দেশপ্রেম বনাম বিশ্বপ্রেম – মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা
উত্তর:
দেশপ্রেম বনাম বিশ্বপ্রেম
“জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী”—জননী এবং জন্মভূমি স্বর্গের থেকেও মহৎ। মায়ের মতােই জন্মভূমি বা স্বদেশের প্রতিও মানুষ নাড়ির টান অনভব করে। নিজের দেশকে ভালােবাসে না, এমন মানুষ চিরকালই নিন্দার যােগ্য। নিজের দেশ, তা যেমনই হােক না কেন, তা আমাদের সকলের কাছেই অতি প্রিয়। এই অনুভব থেকেই দ্বিজেন্দ্রলাল রায় লিখেছিলেন, “এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি সকল দেশের রানি সে যে আমার জন্মভূমি।” জন্মভূমির ধারণাটি যখন আরও বহুগুণ প্রসারিত হয়, তখন মানুষ এই নিখিল বিশ্বকেই তার জন্মভূমি বলে মনে করে। অন্তহীন মহাকাশে ভাসমান অসংখ্য গ্রহনক্ষত্রের মাঝে পৃথিবী নামক গ্রহটিই তার জন্মভূমি হয়ে ওঠে। তখন রাষ্ট্রসীমানায় আবদ্ধ বিশেষ কোনাে দেশের প্রতি তার অনুরাগ সীমাবদ্ধ থাকে না, তা প্রসারিত হয় সমগ্র বিশ্বে। দেশপ্রেম অপেক্ষা বড় হয়ে ওঠে বিশ্বপ্রেম।
দেশপ্রেম একটা বিশেষ আবেগ। যুগ যুগ ধরে নানা দেশের মানুষ এই আবেগ অনুভব করে আসছে। দেশকে ভালােবেসে প্রাণ দিতেও কুণ্ঠাবােধ করে না মানুষ। বিভিন্ন দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের পাতা ওলটালেই দেখতে পাওয়া যায়, দেশপ্রেমকে সম্বল করে প্রাণ দিয়েছে অজস্র মানুষ। ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাস পর্যালােচনা করলেও আমরা দেখতে পাই শত শত সংগ্রামী নির্ভয়ে এগিয়ে গেছে পুলিশের বন্দুকের সামনে, হাসিমুখে গলায় পরেছে ফাঁসির দড়ি। আসলে ভালােবাসা যদি অকৃত্রিম হয়, তাহলে সেই ভালােবাসার জন্য জীবন বিপন্ন করতেও আমরা কোনাে দ্বিধা থাকে না। তবে দেশপ্রেম মানেই যে কেবল জীবন বিসর্জন দেওয়া, তা নয়। দেশের প্রতি ভালােবাসার প্রকাশ নানাভাবে ঘটতে পারে। জীবনানন্দের মতাে কবি যখন বলেন, “আবার আসিব ফিরে ধানসিড়িটির তীরে এই বাংলায়” কিংবা অতুলপ্রসাদ বলেন, “ভারত আবার জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে”, তখনও কিন্তু গভীর দেশপ্রেমের পরিচয়ই ফুটে ওঠে।
দেশপ্রেম চিরকালই মানুষের একটি মহৎ গুণ রূপে বিবেচিত। তবে এই দেশপ্রেম কখনাে কখনাে সংহারমূর্তিও ধারণ করতে পারে। নিজের দেশকে ভালােবাসতে গিয়ে যদি কোনাে দেশপ্রেমিক অন্য দেশের প্রতি অসহিষ্ণুতা প্রদর্শন করে, তাহলে তা নিঃসন্দেহে আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বর্তমান পৃথিবীতেও অনেক সময় দেশপ্রেমের এই উগ্র রুপ চোখে পড়ে। এই দেশপ্রেম সংকীর্ণ। স্বদেশের প্রতি অনুরাগ যদি অন্য দেশের প্রতি বিদ্বেষ জাগিয়ে তােলে তাহলে সেই স্বদেশানুরাগ পৃথিবী থেকে যত দ্রুত বিলুপ্ত হয় ততই ভালাে।
সংকীর্ণ দেশপ্রেম পৃথিবীর বুকে সৃষ্টি করে গভীর সংকট। কিন্তু মানুষ যদি নিজের দেশকে ভালােবাসার সঙ্গে সঙ্গে অন্য দেশের প্রতিও সশ্রদ্ধ মনােভাব পােষণ করে তাহলে তা অত্যন্ত মঙ্গলের। পদেশ সম্পর্কে সহিষ্ণুতা ও উদারতা থাকলে দেশপ্রেম থেকে বিশ্বপ্রেমে উত্তরণ সম্ভব। আর দেশপ্রেম যদি কেবল নিজের দেশকে নিয়ে উগ্র উন্মাদনার সৃষ্টি করে তবে তা হয়ে ওঠে বিশ্বপ্রেমের অন্তরায়। নিজের দেশকে নিয়ে মত্ততাবশত অন্য দেশের প্রতি যে অবহেলা, তাতে বিশ্বজুড়ে লড়াইয়ের মনােভাবই প্রশ্রয় পায়।
দেশ বা রাষ্ট্রের সীমানা নিয়ে যে বিদ্বেষ বা যুদ্ধ তা সম্পূর্ণ অর্থহীন। মানুষকে যদি আমরা দেশ-জাতি-ভাষার গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ না রেখে শুধু মানুষ হিসেবে বিচার করি, তাহলে বিশ্বের সমস্ত মানুষকেই আমরা আপন ভাবতে পারি। কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত বলেছেন, “জগৎ জুড়িয়া এক জাতি আছে, সে জাতির নাম মানুষ জাতি/এক পৃথিবীর স্তন্যে লালিত একই রবি-শশী মমাদের সাথী।” এই ভাবনা মনের মধ্যে স্থান পেলে সমস্ত সংকীর্ণতার অবসান ঘটতে বাধ্য। তখন সকলেরই মনে হবে, সমগ্র পৃথিবী আমার দেশ, আমি সমগ্র মানবজাতির অংশ, সমস্ত মানুষ আমার নিকট আত্মীয়। দেশপ্রেমের থেকেও বিশ্বপ্রেম অনেক মহৎ। তাই বিশ্বপ্রেমই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত।
জ্ঞানবিজ্ঞানের নানা শাখায় মানুষ অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছে। তার গতিবিধি আজ পৃথিবী ছাড়িয়ে গ্রহান্তরে বিস্তৃত। তবু অনেক ক্ষেত্রে এখনও আমরা অনেক সংকীর্ণতা কাটিয়ে উঠতে পারিনি। উগ্ৰ অসহিষ্ণু দেশপ্রেম তার মধ্যে একটি। তবে হতাশ হওয়ারও কিছু নেই। বিভিন্ন দেশের বহু মানুষের কণ্ঠে শােনা যাচ্ছে বিশ্বপ্রেমের বাণী। আমাদের বিশ্বাস, একদিন না একদিন মানুষের মন থেকে টুকরাে টুকরাে দেশের সীমানা মুছে যাবে, লুপ্ত হবে জাতিভেদ। আমরা সবাই তখন পৃথিবী নামক একটি গ্রহের বাসিন্দা হব।
আরো পড়ুন
বিজ্ঞাপন ও আধুনিক জীবন | মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা
সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরােধে ছাত্রসমাজের ভূমিকা | মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা
বিজ্ঞান আশীর্বাদ না অভিশাপ | মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা
ছাত্রজীবনে সৌজন্য ও শিষ্টাচার | মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা
নিরক্ষরতা দূরীকরণে ছাত্রসমাজ | মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা
Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।