সন্ত্রাসবাদের অর্থ কী? সন্ত্রাসবাদের কারণ উল্লেখ কর | Class 12 | Sociology (সাম্প্রতিক কালের সামাজিক বিচার্য বিষয়) | 8 Marks
উত্তর:
সন্ত্রাসবাদের অর্থ (Meaning of Terrorism)
ব্যুৎপত্তিগত অর্থ : সন্ত্রাসবাদের ইংরেজি প্রতিশব্দ হল ‘Terrorism’। এই ইংরেজি শব্দটির উৎস হল ল্যাটিন শব্দ ‘Terrere’। এই ল্যাটিন শব্দটির অর্থ হল ভয় দেখানাে। সুতরাং ব্যুৎপত্তিগত বিচারে সন্ত্রাসবাদ বলতে বােঝায় ভীতি প্রদর্শন বা ত্রাস সৃষ্টি। সন্ত্রাসবাদ হল ভীতিপ্রদর্শনের এক সংগঠিত ব্যবস্থা।
হিংসা ও বলােেয়গ : সন্ত্রাসবাদে হিংসা ও বলপ্রয়ােগ বর্তমান থাকে। ওয়েবস্টার-এর আন্তর্জাতিক অভিধান অনুযায়ী সন্ত্রাসবাদ হল বলপ্রয়ােগের উপায় হিসাবে ত্রাসের সুপরিকল্পিত ব্যবহার’ (“Systematic use of terror as means of coercion”) একটি জনগােষ্ঠী কর্তৃক আর একটি জনগােষ্ঠীর বিরুদ্ধে বা কোনাে জনগােষ্ঠীর একটি অংশের দ্বারা অন্য একটি অংশের বিপক্ষে প্রত্যক্ষভাবে ক্ষমতা প্রয়ােগের বা প্রয়ােগের ভীতিপ্রদর্শনের মাধ্যমে সন্ত্রাসমূলক ঘটনা ঘটে। সাধারণত রাজনীতিক বা ধর্মীয় উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য সন্ত্রাসবাদী ঘটনা সংঘটিত হয়।
ব্যাপক অর্থ : ব্যাপক অর্থে সন্ত্রাসবাদ হল একধরনের সহিংস আচরণ। এর লক্ষ্য হল রাজনীতিক উদ্দেশ্যে একটি জনগােষ্ঠীর মধ্যে বা তার একটি বৃহত্তর অংশের মধ্যে ভয় সৃষ্টি ও সারিত করা। সামাজিক বিজ্ঞানসমূহের বিশ্বকোষ (Encyclopaedia of Social Sciences) অনুযায়ী সন্ত্রাসবাদ হল একটি ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রধানত হিংসার পরিকল্পিত প্রয়ােগ ঘটিয়ে একটি সংগঠিত গােষ্ঠী বা দল স্বঘােষিত উদ্দেশ্যসিদ্ধির ব্যাপারে উদ্যোগী হয় (“ a method where by an organized group or party seeks to achieve its owed aims chiefly through the systematic use of violence”) | প্রকৃত প্রস্তাবে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপে রাজনীতিক উদ্দেশে ব্যক্তিগত বা গােষ্ঠীগতভাবে হিংসার হুমকি দেওয়া হয় বা ব্যবহার করা হয়। এই কার্যকলাপ পক্ষে বা বিপক্ষে হতে পারে। সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপে তাৎক্ষণিকভাবে বা সরাসরি যারা শিকার হয়, সবসময় তারাই মূল লক্ষ্য নয়। মূল লক্ষ্য বৃহত্তর বা ব্যাপকতর। মূল লক্ষ্যকে মর্মাহত, হতচকিত, বিহুল ও ভীত-সন্ত্রস্ত করাই সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের আসল উদ্দেশ্য।
