ভূমিকা : উত্তর উনিশ শতকে বাংলার সমাজসংস্কার আন্দোলনের ইতিহাসে যে-সমস্ত জ্যোতিষ্ক চিরস্মরণীয় অবদান রেখেগেছেন, তাঁদের মধ্যে একজন বাস্তববাদী ও মানবতাবাদী সংস্কারক ছিলেন ভারত পথিক’ রাজা রামমােহন রায়। রাজা রামমােহন রায় সমাজের কুসংস্কার দূর করে আধুনিক সমাজ গঠনে প্রথম সচেষ্ট হয়েছিলেন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন যে, রামমােহন রায় ছিলেন সমকালীন বিশ্বের সেই ব্যক্তি যিনি আধুনিক যুগের গুরুত্ব উপলব্ধি করেছিলেন।
সমাজ সংস্কার:
ক) সতীদাহপ্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন : সমাজসংস্কারের ক্ষেত্রে রাজা রামমােহন রায়ের সবচেয়ে বড়াে অবদান সতীদাহপ্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন। তৎকালীন হিন্দুসমাজের উচ্চবর্ণে অমানবিক সতীদাহপ্রথা প্রচলিত ছিল। এই প্রথ অনুসারে মৃত স্বামীর চিতায় তার জীবিত স্ত্রীকে পুড়িযে মারা হত। ধর্মশাস্ত্র ব্যাখ্যা-সহ বিভিন্নভাবে চেষ্টা করে রামমােহন এই পৈশাচিক প্রথা বন্ধ করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেন। তিনি এই প্রথার বিরুদ্ধে জনমত গঠন করে ব্রিটিশ সরকারের কাছে আবেদন করেন। তার এই প্রচেষ্টার ফলে শেষপর্যন্ত গভর্নর জেনারেল লর্ড উইলিয়ম বেন্টিঙ্ক ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে ১৭নং রেগুলেশন জারি করে সতীদাহপ্রথা নিষিদ্ধ বলে ঘােষনা করেন।
খ) নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা : রাজা রামমােহন রায় নারীদের অধিকার ও দাবি প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করেছিলেন। স্বামীর মৃত্যুর পর যাতে তার বিধবা স্ত্রী স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকতে পারে তার জন্য তিনি স্বামীর সম্পত্তির উপর স্ত্রীর অধিকার প্রতিষ্ঠার বিষযেও আন্দোলন করেন কারণ তখন পিতা বা স্বামীর সম্পত্তিতে নারীদের কোনাে অধিকার ছিল না।
গ) বহুবিবাহের বিরুদ্ধে আন্দোলন : রামমােহন বহুবিবাহ প্রথার বিরুদ্ধেও আন্দোলন করেছিলেন। তিনি ভারতীয় শাস্ত্রের ব্যাখ্যা করে তা দেখিয়েছিলেন যে, প্রাচীন শাস্ত্রে পুরুষের বহুবিবাহের যথেচ্ছ অধিকার দেওয়া হয়নি। তবে প্রাচীনকালে কোন স্ত্রী ব্যাভিচারিণী, সুরাসক্ত ও বন্ধ্যা হলে পুরুষ পুনরায় বিবাহ করতে পারত।
ঘ)কৌলীন্য প্রথা ও বাল্যবিবাহের বিরােধিতা : রামমােহন কৌলীন্য প্রথাবিরােধী ছিলেন। কারণ এই কৌলীন্য প্রথার জন্যই সমাজচ্যুত হওয়ার আশঙ্কায় অল্পবয়স্ক মেয়েদের মৃত্যুপথযাত্রী বৃদ্ধের সঙ্গে বিবাহ দেওয়া হত।
এছাড়াও রামমােহন রায় ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দে ব্রাত্মসভা প্রতিষ্ঠা করেন, তা ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে ব্রায়সমাজ নামে খ্যাতি লাভ করে। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য ছিল পৌত্তলিকতা পরিহার করে নিরাকার পরমব্রহ্মের উপাসনা করা। তিনি এখানেই থেমে যাননি;শিক্ষা-সংস্কৃতির জগতেও রামমােহন অগ্রণী ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল শিক্ষাবিস্তার ও গণতান্ত্রিক চেতনা প্রসারের চেষ্টা।
মূল্যায়ন: এভাবে অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের উপর যুক্তির প্রাধান্য– যা নবজাগরণের মূল কথা, তা রামমােহনের কার্যকলাপে লক্ষ করা যায়। তার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের জন্য তাকে ভারতের প্রথম আধুনিক মানুষ’ বলা হয়।
Read Also
সােমপ্রকাশ পত্রিকার ঐতিহাসিক গুরুত্ব লেখাে। অথবা, কোন অপরাধে সােমপ্রকাশ পত্রিকা নিষিদ্ধ ঘােষিত হয়
খেলার ইতিহাস চর্চার গুরুত্ব লেখাে। অথবা, তুমি খেলার ইতিহাস চর্চাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবে।
সমাজসংস্কার আন্দোলনে রাজা রামমােহন রায়ের ভূমিকা আলােচনা কর ?
মুসলিম সমাজের অগ্রগতিতে আলীগড় আন্দোলন বা সৈয়দ আহমেদ খানের অবদান আলােচনা করাে
Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।