ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে কী বােঝ? ভারতে ধর্মনিরপেক্ষতার বিষয় সম্পর্কে আলােচনা কর Class 12 | Sociology (সাম্প্রতিক কালের সামাজিক বিচার্য বিষয়) | 8 Marks
উত্তর:
১৯৭৬ সালের ৪২-তম সংশােধনী আইনে ধর্মনিরপেক্ষ’ শব্দটি ভারতের সংবিধানের প্রস্তাবনায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থসংবিধানের কোথাও ব্যাখ্যা করে বলা হয় নি। সমাজবিজ্ঞানীদের মতানুসারে ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণার মূলে পশ্চিমী মতাদর্শ বর্তমান।
এক সময়ে ইউরােপে সব রকম সম্পত্তির উপর চার্চের পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ছিল। চার্চের সম্মতি ব্যতিরেকে সম্পত্তির ব্যবহার করা যেত না। কালক্রমে কিছু বুদ্ধিজীবী এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে মুখর হন। এই বুদ্ধিজীবীরাই ‘ধর্মনিরপেক্ষ’হিসাবে চিহ্নিত হন। সুতরাং ধর্মনিরপেক্ষতা’কথাটি প্রথম ব্যবহৃত হয়েছে ইউরােপে। এই সময় ইউরােপে ধর্মনিরপেক্ষ বলতে চার্চ থেকে স্বতন্ত্র’বা চার্চের বিরােধী এই ধারণা বােঝাতাে। আভিধানিক অর্থে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ বলতে ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক বিষয়াদির সঙ্গে সম্পর্করহিত বিষয়কে বােঝানাে হয়।
পশ্চিমী অর্থে ধর্মনিরপেক্ষতা : ধর্মনিরপেক্ষতা সম্পর্কিত পশ্চিমী ধারণা হল সংকীর্ণ। পশ্চিমী ধারণা অনুযায়ী বা সংকীর্ণ অর্থে ধর্মনিরপেক্ষতা হল ধর্মের সঙ্গে সম্পর্কহীনতা’ (absence of connection with religion)। এ দিক থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে বােঝায় সাধারণ জীবনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র থেকে ধর্মকে পৃথক রাখা (to isolate religion from the more significant areas of common life)
সংকীর্ণ অর্থে ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ গৃহীত হয় নি : ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনায় ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ ঘােষণা করা হয়েছে। বস্তুতঃ বরাবরই ভারত হল একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। এই ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ এই নয় যে, ভারত-রাষ্ট্র ধর্মবিরােধী বা এদেশে ধর্মের কোনও স্থান নেই। | মহাত্মা গান্ধীর ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণার মূলকথা হল ধর্মীয় জনসম্প্রদায়সমূহের মধ্যে পারস্পরিক সৌভ্রাতৃত্বের ব্যাপারে আন্তরিক অঙ্গীকার। এই অঙ্গীকার সত্যের জন্য শ্রদ্ধার উপর প্রতিষ্ঠিত। পণ্ডিত নেহরুর ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণার মধ্যে বৈজ্ঞানিক মানবিকতাবাদের আদর্শের কথাই বেশী।
ব্যাপক ও ভারতীয় অর্থে ধর্মনিরপেক্ষতা : ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ এখানে এই যে, ভারত ধর্মের ব্যাপারে নিরপেক্ষ। এখানে কোন বিশেষ ধর্মকে রাষ্ট্রীয় ধর্মের মর্যাদা দেওয়া হয় নি। বলা হয় যে, ধর্ম মানুষের অন্তরের বিষয়। কিন্তু রাষ্ট্রের কাজ হল মানুষের সামাজিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ক নিয়ন্ত্রণ। বিভিন্ন ব্যক্তি ও গােষ্ঠী তার নিজ নিজ বিবেক ও বিশ্বাস অনুসারে, তাদের স্বতন্ত্র অন্তরের আকুতি অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন ধর্মাচরণ করে।
কোন ধর্মীয় ব্যাপারে রাষ্ট্র ব্যক্তিগত ও গােষ্ঠীগত ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার স্বীকার করবে এবং মানুষকে ধর্মীয় বিবেচনা ছাড়াই কেবল মানুষ হিসাবে গণ্য করবে। রাষ্ট্রের কাজকর্ম মানুষের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বিষয় নিয়ে, মানুষের ধর্ম বা বিশ্বাসকে নিয়ে নয়। মানুষের ধর্ম বা বিশ্বাস সম্পর্কে রাষ্ট্রের কোন দায়দায়িত্ব নেই। ধর্মবিশ্বাস মানুষের সম্পূর্ণ নিজস্ব ও ব্যক্তিগত ব্যাপার। রাষ্ট্র বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে নিরপেক্ষতা বজায় রেখে চলবে। আম্বেদকর (Ambedkar)-এর মতানুসারে ধর্মনিরপেক্ষতার মূল অর্থ রাষ্ট্র জনগণের উপর কোন ধর্ম জোর করে চাপিয়ে দেবে না। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র গঠনের জন্য জনগণের ধর্মীয় স্বাধীনতার প্রয়ােজন। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে সকলকেই সমানভাবে ধর্ম ও বিবেকের স্বাধীনতা দিতে হবে।
