রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধিজি উভয়েই শিক্ষার মাধ্যম মাতৃভাষা হওয়া উচিত এ ব্যাপারে সহমত পােষণ করেছেন। 

[4] শিক্ষণ পদ্ধতি : রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাপদ্ধতির মূলকথা হল সক্রিয়তা এবং শিক্ষার্থীর সঙ্গে প্রকৃতির প্রত্যক্ষ সংযােগ। গান্ধিজি পুথিকেন্দ্রিক শিক্ষাপদ্ধতির কঠোর সমালােচনা করেছেন। তাঁর মতে শিক্ষা একটি হস্তশিল্পকেন্দ্র করে গড়ে উঠবে এবং এর সাহায্যে শিশু বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞানার্জন করবে। তাঁর শিক্ষণপদ্ধতি হল—অনুবন্ধ প্রণালী।

[5] শৃঙ্খলা সম্পর্কে অভিমত : শৃঙ্খলার ক্ষেত্রে কবিগুরু প্রকৃতিবাদের সমর্থক। শিশুকে অবাধ স্বাধীনতা দিতে হবে। ফলে তার মধ্যে সৃষ্টি হবে শৃঙ্খলা, এবং তার চিন্তা ও বিচার শক্তির উন্মেষ ঘটবে।

গান্ধিজি আত্মসংযম-এর ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। শিশুরা নিজের ইচ্ছানুযায়ী চলবে এটা তিনি চাননি। কোনটা করা উচিত এবং কোনটা করা উচিত নয় শিক্ষক তা শিক্ষার্থীদের বােঝাবেন। 

[5] শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক : রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধিজির উভয়ের দৃষ্টিভঙ্গিতে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সম্পর্ক হবে সুমধুর। শিক্ষক যেমন শিক্ষার্থীকে পুত্রের ন্যায় স্নেহ করবেন, শিক্ষার্থীও তেমনি শিক্ষককে পিতার ন্যায় শ্রদ্ধা করবে।

রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধিজি উভয় শিক্ষাবিদের শিক্ষা পরিকল্পনায় সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্য যাই থাকুক না কেন — সমগ্র জাতির শিক্ষাবিস্তারে তাঁদের পরিকল্পনা নতুন পথের দিশা দেখিয়েছে।

Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।

Leave a Comment