ভারতে সাম্প্রদায়িকতার মৌলিক কারণ সমূহ বর্ণনা কর

ভারতে সাম্প্রদায়িকতার মৌলিক কারণ সমূহ বর্ণনা কর Class 12 | Sociology (সাম্প্রতিক কালের সামাজিক বিচার্য বিষয়) | 8 Marks

উত্তর:

ভারতে সাম্প্রদায়িকতার মৌলিক কারণসমূহ :সমাজতত্ত্ববিদ্ৰা সাম্প্রদায়িক উত্তেজনাকে মূলত সামাজিক উত্তেজনা ও আপেক্ষিক বঞ্চনার বিষয় হিসাবে প্রতিপন্ন করার পক্ষপাতী। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের কাছে। সাম্প্রদায়িক সংঘাত হল ক্ষমতার জন্য সংগ্রামেরই রকমফের। ধর্মীয় বিশেষজ্ঞরা সাম্প্রদায়িক সংঘাতকে জঙ্গী মৌলবাদী ও অনুগামীদের উষ্ণীষ হিসাবে বিচার-বিবেচনা করে থাকেন। ভারতে সাম্প্রদায়িকতার উদ্ভব ও বিকাশের পিছনে বহু ও বিভিন্ন কারণ বর্তমান।

(১) ব্রিটিশ রাজত্বের উত্তরাধিকার সূত্রে সাম্প্রদায়িকতা : সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ সরকার ভারতে তাদের ঔপনিবেশিক শাসন-শােষণ অব্যাহত রাখার স্বার্থে মুসলিম সাম্প্রদায়িকতা ও বিচ্ছিন্নতাবাদকে প্রশয় দিয়েছে।

(২) ভৌগােলিক কারণ হিন্দু, মুসলমান, শিখ, খ্রিস্টান প্রভৃতি জনগােষ্ঠীগুলি বিচ্ছিন্নভাবে বসবাস। করলে সাম্প্রদায়িক আবেগ-উত্তেজনার আশংকা অনিবার্য হয়ে পড়ে। ভারতে এই সমস্ত ধর্মীয় জনগােষ্ঠীগুলি স্বতন্ত্র এলাকায় বিচ্ছিন্নভাবে বসবাস করে। তারফলে সাম্প্রদায়িক ভুল বােঝাবুঝি ও উত্তেজনা দেখা দেয়।

(৩) ঐতিহাসিক কারণ : ভারতে সাম্প্রদায়িকতার পিছনে কিছু কারণ ঐতিহাসিক প্রকৃতির। ইতিহাসগত ১০৯সুত্রে প্রতিষ্ঠিত সত্য হল যে, বিদেশী শক্তি হিসাবে ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা ভারতে এসেছে এবং তরবারি। উচিয়ে এ দেশের হিন্দুদের ইসলামে ধর্মান্তরিতকরণের সূত্রপাত করেছে। মুসলমান শাসকদের অনেকেই হিন্দুদের উপর অন্যায়-অত্যাচার চালিয়েছে। অনুরূপভাবে আবার কিছু হিন্দু নৃপতিও মুসলমান শাসকদের অন্যায় আচরণের বদলা নিয়েছে মুসলমান সম্প্রদায়ের উপর।

(4) আর্থ-সামাজিক ও রাজনীতিক সমস্যাদি : ভারতে সাম্প্রদায়িকতার বিকাশ ও বিস্তারের পিছনে আর্থ-সামাজিক সমস্যাদি সাহায্য করেছে। স্বাধীন ভারতের রাষ্ট্রব্যবস্থা ও রাষ্ট্রীয় নীতি অ-সাম্প্রদায়িক। এ বিষয়ে দ্বি-মতের অবকাশ নেই। কিন্তু স্বাধীন ভারতের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা ও অবস্থা সাম্প্রদায়িকতার বিকাশ ও বিস্তারের সহায়ক বলে বিবেচিত হয়। 

(৫) সামাজিক কারণ : সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টির ক্ষেত্রে কিছু সামাজিক কারণসমূহের ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়াকে অস্বীকার করা যায় না। মুসলমানরা গরু কাটে। এতে হিন্দুদের ধর্মীয় ভাবনা অতিমাত্রায় আহত হয়। ধর্মীয় স্বাতন্ত্রের কারণে মুসলমান পরিবারের সঙ্গে হিন্দু পরিবারের নিবিড় কোনাে সামাজিক সম্পর্ক গড়েওঠার পথে প্রতিবন্ধকতা আছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে ও বিষয়ে হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষজনের মধ্যে আচার-বিচার, ক্রিয়াকর্ম ও জীবনধারাগত বৈপরীত্য বর্তমান। এই বৈপরীত্য সম্প্রদায় দুটির মধ্যে সামাজিক সম্পর্ক সৃষ্টির ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হিসাবে প্রতিপন্ন হয়।