ভারতে ধর্মনিরপেক্ষতা (Secularism in India)
স্বাধীনতা প্রাপ্তির অনেক আগে থেকেই ভারতবর্ষে বিভিন্ন ধর্ম ও ধর্মীয় সম্প্রদায় বর্তমান। স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর ভারতে বিভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্নভাবে ধর্মনিরপেক্ষ’ কথাটিকে ব্যবহার করা হয়েছে। স্বাধীন ভারতের। সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা সুনিশ্চিত করার জন্য তিনটি বিষয়ে গুরুত্ব আরােপ করা হয়েছে—
i) ধর্ম স্বীকার ও প্রচারের ব্যাপারে প্রত্যেক নাগরিকের পরিপূর্ণ স্বাধীনতা থাকবে।
(ii) রাষ্ট্রের কোন ধর্ম থাকবে না এবং
(iii) ধর্ম বিশ্বাস যাই হােক না কেন সকল নাগরিক হবে সমান।
এইভাবেঈশ্বর বিশ্বাসীদের মত অজ্ঞাবাদীদেরও সমানাধিকার প্রদান করা হল। বস্তুত ভারত বিভাগের পর এ দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে বিশেষত মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্পূর্ণ আস্থার ভাব সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে সমকালীন ভারতের জননেতারা বিশেষভাবে উদ্যোগী হয়েছিলেন যাতে তাদের মধ্যে এই বােধ। সচ্ছুরিত হােক যে, ভারত তাদের দেশ এবং এখানে তাদের বিরুদ্ধে কোন বৈষম্যমূলক আচরণ ঘটবে না।
ব্যক্তির ধর্মের স্বাধীনতা : ভারতীয় সংবিধানের ২৫ থেকে ২৮—এই চারটি ধারায় ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার সম্পর্কে উল্লেখ আছে। সংবিধানের ২৫ ধারা অনুসারে সকল ব্যক্তিই সমানভাবে বিবেকের স্বাধীনতা অনুসারে ধর্মস্বীকার, ধর্মাচরণ এবং ধর্ম প্রচারের স্বাধীনতা ভােগ করবে। ব্যক্তি তার বিবেক অনুসারে ধর্মমত অবলম্বন করার অধিকার ছাড়াও ধর্মীয় অনুশাসন অনুসারে বাহ্যিক আচার-অনুষ্ঠান পালন করার এবং ধর্মীয় মতামত প্রচার করার অধিকারও ভােগ করবে [রতিলাল বনাম মুম্বাই (বােম্বাই) রাজ্য সরকার (১৯৫৪)]। রাষ্ট্র সাধারণত কোন ধর্মীয় বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবে না। কিন্তু কোন বিশেষ আচার-অনুষ্ঠান নির্দিষ্ট কোন ধর্মের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ কিনা আদালত তা নির্ধারণ করতে পারবে [হানিফ কুরেশি বনাম বিহার রাজ্য (১৯৫৮)
ধর্মীয় স্বাধীনতা অবাধ নয় : এই অধিকারটি অবাধ বা নিরঙ্কুশ নয়। জনশৃঙ্খলা, সদায় জনস্বাস্থ্য ও অন্যান্য মৌলিক অধিকার সংরক্ষণের স্বার্থে রাষ্ট্র এই অধিকারটির উপর বিধিনিষেধ তাতে করতে পারে। তা ছাড়া রাষ্ট্র ধর্মাচরণের সঙ্গে জড়িত যে-কোন অর্থনৈতিক (economic), বৈত্তিক (financials রাজনৈতিক (Political) বা ধর্মনিরপেক্ষতা (secular) সম্পর্কিত কার্যকলাপকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে [২৫(১) (ক) ধারা ]। আবার সামাজিক কল্যাণ, সামাজিক সংস্কারসাধন বা জনপ্রতিনিধিমূলক হিন্দু ধর্ম-প্রতিষ্ঠানগুলিতে সকল শ্রেণীর হিন্দুদের প্রবেশাধিকারের জন্য রাষ্ট্র আইন প্রণয়ন করতে পারে। [২৫(২) (খ) ধারা। “হিন্দ বলতে শিখ, বৌদ্ধ এবং জৈন ধর্মাবলম্বীদেরও বােঝাবে। শিখ ধর্মের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসাবে শিখগণ কথar ধারণ ও বহন করতে পারবে।
ধর্মীয় সম্প্রদায়ের অধিকার : বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়কেও কতকগুলাে অধিকার দেওয়া হয়েছে। সংবিধানের ২৬ ধারা অনুসারে প্রত্যেক ধর্মীয় সম্প্রদায় বা গােষ্ঠী (ক) ধর্ম ও দানের উদ্দেশ্যে সংস্থা স্থাপন ও রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারবে; (খ) ধর্মীয় বিষয়ে নিজ নিজ কার্যাবলী পরিচালনা করতে পারবে; (গ) স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি অর্জন করতে ও মালিক হতে পারবে এবং (ঘ) আইন অনুসারে সেই সম্পত্তি পরিচালনা করতে পারবে। তবে জনশৃঙ্খলা, নৈতিকতা এবং জনস্বাস্থ্যের কারণে রাষ্ট্র ধর্মীয় সম্প্রদায়ের উপরিউক্ত অধিকারগুলি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। কোন ধর্মসম্প্রদায় তত্ত্বাবধানের অধিকারের অজুহাতে কোন সভ্যকে একঘরে বা ধর্মসম্প্রদায় থেকে বহিষ্কার করতে পারে না [তাহের বনাম তায়ে ভাই (১৯৫৩)