সন্ত্রাসবাদীরা কেবল ভয় দেখায় না, হত্যা এবং ধ্বংসসাধনও তাদের কর্মসূচীর অঙ্গ। ধরা পড়লে সন্ত্রাসবাদী নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে চায় না, বরং সে তার মতাদর্শ প্রচার করে। তার সংগঠন বৈপ্লবিক কর্মসূচীতে বাধা-বিপত্তি সৃষ্টিকারী বলে যাদের চিহ্নিত করে, সন্ত্রাসবাদী তাদেরই শাস্তি দেয়।
সন্ত্রাসবাদের সাধারণ সংজ্ঞায় সংগঠিত গােষ্ঠীসমূহের সকল হিংসাশ্রয়ী কার্যকলাপ অন্তর্ভুক্ত হয় না। নিছক ব্যক্তিগত সমৃদ্ধি বা গৌরবান্বিত করার উদ্দেশে পরিচালিত হিংসাশ্রয়ী কার্যকলাপ সন্ত্রাসবাদের অন্তর্ভুক্ত নয়। এ ক্ষেত্রে উদাহরণস্বরূপ উল্লেখযােগ্য হল ডাকাতি, রাহাজানি প্রভৃতি। তবে নকশালপন্থী গােষ্ঠীর মত কোনাে মতাদর্শে অনুপ্রাণিত ও পরিচালিত গােষ্ঠীসমূহের হত্যাকাণ্ড, ডাকাতি প্রভৃতি সন্ত্রাসবাদের অন্তর্ভুক্ত।
সন্ত্রাসবাদের কারণ : আপেক্ষিক বঞনা তত্ত্ব (Theory of Relative Deprivation)-এর পরিপ্রেক্ষিতে সন্ত্রাসবাদের কারণসমূহ অনুধাবন করা যায়। আপেক্ষিক বঞনা তত্ত্বের মূল বক্তব্য অনুযায়ী একটি নির্দিষ্ট জনগােষ্ঠীর মানুষজনের মূল্য-প্রত্যাশা’ (Value expectation) এবং মূল্য-সামর্থ্যের (Value capabilities) মধ্যে ব্যবধান দেখা দিতে পারে। এই ব্যবধানের ফলশ্রুতি হিসাবে রাজনীতিক সমষ্টিগত হিংসার উদ্ভব হতে পারে।
আধুনিকীকরণ প্রক্রিয়া এবং জাতিসত্তার বিস্ফোরণ (Ethnicity explosion) আপেক্ষিক বঞ্চনার চেতনাকে ব্যাপকভাবে বাড়িয়ে দেয়। সমাজবিজ্ঞানী টেড রবার্ট গার সন্ত্রাসবাদের কারণ হিসাবে ক্রিয়াশীল তিন ধরনের
আপেক্ষিক বঞ্চনার কথা বলেছেন : (ক) অবনমনমূলক বঞ্চনা (declivity deprivation); (খ) উচ্চাভিলাষমূলক বনা (aspirational deprivation); এবং (গ) অগ্রগমনমূলক বঞ্চনা (progressive deprivation)।
অবনমনমুলক বড় না (Declivity Deprivation) : অনেক সময় বিশেষ কোনাে জনগােষ্ঠীর মুল্য-সামর্থ্যসমূহ (value capabilities) অতিমাত্রায় অবনমিত হয়; অথচ মূল্য-প্রত্যাশা অপরিবর্তিত থাকে। এ রকম অবস্থায় অবনমনমূলক বনাবােধ দেখা দেয়। ১৯১৭ সালে রাশিয়ায় বলশেভিকদের সমষ্টিগত রাজনীতিক হিংসা অবনমনমূলক বনার পরিণতি।
উচ্চাভিলাষমূলক বনা (Aspirational Deprivation) : কোনাে নির্দিষ্ট জনগােষ্ঠীর ব্যকি বর্গের মধ্যে অনেক সময় মূল্য-প্রত্যাশা (value expectations) বিশেষভাবে বৃদ্ধি পায়, কিন্তু মূল্য-সামর্থ্য। অপরিবর্তিত থাকে। এ রকম অবস্থায় উচ্চাভিলাষমূলক বঞ্চনাবােধের সৃষ্টি হয়। তখন সন্ত্রাসবাদী প্রবণতা। পরিলক্ষিত হয়। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে কাশ্মীর উপত্যকার সন্ত্রাসবাদী ঘটনাবলীর কথা বলা হয়।
