স্যাডলার কমিশনের প্রধান প্রধান সুপারিশগুলি বিশ্লেষণ করাে
অথবা, 1917-1919 খ্রিস্টাব্দের কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশনের প্রধান প্রধান সুপারিশগুলি বিশ্লেষণ করাে।
উত্তর :
কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন বা স্যাডলার কমিশনের সুপারিশ :
লর্ড কার্জনের আমলে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় আইন (1904 খ্রিস্টাব্দ) পাস হওয়ার পর স্যার আশুতােষ মুখােপাধ্যায়ের সুদক্ষ পরিচালনায় নানান দিক থেকে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজকর্মের দ্রুত প্রসার ঘটে। সেই সঙ্গে বহু সমস্যাও দেখা দেয়। ওই সমস্যা সমাধান ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার সংস্কারের জন্য 1917 খ্রিস্টাব্দে মাইকেল স্যাডলারের নেতৃত্বে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন বা স্যাডলার কমিশন গঠিত হয়। ওই কমিশনে ভারতীয় সদস্য ছিলেন স্যার আশুতােষ মুখােপাধ্যায় এবং ড. জিয়াউদ্দীন আহম্মদ। আর অন্যান্যদের মধ্যে ছিলেন ড. গ্রেগরী, স্যার ফিলিপ হার্টগ এবং অধ্যাপক রামজে মুর। এই কমিশনের সদস্যরা দীর্ঘ সতেরাে মাস কাজ করার পর 1919 খ্রিস্টাব্দে তাঁদের রিপাের্ট পেশ করেন। এই কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশগুলি হল—
মাধ্যমিক শিক্ষার ত্রুটি ও কমিশনের সুপারিশ :
স্যাডলার কমিশন মাধ্যমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে অনেকগুলি ত্রুটি লক্ষ করেন। দেখা যায়—
(1) মাধ্যমিক শিক্ষার মান নিম্নগামী;
(2) বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারি শিক্ষা বিভাগের চাপের ফলে মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে না;
(3) উচ্চমাধ্যমিকের দুটি শ্রেণিকে মহাবিদ্যালয়ের সাথে যুক্ত করার ফলে মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যাহত হচ্ছে।
(4) বিদ্যালয়গুলিতে আর্থিক দুরবস্থা চলছে;
(5) শিক্ষকদের বেতনকাঠামাে সঠিক নয় এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকের অভাব রয়েছে।
এইসব ত্রুটি বা সমস্যার সমাধানের জন্য নিম্নলিখিত সুপারিশ করা হয়—
(i) উচ্চমাধ্যমিক (+2) স্তরের নাম হবে ইন্টারমিডিয়েট স্তর। এই স্তরের শিক্ষা মাধ্যমিক শিক্ষার সঙ্গেই যুক্ত করা হবে। মহাবিদ্যালয়ে ওই দু-বছরের শিক্ষাক্রম আর থাকবে না।
(ii) দশম শ্রেণির পরে ‘ম্যাট্রিকুলেশন’ এবং পরবর্তী দু-বছরের অতিরিক্ত পাঠ শেষ করার পর ‘ইন্টারমিডিয়েট’ নামে দুটি পৃথক পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে।
(iii) ইন্টারমিডিয়েট স্তরের জন্য পৃথক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে। কিছু মাধ্যমিক বিদ্যালয়েও ইন্টারমিডিয়েট পাঠক্রম পড়ানাের ব্যবস্থা করতে হবে।
(iv) মাধ্যমিক ও ইন্টারমিডিয়েট শিক্ষা পরিচালনার জন্য দুটি পৃথক পর্ষদ গড়ে তুলতে হবে। পর্ষদগুলিতে বহুসংখ্যক বেসরকারি প্রতিনিধিকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
(v) প্রথমে ম্যাট্রিকুলেশন, পরে ইন্টারমিডিয়েট পাস করলে, তবেই শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে ভরতি হতে পারবে।
(vi) ইংরেজি ও গণিত—এই দুটি বিষয় ইংরেজি মাধ্যমে পড়তে হবে। বাকিগুলি মাতৃভাষার মাধ্যমে পড়া যাবে।
