বিজ্ঞাপন ও আধুনিক জীবন – মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা
উত্তর:
বিজ্ঞাপন ও আধুনিক জীবন
“একলা হয়ে দাঁড়িয়ে আছি
তােমার জন্য গলির কোণে
ভাবি আমার মুখ দেখাব
মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে।”
—শঙ্খ ঘােষ
সত্যিই মানুষের মুখ এখন বিজ্ঞাপনে ঢাকা পড়ে যায়। এ যুগ যেন বিজ্ঞাপনের যুগ। যেদিকে চোখ যায় শুধু বিজ্ঞাপন আর বিজ্ঞাপন। অনবরত অজস্র বিজ্ঞাপনের হাতছানিতে মানুষ মাঝে মাঝে দিশা হারিয়ে ফেলে। বুঝতে পারে না কোনটা আসল কোন্টা নকল, কোল্টা সত্যি কোন্টা মিথ্যে। বিজ্ঞাপনের বয়ানে প্রতিটি দ্রব্যই শ্রেষ্ঠতম হয়ে উঠতে চায়।
‘বিজ্ঞাপন’ কথাটির অর্থ হল বিশেষরূপে জ্ঞাপন বা প্রচার। কোনাে একটি দ্রব্যের গুণ ও বৈশিষ্ট্য কীরকম তা জানানাে হয় বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে। শুধু তথ্য সরবরাহই উদ্দেশ্য নয়, প্রস্তুতকারক চান তার দ্রব্যটিকেই লােকে কিনুক। সেজন্য প্রত্যেক প্রস্তুতকারক এমনভাবে বিজ্ঞাপন করেন যাতে বাজারে প্রচলিত সমজাতীয় দ্রব্যগুলির মধ্যে তার দ্রব্যটিই শ্রেষ্ঠ বলে বিবেচিত হয়। কেবল দ্রব্য প্রস্তুতকারকরাই যে বিজ্ঞাপন দেন তা নয়, যে-কোনাে ক্ষেত্রে যাঁরাই বিক্রেতার ভূমিকায় অবতীর্ণ তারা সকলেই বিজ্ঞাপনের সুবিধাটুকু নিতে চান। বিক্রেতা ও ক্রেতার মাঝখানে সেতুবন্ধনের কাজ করে বিজ্ঞাপন। সেজন্য বিজ্ঞাপন আজ বাণিজ্যের অন্যতম অঙ্গ। বিপণন বৃদ্ধির সঙ্গে বাড়ছে বিজ্ঞাপন সংস্থার কদর। বিজ্ঞাপন নিয়ে চলছে নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও গবেষণা।
নানা মাধ্যমে বিজ্ঞাপনের রীতি প্রচলিত আছে। সেগুলি হল— (১) সংবাদপত্র ও সাময়িকপত্র, (২) হ্যান্ড-বিল বা প্রচারপত্র, (৩) রেডিয়াে, (৪) টেলিভিশন, (৫) সিনেমা, (৬) রাস্তার মােড়ে, স্টেশনে বা অন্য কোনাে প্রকাশ্য স্থানে টাঙানাে সাইনবাের্ড, (৭) বাড়ির দেয়াল, (৮) যানবাহন। এ ছাড়া ক্রেতাসাধারণের বাড়ি বাড়ি গিয়ে পণ্যদ্রব্যের নমুনা দেখিয়ে বিজ্ঞাপন করার রীতিটিও এখন বেশ প্রচলিত।
বিজ্ঞাপন আজ মানুষের দৈনন্দিন জীবনকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে। পণ্য যেমন প্রচুর, তেমনি বিজ্ঞাপনও অন্তহীন। আর সেইসব বিজ্ঞাপনকে আকর্ষণীয় করে তােলার চেষ্টারও অন্ত নেই। ছড়ায়, ছবিতে, সংলাপে, কাব্যময় গদ্যে কিংবা কখনও নিছক সংক্ষিপ্ত দু-একটি মন্তব্যের মধ্যে দিয়ে বিজ্ঞাপনকে মানুষের মর্মে গেঁথে দেওয়ার অবিরাম চেষ্টা চলেছে। বিভিন্ন বিজ্ঞাপনে মানুষ আকৃষ্ট হয়, কিছু কিছু বিজ্ঞাপন অনেক সময় শিল্পগুণসম্পন্নও হয়ে ওঠে। বিজ্ঞাপনের ভাষা থেকে উঠে আসে অনেক মজাদার মন্তব্য, টুকরাে কৌতুক। আলাপচারিতায় মানুষ কখনাে কখনাে এইসব বিজ্ঞাপনকৌতুকের প্রসঙ্গ উত্থাপন করে যথেষ্ট আনন্দ পায়।