আগ্রগমনমূলক বনা (Progressive Deprivation) : অনেক সময় বিশেষ কোনাে জনগােষ্ঠীর ব্যক্তিবর্গের মূল্য-প্রত্যাশা বৃদ্ধি পায় এবং মূল্য-সামর্থ্য হ্রাস পায়। এ রকম অবস্থায় অগ্রগমনমূলক বঞ্চনাবােধ জাগ্রত হয় এবং সন্ত্রাসবাদী প্রবণতার সৃষ্টি হয়। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে খালিস্তান-এর সন্ত্রাসবাদী ঘটনার উল্লেখ করা হয়।
অ্যালেকজান্ডার ও ফিনজার (Y, Alexander & S.M. Finger), এই দুই সমাজবিজ্ঞানীর অভিমত। অনুযায়ী সন্ত্রাসবাদের প্রধান কারণসমূহ নিহিত আছে আধুনিক সভ্যতার প্রকৃতির মধ্যে এবং আধুনিক শিল্পসভ্যতার বিবিধ ব্যবস্থাদির মধ্যে। সন্ত্রাসবাদের বিকাশ ও বিস্তারের সুনির্দিষ্ট কারণ হিসাবে তারা নিম্নলিখিত বিষয়াদির উল্লেখ করেছেন।
(ক) আধুনিককালে যােগাযােগ ও পরিবহণব্যবহার বিস্ময়কর বিকাশ ও বিস্তার ঘটেছে। সন্ত্রাসবাদী সংগঠনসমূহ সাম্প্রতিককালে বিশ্বব্যাপী কেন্দ্রীভূত সাংগঠনিক কাঠামাে গড়ে তুলেছে। আন্তর্জাতিক স্তরে নেটওয়ার্কের কল্যাণে মতাদর্শগত ভিত্তিতে পরস্পর সম্পর্কিত গােষ্ঠীসমূহ এবং অভিন্ন স্বার্থসমন্বিত গােষ্ঠীসমূহ পারস্পরিক ভিত্তিতে সাহায্য-সহযােগিতা করে। অর্থ, প্রশিক্ষণ, একযােগে আক্রমণ, সাংগঠনিক সাহায্য সহযােগিতা, লড়াই করার যন্ত্রপাতির সরবরাহ প্রভৃতি ক্ষেত্রে এই পারস্পরিক সাহায্য-সহযােগিতা পরিলক্ষিত হয়। তারফলে আন্তর্জাতিক স্তরে হিংসাত্মক কার্যকলাপের সম্প্রসারণ ঘটছে।
(খ) আধুনিক সমাজ হল প্রযুক্তিমূলক জটিল প্রকৃতির সমাজ। এ ধরনের সমাজের ক্ষেত্রে সন্ত্রাসবাদের অপ্রত্যাশিত এবং নিষ্ঠুর আক্রমণের লক্ষ্য হয়ে পড়ার আশঙ্কা অধিক। কারণ অঙ্গীকারবদ্ধ এবং নিবেদিতপ্রাণ সন্ত্রাসবাদীদের যথেচ্ছ আক্রমণের হাত থেকে যােগাযােগের সুযােগ-সুবিধা, পরিবহণ কেন্দ্রসমূহ, কলকারখানা প্রভৃতিকে সুরক্ষিত রাখা দুরূহ ব্যাপার।
(গ) গণ-মাধ্যমসমূহের আধুনিক ভূমিকার সুবাদে সন্ত্রাসবাদী প্রকৌশলসমূহ এবং অনুপ্রেরণা অন্যান্য দেশের সন্ত্রাসবাদী গােষ্ঠীসমূহের কাছে পৌঁছে যায়। যােগাযােগব্যবস্থায় বৈপ্লবিক বিকাশ ও বিস্তারের কল্যাণে সন্ত্রাসবাদীরা সাম্প্রতিককালে সহজেই তাদের হিংসাত্মক ক্রিয়ার লক্ষ্যকে টার্গেট করতে পারে। মনস্তাত্ত্বিক ভীতি ও ত্রাসের সঞ্চার এবং ব্ল্যাকমেল করার উদ্দেশে সন্ত্রাসবাদীরা প্রত্যক্ষ শিকারের সঙ্গে সঙ্গে ব্যাপকসংখ্যক সাধারণ মানুষকেও টার্গেট করতে সক্ষম হয়।
