সার্জেন্ট পরিকল্পনা সংক্ষেপে আলােচনা করাে।

সার্জেন্ট পরিকল্পনা সংক্ষেপে আলােচনা করাে।
অথবা, সার্জেন্ট রিপাের্ট-এর সুপারিশগুলি সংক্ষেপে লেখাে। 

উত্তর: 

সার্জেন্ট পরিকল্পনা : 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কেন্দ্রীয় শিক্ষা উপদেষ্টা পর্ষদ (CABE) 1943 খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন ভারত সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা স্যার জন সার্জেন্ট-কে চেয়ারম্যান করে ভারতীয় শিক্ষার অবস্থা পর্যালােচনার জন্য একটি কমিটি গঠন করেন। ওই কমিটি 1944 খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে ‘Report on Post-war Educational Development of India’ নামে যে রিপাের্ট পেশ করে, সেটিই সার্জেন্ট পরিকল্পনা বা সার্জেন্ট রিপাের্ট নামে পরিচিত।

উদ্দেশ্য : 

সার্জেন্ট পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য ছিল পরবর্তী চল্লিশ বছরের মধ্যে ভারতবর্ষের শিক্ষার মান তৎকালীন ইংল্যান্ডের শিক্ষার মানের সমপর্যায়ে নিয়ে যাওয়া। 

সুপারিশসমূহ : 

সার্জেন্ট পরিকল্পনার রিপাের্টে একটি জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তােলার স্বার্থে যে মূল্যবান সুপারিশগুলি করা হয়, তা হল— 

[1] গ্লাক-প্রাথমিক শিক্ষা : 3 থেকে 6 বছর বয়সি শিশুদের জন্য প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে।

[2] প্রাথমিক অথবা বুনিয়াদি শিক্ষা : 6 থেকে 14 বছর বয়সি প্রত্যেকটি শিশুকে সর্বজনীন, অবৈতনিক এবং বাধ্যতামূলক প্রাথমিক বা বুনিয়াদি শিক্ষাব্যবস্থার অধীনে আনতে হবে। 

[3] মাধ্যমিক শিক্ষা : 11 থেকে 17 বছর বয়সি শিশুদের জন্য মাধ্যমিক শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। মাতৃভাষার মাধ্যমে 6 বছরের জন্য পঠনপাঠন করতে হবে। মাধ্যমিক স্তরে ইংরেজিকে বাধ্যতামূলক করতে হবে। উচ্চবিদ্যালয়গুলিতে দু-ধরনের পাঠক্রম অনুসৃত হবে। (i) সাধারণধর্মী শিক্ষা (বিশুদ্ধ কলা ও বিজ্ঞান শিক্ষার জন্য), এবং (ii) কারিগরি শিক্ষা (বিজ্ঞান, শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ে পঠনপাঠনের জন্য)। এই দু-প্রকার পাঠক্রমসম্পন্ন বিদ্যালয়গুলি সমমর্যাদাসম্পন্ন হবে।

[4] উচ্চশিক্ষা : (i) উচ্চমাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা শেষ করার পর 10% থেকে 15% যােগ্য শিক্ষার্থী যাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভরতি হতে পারে তার জন্য ব্যবস্থা নিতে হবে। (ii) ইন্টারমিডিয়েট স্তরের অবসান ঘটাতে হবে এবং উচ্চমাধ্যমিকের সঙ্গে ওই দু-বছর শিক্ষাকালের এক বছর যুক্ত করতে হবে।

(iii) ডিগ্রি কোর্সের মেয়াদ হবে তিন বছর। 

(iv) দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের আর্থিক সহায়তাদানের ব্যবস্থা করতে হবে। 

(v) টিউটোরিয়াল ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে হবে। 

(vi) স্নাতকোত্তর শিক্ষা ও গবেষণার মানােন্নয়ন ঘটাতে হবে।

(vii) বিশ্ববিদ্যালয়-এর সংখ্যা এবং তার আসন সংখ্যা বাড়াতে হবে।

(viii) অধ্যাপকদের সঠিক বেতনকাঠামাে ও অন্যান্য সুযােগসুবিধা দিতে হবে।

(ix) শিক্ষাক্ষেত্রে একটি সর্বভারতীয় সংস্থা গঠন করতে হবে এবং পরীক্ষা ব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস করতে হবে। 

[5] বৃত্তি ও কারিগরি শিক্ষা : বৃত্তি ও কারিগরি শিক্ষার উন্নয়ন ঘটাতে হবে। এদেশের শিল্পের বাস্তব প্রয়ােজনের দিকে তাকিয়ে বৃত্তি ও কারিগরি শিক্ষাকে চারটি পর্যায়ে ভাগ করতে হবে। 

(i) অর্ধ দক্ষ শিল্পী তৈরি, 

(ii) দক্ষ শিল্পী তৈরি, 

(iii) ফোরম্যান ও নিম্নতর কর্মকর্তা তৈরি এবং 

(iv) প্রধান কর্মকর্তা ও গবেষণা কর্মী তৈরি।

[6] বয়স্ক শিক্ষা : 