বিশেষ ধর্মের উপর কর আরােপ নিষিদ্ধ : কোন বিশেষ ধর্ম বা ধর্মসম্প্রদায়ের প্রসার বা রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কোন সম্প্রদায় বা ব্যক্তিকে কর দিতে বাধ্য করা যাবে না (২৭ ধারা)। ধর্মবিষয়ে নিরপেক্ষতাকে নিশ্চিত করার জন্য বর্তমানে এই জাতীয় কর আরােপ নিষিদ্ধ হয়েছে। তা ছাড়া ২৭ ধারার আর একটি উদ্দেশ্য হল এক ধর্মসম্প্রদায়ের অত্যাচার থেকে অন্য সম্প্রদায়কে রক্ষা করা।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মশিক্ষা : শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে ধর্মশিক্ষা সম্পর্কে সংবিধানে কিছু বিধিনিষেধ আরােপ করা হয়েছে। সংবিধানের ২৮ ধারায় এ বিষয়ে প্রয়ােজনীয় নিয়ম-নিষেধের উল্লেখ আছে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলিকে তিনভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। (১) পুরােপুরি সরকারী অর্থে পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মশিক্ষা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। অর্থাৎ সরকারী শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে ধর্মশিক্ষা দান একেবারে নিষিদ্ধ। (২) কিন্তু সরকার কর্তৃক স্বীকৃত বা সরকারী অর্থে আংশিকভাবে পরিচালিত শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে ধর্মশিক্ষা দান একেবারে নিষিদ্ধ হয় নি। তবে প্রাপ্তবয়স্ক শিক্ষার্থীদের নিজেদের এবং অপ্রাপ্তবয়স্ক শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে অভিভাবকের সম্মতি দরকার। (৩) সম্পূর্ণ বেসরকারী শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে ধর্মশিক্ষা দান সম্পর্কে কোন বিধিনিষেধ আরােপ করা হয় নি। কোন দাতা বা অছি কর্তৃক ধর্মশিক্ষার উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রের দ্বারা পরিচালিত হলেও সেখানে বাধ্যতামূলক ধর্মশিক্ষা দেওয়া যাবে।
সংবিধানে উল্লিখিত ব্যবস্থাদির মাধ্যমে নাগরিকদের ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকারকে কার্যকর করার চেষ্টা করা হয়েছে। পূণ্যভূমি ভারতে সকল ধর্মই সমান। বিভিন্ন ধর্ম ও ধর্মীয় গােষ্ঠীর মধ্যে সদ্ভাব ও সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য ভারতে ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ স্বীকার ও কার্যকর হয়েছে। রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরােপের জন্যই ১৯৭৬ সালে ৪২-তম সংবিধান সংশােধনের মাধ্যমে প্রস্তাবনায় ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শব্দটি যুক্ত করা হয়েছে।
ভারতে কোন সরকারী ধর্ম নেই, এখানে ধর্মীয় কারণে কোন কর আরােপ করা হয় না, ধর্মীয় ভিত্তিতে বৈষম্যমূলক আচরণ নিষিদ্ধ, কোন বিশেষ ধর্ম অবলম্বনের জন্য, কাউকে কোন অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়। না, জনজীবনে সকলের অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে সাম্য বর্তমান প্রভৃতি। সংখ্যালঘু জনসম্প্রদায়সমূহের স্বার্থ সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে বিশেষ সাংবিধানিক বিধি-ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। ভারতে বহু ও বিভিন্ন ধর্মীয় সংখ্যালঘু গােষ্ঠী বর্তমান। এই সমস্ত ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পাশাপাশি অবস্থান ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ প্রকৃতিকে সুসংহতভাবে প্রতিপন্ন করে। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসাবে ভারত ধর্মীয় ও ভাষাগত সংখ্যালঘুদের স্বাভাবিক অভিভাবক হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।