সাম্প্রদায়িকতার ধারণাটি বর্ণনা কর। সাম্প্রদায়িকতায় রাজনৈতিকউপাদান আলােচনা কর Class 12 | Sociology (সাম্প্রতিক কালের সামাজিক বিচার্য বিষয়) | 8 Marks
উত্তর:
সাম্প্রদায়িকতার ধারণা (Concept of Communalism)
সাম্প্রদায়িকতার অর্থ : সাম্প্রদায়িকতা শব্দটি বহুলভাবে ব্যবহুত। কিন্তু ধারণাগত বিচারে শব্দটি সহজ-সরল নয়; বরং বিশেষভাবে জটিল প্রকৃতির। ইংরেজি ভাষায় সাম্প্রদায়িকতার আভিধানিক অর্থ হল সম্প্রদায়ের সঙ্গে বা সমষ্টির সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়াদি, যা ব্যক্তিগত নয়। অর্থাৎ ইংরেজি অর্থটি নিরপেক্ষ প্রকৃতির। কিন্তু ভারতীয় বা দক্ষিণ এশীয় অর্থে সাম্প্রদায়িকতা হল অতিমাত্রায় অভিযােগমূলক। সাধারণভাবে সাম্প্রদায়িকতা বলতে ধর্মীয় স্বাতন্ত্রভিত্তিক আক্রমণাত্মক এবং উগ্র ও অন্ধ সম্প্রদায়গত প্রেমপ্রীতিকে বােঝায়। উগ্র স্বাজাত্যবােধের মধ্যে যে মনােভাব বর্তমান থাকে, তা নিজের জনগােষ্ঠীকেই একমাত্র বিধিসম্মত বা উপযুক্ত জনগােষ্ঠী হিসাবে বিবেচনা করে; এবং অন্য সকল জনগােষ্ঠীকে অপকৃষ্ট, অবৈধ ও বিরােধী বলে মনে করে। সুতরাং সাম্প্রদায়িকতা হল একটি আক্রমণাত্মক রাজনীতিক মতাদর্শ। এই মতাদর্শ ধর্মের সঙ্গে সংযুক্ত। এ হল সাম্প্রদায়িকতার ভারতীয় ধারণা, বা অনেকাংশে দক্ষিণ এশীয় ধারণা।
ধর্ম ও সাম্প্রদায়িকতা এক নয় : সাম্প্রদায়িকতার ধারণার মধ্যে বিভিন্ন উপাদান বর্তমান। এই সমস্ত উপাদানের মধ্যে ধর্ম অন্যতম। আবার সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলি বিভিন্ন উদ্দেশ্যে ধর্মকে ব্যবহার করে। কিন্তু ধর্ম ও সাম্প্রদায়িকতা সমার্থক নয়। সাম্প্রদায়িকতার কারণ হিসাবে ধর্মকে দায়ী করা যায় না। ধর্মবিশ্বাসী মানুষমাত্রেই সাম্প্রদায়িক, এমন কথা বলা যায় না। আবার মুসলমান সাম্প্রদায়িকতা’, ‘হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা, ‘শিখ সাম্প্রদায়িকতা’ প্রভৃতি কথাগুলিও বিভ্রান্তিকর এবং বিশেষভাবে বিপজ্জনক। বস্তুত সাম্প্রদায়িকতার ধারণা ধর্ম-বিরােধী বলে বিবেচিত হয়। আবার এ কথাও উল্লেখ করা আবশ্যক যে, সংখ্যালঘু সাম্প্রদায়িকতার বা সংখ্যাগুরু সাম্প্রদায়িকতার ধারণাও বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে। এই কারণে বলা হয় সাম্প্রদায়িকতার ধারণাটি বিশেষভাবে জটিল প্রকৃতির।
সাম্প্রদায়িকতা রাজনীতি সম্পর্কিত : প্রকৃত প্রস্তাবে সাম্প্রদায়িকতা হল রাজনীতি সম্পর্কিত। বিষয়, ধর্ম সম্পর্কিত বিষয় নয়। সাম্প্রদায়িক ব্যক্তিবর্গ গভীরভাবে ধর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এ কথা ঠিক। কিন্তু বাস্তবে ব্যক্তিগত বিশ্বাস ও সাম্প্রদায়িকতার মধ্যে কোনাে অপরিহার্য সম্পর্ক নেই। একজন সাম্প্রদায়িক ব্যক্তি ধর্মপ্রাণ হতেও পারে, আবার নাও হতে পারে। আবার ধর্মভীরু ব্যক্তিবর্গ সাম্প্রদায়িক হতেও পারে, আবার নাও হতে পারে। কিন্তু সাম্প্রদায়িক ব্যক্তিমাত্রেই পৃথক একটি রাজনীতিক পরিচয়ে বিশ্বাস করে। অবশ্য এই পরিচয়ের ভিত্তিতে ধর্মের অস্তিত্ব আছে। এ ক্ষেত্রে মূল বিষয়টি হল অন্যান্য স্বাতন্ত্রমূলক পরিচিতিতে বিশ্বাসী জনগােষ্ঠীসমূহের প্রতি মনােভাব। ধর্মভিত্তিক পরিচয়ে পরিচিত অন্যান্য জনগােষ্ঠীর কথাও এর অন্তর্ভুক্ত।
