মধ্যযুগের হিন্দু শিক্ষা সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলােচনা করাে।

মধ্যযুগের হিন্দু শিক্ষা সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলােচনা করাে।

উত্তর: 

মধ্যযুগের হিন্দু শিক্ষা :

মধ্যযুগের শুরুতে বৈদেশিক মুসলমানদের আক্রমণের ফলে ভারতে প্রাচীন হিন্দু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির প্রায় সবকটি ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। শুধু তাই নয়, ওই সময়কালে হিন্দু শিক্ষাব্যবস্থা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপােষকতা থেকেও বঞ্চিত হয়েছিল। কিন্তু সাধারণ জনগণ প্রাচীন ভারতের ঐতিহ্যসম্পন্ন ব্রাহ্মণ্য ও বৌদ্ধ শিক্ষাকে ত্যাগ করেনি। শাসকগােষ্ঠীর কাছ থেকে আর্থিক সাহায্য না-পেলেও বিত্তবানদের সাহায্যে এবং তীর্থক্ষেত্রগুলিতে পুণ্যার্থীদের প্রদেয় অর্থে প্রাচীন হিন্দু শিক্ষাব্যবস্থা এবং হিন্দু প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার কিছু প্রতিষ্ঠান, যেমন— পাঠশালা, টোল ও চতুষ্পঠীগুলি নিজেদের বৈশিষ্ট্য নিয়েই টিকে ছিল। এখানে মধ্যযুগের হিন্দু শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলি সংক্ষেপে আলােচনা করা হল—

[1] শিক্ষার উদ্দেশ্য : মধ্যযুগের হিন্দু শিক্ষার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল—হিন্দু সংস্কৃতি ও ধর্মের ধারা বজায় রেখে হিন্দু শিশুদের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাদান করা। 

[2] শিক্ষার পাঠকম : পাঠশালাগুলিতে তিন বছরের প্রাথমিক শিক্ষার প্রচলন ছিল। পাঠক্রমের মধ্যে ছিল ভাষা, সাহিত্য, ধর্মশাস্ত্র, গণিত ও প্রাথমিক হিসাবশাস্ত্র। মুলত আবৃত্তির মাধ্যমে পাঠদান করা হত। মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা দেওয়ার জন্য টোল ও চতুষ্পাঠীগুলির পাঠক্রমের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল—বেদ, উপনিষদ, সংস্কৃত ভাষা, সাহিত্য, জ্যোতির্বিজ্ঞান, ভূগােল, গণিত, শারীরতত্ত্ব, ব্যাকরণ, কাব্য ও ছন্দ। 

[3] হিন্দু শিক্ষার প্রতিষ্ঠান : প্রাথমিক শিক্ষার প্রতিষ্ঠান হিসেবে হিন্দু ও জৈন মন্দিরগুলির নিকটবর্তী স্থানে পাঠশালা গড়ে উঠেছিল। পাঠশালাতে ব্রাহ্মণ পণ্ডিত বা মন্দিরের পুরােহিতরা পাঠদান কাজ পরিচালনা করতেন। উচ্চতর শিক্ষাদানের জন্য পাঠশালার পাশাপাশি গড়ে উঠেছিল টোল ও চতুষ্পাঠী। এগুলিতে শিক্ষক হিসেবে থাকতেন ব্রাহ্মণ পণ্ডিতগণ। মধ্যযুগে হিন্দু শিক্ষাবিস্তারের জন্য কাশী, কাঞ্চি, মিথিলা, নবদ্বীপ প্রভৃতি তীর্থস্থানে ও নগরে বহুসংখ্যক টোল ও চতুম্পাঠী গড়ে উঠেছিল। 

[4] শিক্ষক : মধ্যযুগে হিন্দু শিক্ষার ক্ষেত্রে শিশুদের পাঠদানের জন্য মন্দিরের পুরােহিতরাই শিক্ষক হিসেবে কাজ করতেন। বড়াে বড়াে নগরে বা জনপদে যেসব পাঠশালা, টোল এবং চতুষ্পাঠী গড়ে উঠেছিল, সেগুলিতে পাঠদানের জন্য ব্রাহ্মণ পণ্ডিত নিয়ােগ করা হত। 

[5] শিক্ষার ব্যয় বা পৃষ্ঠপােষকতা : মধ্যযুগে হিন্দু শিক্ষার জন্য কোনাে প্রকার রাষ্ট্রীয় অনুদান বা সাহায্য পাওয়া যেত না। মুসলমান শাসকরাও হিন্দু শিক্ষার জন্য কোনাে প্রকার সাহায্য দিতেন না। তবে হিন্দু রাজা, জমিদার ও বিত্তবান ব্যক্তিরা হিন্দু শিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলির পরিচালনার জন্য অর্থ সাহায্য করতেন। 

[6] শিক্ষার সুযোগ : মধ্যযুগের হিন্দু শিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলিতে শূদ্র ছাড়া অন্য সব বর্ণের হিন্দুরা শিক্ষার সুযোগ লাভ করত। তবে বৌদ্ধরা তাদের পাঠশালায় সকল বর্ণের শিক্ষার্থীকেই পাঠ গ্রহণের সুযোগ দিতেন।

[7] শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক : মধ্যযুগের হিন্দু শিক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক খুবই মধুর ছিল। শিক্ষার্থীর সংখ্যা খুব কম থাকায় ওই সময় শিক্ষার্থীরা শিক্ষকের ব্যক্তিগত তত্ত্বাবধানে শিক্ষার সুযোগ লাভ করত।

[8] শিক্ষণ কৌশল : মধ্যযুগে হিন্দু শিক্ষাব্যবস্থায় প্রধানত আবৃত্তি ও মুখস্থ করার ওপর জোর দেওয়া হত। টোল এবং চতুষ্পাঠীতে শিক্ষার মাধ্যম ছিল সংস্কৃত ভাষা। 

[9] মূল্যায়ন পদ্ধতি ও উপাধি প্রদান : শিক্ষার্থীর আচার-আচরণ ও সাফল্য বিচার করে শিক্ষকগণ নিজেরাই ব্যক্তিগত পরীক্ষার মাধ্যমে তাদের পাঠ সাঙ্গ হয়েছে বলে ঘােষণা করতেন এবং শিক্ষার্থীকে তার প্রাপ্য উপযুক্ত উপাধি প্রদান করতেন। এই উপাধিগুলি হল— বাচষ্পতি, উপাধ্যায়, সার্বভৌম, মহামহােপাধ্যায়, দ্বিবেদী, ত্রিবেদী ইত্যাদি।

Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।

Leave a Comment