বাংলা বইয়ের দুঃখ – উচ্চমাধ্যমিক বাংলা প্রবন্ধ রচনা

প্রিয় ছাত্রছাত্রীরা, এখানে আমরা বাংলা বইয়ের দুঃখ – উচ্চমাধ্যমিক বাংলা প্রবন্ধ রচনা নিয়ে আলোচনা করলাম। খুব সুন্দর করে গুছিয়ে এই প্রবন্ধ রচনাটি লেখা হয়েছে। আশা করি তোমাদের সবারই ভালো লাগবে। ধন্যবাদ

বাংলা বইয়ের দুঃখ

সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বিষাদ, বিপদে-সম্পদে যে সর্বক্ষণের সঙ্গী, সে-ই প্রকৃত বন্ধু। বই আমাদের তেমনই এক বন্ধু। সব যুগের, সব দেশের মানুষের জ্ঞান- বিদ্যা-অভিজ্ঞতা এবং তার আবেগ-অনুভূতি আশা-আকাঙ্ক্ষা দুঃখ-বেদনার নানা ভাষ্য, নানা প্রতিলিপি বিধৃত আছে বইয়ের মধ্যে। মানবমনের বহুধা- বিচিত্র চিন্তা-চেতনার বিস্তৃত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ আমরা পাই বইয়ের দুই মলাটের মধ্যেই। এ কারণেই স্বশিক্ষিত ও সুশিক্ষিত, চিন্তাশীল, সংবেদনশীল মানুষের কাছে বই সুসময়-দুঃসময়ের সুহৃদ, একাকিত্বের অবলম্বন।

একজন অভিজ্ঞ ও জ্ঞানী বন্ধুর মতো বইও মানুষকে অভিজ্ঞ ও জ্ঞানী করে তোলে। তবে বহুদিনের পুরোনো বন্ধু বিশ্বাসঘাতকতা করলেও বই কখনোই বিশ্বাসঘাতকতা করে না। সে কখনও প্রতিদানও চায় না। ক্ষুদ্র স্বার্থ মানুষের সঙ্গে মানুষের বন্ধুত্বে চিড় ধরাতে পারে। অনেকদিনের বন্ধুত্ব ব্যক্তিস্বার্থের কারণে চরম শত্রুতায় পর্যবসিত হয়েছে এমন দৃষ্টান্ত মানবসমাজে কম দেখা যায় না। কিন্তু মূক ও অচেতন পদার্থ বই সম্বন্ধে এ কথা একেবারেই প্রযোজ্য নয়। কারণ, বই সবসময়েই সুজন বন্ধুর মতো তার উদার প্রাঙ্গণে আমাদের আহ্বান করে ভাববন্ধনে বাঁধবার জন্য।

তবে আমাদের যেমন ভালো বন্ধু নির্বাচন করতে হয়, ঠিক তেমনই ভালো বইও বেছে নিতে হয়। এ নিয়ে বিতর্ক থাকলেও এ কথা আমরা সকলেই বিশ্বাস করি যে, যে বই জীবনগঠনে এবং মানসিক বিকাশে সহায়তা করে না, সে বই ভালো বন্ধু হতে পারে না। তেমন বই অবশ্যই পরিত্যাজ্য। তা ছাড়া, সকলের জন্য সব বই-ই উপযোগী নয়। বয়স, অভিজ্ঞতা, শিক্ষা, পরিবেশ-পরিস্থিতি অনুযায়ী গ্রন্থ নির্বাচন করতে হয় মানুষকে।

বই আমাদের অবসর বিনোদনের সঙ্গীও। যে-কোনো বয়সের, যে-কোনো সামাজিক অবস্থার মানুষের কাছে বই অবসরযাপনের শ্রেষ্ঠ উপায় । গল্প- উপন্যাসের বিচিত্র চরিত্রের আশানিরাশা, হাসিকান্না, ভালোমন্দের মধ্যে আমরা সহজেই অবগাহন করি এবং আমাদের মনের প্রতিচ্ছবি আমরা সেখানে খুঁজে পাই। কবিতার জগৎ আমাদের নিয়ে যায় আবেগ ও কল্পনার অমরাবতীতে। প্রবন্ধগ্রন্থ আমাদের জ্ঞানতৃয়া মেটায় ৷

মনুষ্যেতর জীব যেখানে করে জৈবিকতার সাধনা, সেখানে আমরা মানুষ করি মানবিকতার সাধনা। এ কারণেই আমরা আহার-নিদ্রাতে তৃপ্ত থাকতে পারি না। উপনিষদের ব্রত্মজ্ঞানী মৈত্রেয়ীর মতো সহৃদয় মানুষও বাসনা করেন তাই——যেনাহং নামৃতা স্যাম্ কিমহং তেন কুর্যাম্?’ তেমন অমৃতের সন্ধান তাকে দিতে পারে একমাত্র গ্রন্থই।

এ কারণেই প্রমথ চৌধুরি লিখেছেন যে, “বৈঠকখানার দেওয়ালে নানা আকারের, নানা বর্ণের রাশি রাশি বই সাজাইয়া রাখাতে প্রমাণ হয় যে, গৃহকর্তা একাধারে ধনী ও গুণী।” বিলেতে এ কারণেই সকলে বই কেনেন। যিনি বই পড়তে ভালোবাসেন, তিনি যেমন কেনেন, তেমনই যিনি তেমন বই পড়েন না, তিনিও সামাজিকতার দাবিতে বই কেনেন। আমাদের দেশের শিক্ষিত মানুষের সে অভ্যাস নেই। বিলেতে যাঁর বাড়িতে লাইব্রেরি আছে, তিনি অভিজাত হিসেবে পরিচিতি পান। তাই, সেখানে যাঁরা বই কেনেন না, তাঁদের ভাগ্যে জোটে সামাজিক নিন্দা ও অপবাদ। সেখানকার সমাজ মনে করে যে, বই কেনা নাগরিক-কর্তব্য। এ কারণেই বিলেতের ধনী ব্যক্তিদের প্রত্যেকেরই বাড়িতে একটা বড়ো লাইব্রেরি থাকে। কিন্তু আমরা বাঙালিরা দুর্ভাগা জাতি। আমাদের দেশের শিক্ষিত মানুষজনের সঙ্গেও বইয়ের বিশেষ সম্পর্ক থাকে না। পেশাগত কারণে শিক্ষিত বাঙালি তথা ভারতীয়দের যতটা বই পড়া দরকার, ততটাই সে পড়ে, তার বেশি নয়। সৈয়দ মুজতবা আলির ভাষায় বলতে হয়, আমরা শিক্ষিত ভারতবাসী ‘selfish reader, real reader’ নই।

Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।

Leave a Comment