সাম্প্রদায়িক ব্যক্তিবর্গ আক্রমণাত্মক রাজনীতিক পরিচয়কে সবকিছুর উপরে তুলে ধরে। তাদের এই পরিচয়ের অংশীদার নয় এমন সকলকে বা প্রত্যেককে তারা নিন্দামন্দ বা আক্রমণ করে।
রাজনীতিক উপাদান : সাম্প্রদায়িকতার ধারণার মধ্যে রাজনীতিক ব্যঞ্জনা বর্তমান। সাম্প্রদায়িকতার ধ্যান-ধারণার ক্ষেত্রে রাজনীতিক আনুগত্যের বিষয়টি জাতি-রাষ্ট্রের পরিবর্তে ধর্মীয় সম্প্রদায়গত বিচার-বিবেচনার ভিত্তিতে নির্ধারিত, নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হয়। সাম্প্রদায়িকতা ব্যক্তিমানবের মানবিক মূল্যবােধকে শিথিল করে দেয় এবং ধর্মনিরপেক্ষ সামাজিক জীবনধারাকে বিপন্ন করে তােলে। সাম্প্রদায়িকতা ধমীয় ভিত্তিতে সমাজথ ব্যক্তিবর্গের মধ্যে বিভেদ ও বিবাদ-বিসংবাদের সৃষ্টি করে। ভারতে বহুজাতির, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের, বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী ও বিভিন্ন ভাষাভাষীর মানুষ বসবাস করে। এ রকম একটি দেশে সাম্প্রদায়িকতা হল জাতীয় সংহতির বিরােধী। সাম্প্রদায়িকতা মানুষের মধ্যে একটা ভ্রান্ত চেতনা বা উন্মাদনার সৃষ্টি করে। এবং এই চেতনা ধৰ্মবৈষম্যমূলক সমাজে শ্রেণিচেতনাকে আচ্ছন্ন করে রাখে। সর্বহারা শ্রমিকশ্রেণির উপর শােষণ-বঞনা বাড়তে থাকে, কিন্তু শ্রেণিসংগ্রাম সুদূরপরাহত হয়ে পড়ে। সমাজে শােষণ-পীড়ন ও অন্যায়-অবিচার বাড়তে থাকে। দেশ ও দেশবাসীর সামগ্রিক উন্নয়ন ও সমাজ-সভ্যতার বিকাশ ব্যাহত হয়।
সমাজবিজ্ঞানীদের অনেকের অভিমত অনুযায়ী সাম্প্রদায়িকতা হল একটি মতাদর্শ। এই মতাদর্শ অনুসারে সমাজ বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ে বিভক্ত। সংশ্লিষ্ট ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলির স্বার্থসমূহ স্বতন্ত্র। অনেক সময় এই সমস্ত স্বার্থের মধ্যে পরস্পরবিরােধিতা পরিলক্ষিত হয়। কোনাে একটি সম্প্রদায়ের মানুষ অপর কোনাে সম্প্রদায়ের বা ধর্মীয় গােষ্ঠীর ব্যক্তিবর্গের বিরুদ্ধে শত্রুতামূলক আচরণ করলে তাকে সাম্প্রদায়িকতা বলে। সাম্প্রদায়িকতামূলক বিরােধিতা বিভিন্ন রকমের হতে পারে। মিথ্যা অভিযােগ উত্থাপন, অপমানসূচক আচরণ, ক্ষতিসাধন প্রভৃতি থেকে শুরু করে লুঠতরাজ, অগ্নিসংযােগ, মহিলাদের শ্লীলতাহানি, এমনকি জীবনহানির ঘটনাও সাম্প্রদায়িক বিরােধিতা বা বিবাদ-বিসংবাদের ক্ষেত্রে ঘটতে দেখা যায়। অধ্যাপক আহুজার অভিমত অনুযায়ী বিভিন্নভাবে সাম্প্রদায়িক কাজকর্মের অভিব্যক্তি ঘটতে পারে। এই সূত্রে তিনি রাজনীতিক সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা ও আর্থনীতিক সাম্প্রদায়িকতার কথা বলেছেন।
সাম্প্রদায়িকতার একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল যে, ধর্মীয় পরিচয় অন্য সবকিছুকে ছাড়িয়ে যায়। ধনী-দরিদ্র, জাতপাত, রাজনীতিক বিশ্বাস, পেশা প্রভৃতি নির্বিশেষে ধর্মই একমাত্র বিবেচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। সকল হিন্দুই সমান, যেমন- মুসলমান, শিখ ও অন্যান্যরা। এই প্রক্রিয়ায় বৃহত্তর এবং বিভিন্ন জনগােষ্ঠী একক ও সমজাতীয় গােষ্ঠীতে পরিণত হয়। নিজের গােষ্ঠী সম্পর্কে যেমন এই প্রক্রিয়া কাজ করে, তেমনি অন্যান্য জনগােষ্ঠী সম্পর্কেও এই প্রক্রিয়া কাজ করে।
Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।