(i) বয়স্ক শিক্ষার দায়িত্ব পুরােপুরিভাবে সরকারকেই নিতে হবে।

(ii) শ্রেণিতে বয়স্ক শিক্ষার্থীর সংখ্যা 25-এর মধ্যে হবে। 

(iii) বিষয়বস্তু শিক্ষার্থীদের কাছে তুলে ধরার জন্য চার্ট, চিত্র, নৃত্য-গীত, বেতার, গ্রামােফোন ইত্যাদিকে কাজে লাগাতে হবে। 

(iv) 10 থেকে 40 বছর বয়সের মধ্যে পড়ে এমন শিক্ষার্থীদের ভরতি নিতে হবে। 

(v) মহিলাদের জন্য পৃথক ব্যবস্থা করতে পারলে ভালাে হয়। 

(vi) উপযুক্ত সংখ্যক গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা করতে হবে। 

[7] প্রতিবন্ধী শিক্ষা : দৈহিক ও মানসিক প্রতিবন্ধীদের জন্য প্রয়ােজনীয় শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে।

[8] কর্মসংস্থা : শিক্ষার্থীরা শিক্ষাক্রম শেষ করার পর যাতে চাকুরির সুযােগ পায়, তার জন্য কর্মসংস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। 

[9] সহপাঠক্রমিক কার্যাবলি :

(i) প্রাথমিক স্তরের ছাত্রছাত্রীদের জন্য বিদ্যালয়ে ড্রিল, খেলাধুলাে, ছবি আঁকা, গানবাজনা, নৃত্য প্রভৃতির ব্যবস্থা করতে হবে। 

(ii) মাধ্যমিক স্তরের ছাত্রছাত্রীদের জন্য ব্যায়াম ও শরীরচর্চার পাশাপাশি সমাজসেবামূলক কাজের ব্যবস্থা করতে হবে। ক্রীড়া প্রতিযােগিতা, সাংস্কৃতিক প্রতিযােগিতা ইত্যাদিরও ব্যবস্থা করতে হবে। দেশের যুবক-যুবতিদের জন্য যুব-আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। 

[10] স্বাস্থ্যশিক্ষা ও শারীরশিক্ষা : 

(i) বিদ্যালয় স্তরে শিক্ষার্থীদের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা গড়ে তােলার জন্য একটি জাতীয় কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে।

(ii) বিদ্যালয়ে ভরতির সময়, নিম্ন বুনিয়াদি শিক্ষা শেষে এবং উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা শেষে স্বাস্থ্য পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। 

(iii) ছাত্রছাত্রীদের জন্য স্বাস্থ্য শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করতে হবে। 

(iv) বিদ্যালয় স্তরে শারীরশিক্ষা বিষয়কে আবশ্যিক করতে হবে।

[11] শিক্ষা প্রশাসন : 

(i) দেশে একটি শক্তিশালী কেন্দ্রীয় শিক্ষা বিভাগ গড়ে তুলতে হবে। CABE-কে যথেষ্ট গুরুত্ব দিতে হবে। 

(ii) শিক্ষা-সংক্রান্ত প্রশাসনিক কার্য পরিচালনার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার ও প্রাদেশিক সরকার পরস্পরকে সহযােগিতা করবে। 

(iii) উচ্চশিক্ষা ও উচ্চ কারিগরি শিক্ষার দায়িত্ব থাকবে কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর।

(iv) মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার দায়িত্ব থাকবে রাজ্য সরকারের হাতে।

(v) জনগণকে শিক্ষার প্রতি আগ্রহী করে তােলার জন্য স্কুল কমিটি ও স্কুল বাের্ড গঠন করতে হবে। 

[12] জাতীয় শিক্ষা ব্যয় : সার্জেন্ট কমিটির মতে, পরিকল্পনাটিকে বাস্তবায়িত করতে প্রতি বছর 300 কোটি টাকা ব্যয় হবে। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করতে প্রয়ােজন হবে 10 কোটি টাকা। প্রাথমিক শিক্ষার বিকাশের জন্য প্রতিবছর 40 কোটি টাকার প্রয়ােজন হবে। 

মূল্যায়ন : ভারতের জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থার ক্ষেত্রে সার্জেন্ট রিপাের্ট হল একটি যুগান্তকারী পরিকল্পনা। এতে রয়েছে উন্নয়নমূলক বহু নতুন নতুন চিন্তাধারা। মূল পাঠক্রমের সঙ্গে যুক্ত করার কথা বলা হয় সহপাঠ্যক্রমিক কার্যাবলিকে। সর্বস্তরের শিক্ষা এবং শিক্ষা-সংক্রান্ত বিষয় সম্পর্কে মূল্যবান সুপারিশ এখানে উল্লেখ করা হয়েছে। শিক্ষার্থীর চরিত্র গঠন, দৈহিক বিকাশ, সমাজসেবা, আমােদ-প্রমােদ, অবসরযাপন প্রভৃতি বিষয়ে সুপারিশ করা হয়েছে। তবে সার্জেন্ট রিপাের্টে উল্লেখিত আট বছরের বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্তনের পরিকল্পনাকে অনেকে সমালােচনা করেছেন।

Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।

Leave a Comment