মানুষ প্রতিনিয়ত অজস্র বিজ্ঞাপনের মুখােমুখি হচ্ছে, ফলে তার সামনে আজ নিজের পছন্দ ও চাহিদা অনুযায়ী পণ্য নির্বাচনের প্রচুর সুযােগ। ঘরে বসেই সে স্থির করে নিতে পারে কোন জিনিসটি কিনবে। কিন্তু এখানেই আবার থেকে যায় প্রতারিত হওয়ার আশঙ্কা। বিজ্ঞাপনের জৌলুসে ভুলে অনেকে অনেক সময় নিম্নমানের পণ্য ঘরে নিয়ে আসে। যখন উপলব্ধি হয়। তখন আক্ষেপ ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। বিজ্ঞাপন মানুষের ভােগের স্পৃহাকেও দারুণভাবে বাড়িয়ে দেয়। কেউ কেউ নিজের সামর্থ্যের কথা ভুলে গিয়ে কেবল বিজ্ঞাপনের প্রলােভনে পণ্যসংগ্রহ করতে গিয়ে নিজের সর্বনাশ ডেকে আনে। আবার, কোনাে কোনাে সামর্থ্যহীন মানুষের মনে বিজ্ঞাপন হতাশারও সৃষ্টি করে।
পণ্য প্রস্তুতকারক বা বিক্রেতার লক্ষ্য, যেহেতু মুনাফা, তাই তারা বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে অনেক সময় রুচি বা নৈতিকতাকে তেমন গুরুত্ব দেন না। বিজ্ঞাপনকে অধিক আকর্ষণীয় করার জন্য অনেক ক্ষেত্রে তারা কুরুচি ও অশ্লীলতাকেও প্রশ্রয় দিয়ে থাকেন। বিজ্ঞাপনে এই প্রবণতাটি ইদানীং খুবই বৃদ্ধি পাচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই এর প্রভাব পড়ছে সামগ্রিক জনরুচির উপর। অশ্লীল, উত্তেজক বিজ্ঞাপন বিশেষভাবে প্রভাবিত করছে অল্পবয়সি ছেলেমেয়েদের। বিজ্ঞাপন অনেক ক্ষেত্রে ভুল শিক্ষাও দেয়। বহু বিজ্ঞাপনে ভুল উদ্ধৃতি, ভুল বানান এবং তথ্যের বিকৃতি লক্ষ করা যায়। শােনা যায়, কখনাে কখনাে বিজ্ঞাপনদাতারা নাকি ইচ্ছে করেই বিজ্ঞাপনে কিছু কিছু ভুল রেখে দেন। মানুষের নজর কাড়ার এও এক কৌশল। এতে বিজ্ঞাপনদাতাদের উদ্দেশ্য সফল হলেও হতে পারে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটি এক ধরনের অপরাধ। অল্পবয়সি শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে এই ধরনের বিজ্ঞাপন মারাত্মক হয়ে ওঠে। পরিণত শিক্ষিত মানুষও অনেক সময় এতে বিভ্রান্ত বােধ করেন।
এখন মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে বিজ্ঞাপন যেভাবে জড়িয়ে গেছে, তাতে বিজ্ঞাপনদাতাদের দায়িত্বও বেড়ে গেছে অনেকখানি। শুধু মুনাফার দিকে তাকিয়ে বিজ্ঞাপনকে ব্যবহার করলে চলবে না। বিপণনও নীতিবহির্ভুত কিছু নয়। ক্রেতাসাধারণকে প্রতারিত করে সাময়িকভাবে বেশি লাভ করা গেলেও পরিণামে তার ফল হয় অত্যন্ত খারাপ। বিজ্ঞাপন পরিবেশনের ক্ষেত্রে নীতির সঙ্গে সুরুচিও যাতে প্রাধান্য পায়, নির্ভুল হয় বিজ্ঞাপনের ভাষা, সে বিষয়ে প্রত্যেক বিজ্ঞাপনদাতাকে বিশেষভাবে সচেতন হতে হবে। মনে রাখতে হবে, শেষপর্যন্ত মানুষ সত্য ও সুন্দরকেই বেশি মূল্য দেয়। প্রতারক চিরকালই ঘৃণা ও প্রত্যাখ্যানের পাত্র।
আরো পড়ুন
প্রয়াত বাঙালি রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখােপাধ্যায় – জীবনীমূলক প্রবন্ধ রচনা
দেশপ্রেম বনাম বিশ্বপ্রেম | মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা
সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরােধে ছাত্রসমাজের ভূমিকা | মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা
বিজ্ঞান আশীর্বাদ না অভিশাপ | মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা
ছাত্রজীবনে সৌজন্য ও শিষ্টাচার | মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা
Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।