(৬) মনস্তাত্ত্বিক কারণ : হিন্দু ও মুসলমান, এই দুই সম্প্রদায়ের পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাস ও ঘৃণার মনােভাব অল্পবিস্তর বর্তমান। এই মনােভাব মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে সাম্প্রদায়িক সংঘাত-সংঘর্ষের সৃষ্টি হয়।

(৭) রাজনীতিক সুবিধাবাদ জনসমর্থন, রাজনীতিক ক্ষমতা ও সরকারি পদ পাওয়ার বাসনাকে চরিতার্থ করার জন্য রাজনীতিক দল ও নেতারা সাম্প্রদায়িক শক্তির সাহায্য নিতে কিছুমাত্র দ্বিধাবােধ করেন

(৮) নেতাদের কায়েমী স্বার্থ : ভারতের রাজনীতিক ব্যবস্থায় সাম্প্রদায়িকতার বিকাশ ও বিস্তারের পিছনে জননেতাদের কায়েমী স্বার্থের অবদান অনস্বীকার্য। এ দেশের রাজনীতিক নেতারা সংকীর্ণ, ব্যক্তিগত, গােষ্ঠীগত ও দলগত স্বার্থসাধনের জন্য ভাষা, ধর্ম ও আঞ্চলিকতার ক্ষেত্রে মানুষের আবেগকে অপব্যবহার করেন।

(৯) ইতিহাসের সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি রােমিলা থাপার, বিপান চন্দ্র ও হরবক্স মুখিয়া প্রমুখ। প্রথিতযশা ইতিহাসবিদের মতানুসারে স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি এদেশে সাম্প্রদায়িকতার তাত্ত্বিক ভিত্তি প্রস্তুত করেছে। ভারতের ইতিহাসকে ধর্মীয় বা সাম্প্রদায়িক বিচার-বিবেচনার ভিত্তিতে কতকগুলি অধ্যায়ে বিভক্ত করা হয়েছে। ভারত-ইতিহাসের সম্প্রদায়গত বিভাজনের উদাহরণ হিসাবে হিন্দু ইতিহাস, মুসলিম ইতিহাস, শিখ ইতিহাস প্রভৃতির কথা বলা যায়। ইতিহাসের এ ধরনের অধ্যায়-বিভাজন। সাম্প্রদায়িকতার চেতনাকে সুদৃঢ় করে।

(১০) সাম্প্রদায়িক সংবাদপত্র : ভারতের কিছু গণমাধ্যম ও পত্র-পত্রিকার সাম্প্রদায়িক প্রকৃতি ও ভূমিকা সুবিদিত। এই সমস্ত পত্র-পত্রিকা ও গণমাধ্যম দেশের সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলিকে অধিকতর শক্তি সংগ্রহে সাহায্য করে।

(১১) নিরাপত্তাহীনতা ও সংশয়-সন্দেহ : যারা সাম্প্রদায়িকতার শিকার হয় তাদের মধ্যে ভয়, নিরাপত্তাহীনতা ও সংশয়-সন্দেহের সৃষ্টি হয়। এই মানসিকতা মানুষকে সাম্প্রদায়িক করে তােলে। 

১২) সাম্প্রদায়িক উদ্দেশ্যে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ব্যবহার মঠ-মন্দির, মসজিদ, গির্জা, গুরুদ্বার প্রভৃতি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান হল পূজা-পাঠ ও উপাসনার জায়গা। অথচ সাম্প্রতিককালে এই সমস্ত ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। সাম্প্রদায়িক শক্তিসমূহের গুপ্ত আখড়ায় পরিণত হয়েছে। | 

(১৩) ধর্মগুরুদের ভূমিকা : ভারতীয়দের মধ্যে সাম্প্রদায়িক চেতনাকে উজ্জীবিত করার ক্ষেত্রে এ দেশের ধর্মগুরুদের দায়িত্ব কম নয়। অনেক ক্ষেত্রে সাধু-সন্ন্যাসীদের কার্যকলাপ দলীয় নেতাদের রাজনীতিক কার্যকলাপের সামিল হয়ে পড়েছে। ধর্মগুরুরা রাজনীতিবিদদের মত মন্তব্য করছেন বা বক্তব্য রাখছেন। রাজনীতিক কায়দায় মােল্লা-মহন্ত প্রভৃতি ধর্মগুরুরা সাম্প্রতিককালে সাম্প্রদায়িক জঙ্গি আন্দোলনের হুমকি দিচ্ছেন।।

(১৪) সহনশীলতা ও তােষণমূলক নীতি || ভারতের শাসনতান্ত্রিক ইতিহাস পর্যালােচনা করলে দে যাবে যে সাম্প্রদায়িক আচার-আচরণকে সব সময় ধৈর্যসহকারে সহ্য করা হয়েছে এবং তােষণমূলক নী গ্রহণ করা হয়েছে। যে দৃঢ়তার সঙ্গে সাম্প্রদায়িকতার মােকাবিলা করা দরকার ছিল, তা করা হয় নি। বরং মাত্রাতিরিক্ত সহনশীলতা ও আপস-মীমাংসার নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। এর ফল হয়েছে বিপরীত। সাম্প্রদায়িকতার ধারণা পরিপুষ্ট হয়েছে এবং সাম্প্রদায়িক শক্তির গুরুত্ব ও মর্যাদা প্রতিপন্ন হয়েছে।