(ঘ) বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভাবনীয় বিকাশ ও বিস্তারের সুবাদে যুদ্ধ-সামর্থ্য ও প্রক্রিয়ার মৌলিক পরিবর্তন ঘটেছে। অপেক্ষাকৃত হীনবল সন্ত্রাসবাদী গােষ্ঠীগুলি অনুজাতিগােষ্ঠী (subnational groups) – তে রূপান্তরিত হয়েছে। এদের শক্তি-সামর্থ্য ভয়াবহ। এই সমস্ত গােষ্ঠী রাষ্ট্রের মধ্যেই রাষ্ট্র সৃষ্টির সামর্থ্য ধরে। দেশের বৈধ সরকারের শাসন ও অস্তিত্বকে তারা বিপন্ন করে তুলতে পারে। এ ক্ষেত্রে উদাহরণস্বরূপ উল্লেখযােগ্য হল ভারতের অন্তর্ভুক্ত কাশ্মীরের জঙ্গীগােষ্ঠীর ভূমিকা।
(ঙ) পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সন্ত্রাসবাদী গােষ্ঠীসমূহের হাতে মিসাইল, রিমােট কন্ট্রোল-এর সাহায্যে বিস্ফোরণ ঘটনাের মত বিস্ফোরক অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র আছে। আশঙ্কা করা হয় যে, নিকট ভবিষ্যতে তারা আণবিক ও রাসায়নিক মারণাস্ত্রেরও অধিকারী হয়ে পড়তে পারে। সে ক্ষেত্রে জীবনহানি ও ধ্বংসসাধনের ক্ষেত্রে তারা ভয়াবহ ক্ষমতার অধিকারী হয়ে পড়বে। উপরিউক্ত বক্তব্যের বাইরে আরও কিছু বিষয় সন্ত্রাসবাদের বিকাশ ও বিস্তারে বিশেষভাবে সহায়তা
(১) বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন দেশে ধর্মীয়, ভাষাগত, জাতিকুলগত এবং জাতীয়তাগত সচেতনতা বিশেষভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
(২) বিভিন্ন দেশের সংখ্যালঘু জনগােষ্ঠীসমূহের মধ্যে হতাশা ও বঞ্চনার চেতনা মাথাচাড়া দিয়ে।
উঠেছে। তারা স্বাধীনতা এবং ন্যায়সঙ্গত আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রামের সামিল হয়েছে।
(৩) বিভিন্ন দেশের স্বৈরাচারী শাসকের পীড়নমূলক শাসকের বিরুদ্ধে নাগরিকরা সুসংহত বিরােধিতা
সংগঠিত করেছে।
(৪) বামপন্থী ও দক্ষিণপন্থী মতাদর্শের বিরুদ্ধে এবং পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে সংঘাত মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে।
(৫) দুর্বল জাতিগুলি শক্তিশালী জাতিগুলিকে দুর্বল করতে চায়। এ রকম ক্ষেত্রে শক্তিধর জাতিসমূহের অন্তর্ভুক্ত অনুজাতিগােষ্ঠীগুলি সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের সঙ্গে সাহায্য-সহযােগিতা করে।
(৬) সন্ত্রাসবাদীরা আজকাল চোরাচালান ও মাদক দ্রব্যাদির লেনদেনের সামিল হয়ে অর্থ রােজগার করছে এবং সেই অর্থের সাহায্যে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করছে।
(৭) ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বিচার-বিবেচনার ভিত্তিতে বিত্তবান অনাবাসী ব্যক্তিবর্গও সন্ত্রাসবাদী গােষ্ঠীগুলিকে সাহায্য করে।
Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।