(১৫) সন্ত্রাসবাদীদের ভূমিকা ॥ সাম্প্রতিককালের রাজনীতিতে মূল্যবােধের অবক্ষয় ঘটেছে। মজুতদার চোরাচালানকারী, চোলাই মদের ব্যবসায়ী, সাট্টা-জুয়ার কারবারী, অবৈধ অস্ত্র ব্যবসায়ী— এদের হাতে এখন অফুরন্ত অর্থ। এরাই এখন রাজনীতিক ক্ষেত্রে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এই গুণ্ডা দাদারা নিজেদের বিশেষ বিশেষ সম্প্রদায়ের শিরােমণি হিসাবে প্রতিপন্ন করে, সাম্প্রদায়িক স্বার্থের রক্ষাকর্তা হিসাবে নিজেদের জাহির করে। এরাই সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার সৃষ্টি করে, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামার পরিস্থিতি সৃষ্টি করে এবং জনজীবনে। সাম্প্রদায়িক অস্থিরতা ও অব্যবস্থার মধ্যে মাতব্বরি করে।

(১৬) গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহের অবক্ষয় || তৃণমূল স্তরে গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহ সুদৃঢ় ও সমৃদ্ধ থাকলে। সাম্প্রদায়িকতার সমস্যা প্রতিহত হতে বাধ্য। কিন্তু ভারতে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহের অতিমাত্রায় অবক্ষয়ের ফলে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে তা দখল করে নিয়েছে সাম্প্রদায়িক শক্তি।

(১৭) ব্রিটিশ আমলের সাম্প্রদায়িক ব্যবস্থা ৷ ব্রিটিশ শাসকরাই ভারতে সাম্প্রদায়িক নির্বাচকমণ্ডলী গঠনের নীতি গ্রহণ ও কার্যকর করেছে। এই সাম্প্রদায়িক নির্বাচনব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ভারতে সাম্প্রদায়িক রাজনীতিক সংগঠনসমূহ গড়ে উঠেছে।

(১৮) বিবিধ বিষয়কে নিয়েও সাম্প্রদায়িক বিরােধ বাধে || (ক) মােরাদাবাদের দাঙ্গার পিছনে আর্থনীতিক কারণ ছিল। ঐতিহ্যগতভাবে এই শিল্পের কারিগররা হল মুসলমান; কিন্তু বিক্রয় ও রপ্তানি বাণিজ্য মূলত হিন্দুদের হাতে। কালক্রমে মােরাদাবাদের কাসা-পিতলের সামগ্রীর রপ্তানি-বাণিজ্যে কিছু মুসলমান ব্যবসায়ী অনুপ্রবেশ করে। তার ফলে হিন্দু রপ্তানিকারকদের মুনাফায় টান পড়ে। আর্থনীতিক স্বার্থের এই দ্বন্দ্ব সাম্প্রদায়িক সংঘাতে পরিণত হয়। (খ) ধর্মীয় উৎসব উদ্যাপনকে কেন্দ্র করেও সাম্প্রদায়িক সংঘাতের সৃষ্টি হয়। (গ) আবার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তিকে নিয়ে হিন্দু-মুসলমানদের ব্যক্তিগত বিরােধ অনেকক্সময় সাম্প্রদায়িক সংঘাতে পরিণত হয়। তেমনি আবার বাচ্চাদের ঘুড়ি ওড়ানাে, ইভটিজিং, দুই মাতালের ঝগড়া—এ রকম নগণ্য বিষয়ের পরিপ্রেক্ষিতেও সাম্প্রদায়িক সংঘাত সৃষ্টি হয়েছে। (ঘ) উপসাগরীয় অঞ্চল ও অন্যান্য দেশ থেকে প্রচুর পরিমাণে অর্থাগমের কারণেও সাম্প্রদায়িক সংঘাতের কারণ সৃষ্টি হয়। সাধারণভাবে বিশ্বাস করা হয় যে, এই টাকা মুসলমান মৌলবাদের বিকাশ ও বিস্তারে ব্যয় করা হয়। (ঙ) ভারতে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টির পিছনে কতকগুলি ঘটনা বা বিষয়ের সংযােগ-সম্পর্কও অনস্বীকার্য। এই বিষয়গুলি হল : অযােধ্যার রাম জন্মভূমি ও বাবরি মসজিদ বিতর্ক; মথুরার কৃষ্ণ জন্মভূমি এবং পার্শ্ববর্তী মসজিদ সম্পর্কিত সমস্যা; বেনারসের কাশী বিশ্বনাথ মন্দির এবং নিকটবর্তী মসজিদ নিয়ে বিতর্ক; পৃথ্বিরাজ চৌহানের আমল থেকে সমভলের মসজিদকে শিব মন্দির হিসাবে দাবি সম্পর্কিত বিতর্ক প্রভৃতি।

Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।

Leave a Comment