(vii) মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার জন্য বছরে অতিরিক্ত 40 লক্ষ টাকা বরাদ্দ করতে হবে এবং শিক্ষক-শিক্ষিকাদের প্রশিক্ষণের জন্য শিক্ষক-শিক্ষণ বিভাগ খুলতে হবে। প্রয়ােজনে স্নাতক স্তরেও ‘এডুকেশন’ বিষয়টি পাঠ্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার ত্রুটি ও কমিশনের সুপারিশ :
স্যাডলার কমিশন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার ক্ষেত্রে যে ত্রুটিগুলি লক্ষ করে, সেগুলি হল—
(i) বিশ্ববিদ্যালয়কে অধিকাংশ সময়ই প্রশাসনিক কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়, তাই শিক্ষার মানােন্নয়নের কাজ ব্যাহত হয়।
(ii) মহাবিদ্যালয়গুলিতে অর্থের অভাবে উন্নয়নমূলক কাজ করা যায় না।
(iii) বিশ্ববিদ্যালয়ে কারিগরি ও বৃত্তিশিক্ষার কোনাে পাঠক্রম নেই।
(iv) মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘বক্তৃতা’ পদ্ধতিতে পাঠদান করা হয়। ফলে শিক্ষার্থীরা অনুপ্রাণিত হয় না।
(v) মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন তুলনামূলকভাবে কম এবং চাকুরিতেও নিরাপত্তা কম।
(vi) পাঠক্রম বাস্তব জীবনের সঙ্গে সম্পর্কহীন।
(vii) মহাবিদ্যালয়ে ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রকল্যাণের দিকে নজর দেওয়া হয় না।
এইসব ত্রুটি বা সমস্যা সমাধানের জন্য নিম্নলিখিত সুপারিশগুলি করা হয়—
[1] বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মভার কমানাের জন্য :
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইন্টারমিডিয়েট শ্রেণিগুলিকে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। ম্যাট্রিকুলেশন ও ইন্টারমিডিয়েট শিক্ষার জন্য পৃথক শিক্ষা পর্ষদ গড়ে তুলতে হবে।
[2] পঠনপাঠনের কোর্স ও শিক্ষাদানের জুটি দূর করার জন্য :
(i) স্নাতক কোর্স তিন বছরের হবে।
(ii) স্নাতক স্তরে পাস কোর্স এবং অনার্স কোর্স নামে দুটি পৃথক পাঠক্রম চালু করতে হবে।
(iii) মহাবিদ্যালয়গুলিতে টিউটোরিয়াল ক্লাস এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণামূলক কোর্স পরিচালনার ব্যবস্থা করতে হবে।
(iv) পাস এবং অনার্স উভয় কোর্সে ভারতীয় আধুনিক ভাষা পঠনপাঠনের সুযােগ সৃষ্টি করতে হবে।
(v) বিভিন্ন ধরনের বৃত্তিমুখী পাঠক্রম চালু করতে হবে।
(vi) মহাবিদ্যালয়গুলিতে নতুন নতুন কোর্স বাড়ানাের ব্যবস্থা করতে হবে।
(vii) পরীক্ষা পদ্ধতির পুনর্বিন্যাস ও সংস্কার করতে হবে।
[3] প্রয়ােজনভিত্তিক নতুন কোর্স প্রবর্তনের জন্য :
(i) বিজ্ঞান ও বৃত্তিশিক্ষার জন্য শিক্ষা সম্প্রসারণের দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয়কেই গ্রহণ করতে হবে।
(ii) বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘এডুকেশন’ ডিপার্টমেন্ট চালু করতে হবে।
(iii) ইন্টারমিডিয়েট স্তরে এবং স্নাতক স্তরে ‘এডুকেশন’ একটি পৃথক বিষয় হিসেবে যাতে পড়ানাে হয়, তার ব্যবস্থা করতে হবে।
(iv) বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘শারীরশিক্ষা’ বিষয়ে পঠনপাঠনের ব্যবস্থা করতে হবে।
(v) ছাত্রছাত্রীদের স্বাস্থ্য বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া ও স্বাস্থােন্নতির জন্য ডিরেক্টর অফ ফিজিক্যাল এডুকেশন নিয়ােগ করতে হবে।
(vi) ছাত্ৰমঙ্গল সংস্থা গড়ে তুলতে হবে।
(vii) নারীশিক্ষার বিকাশ ঘটানাের জন্য পনেরাে-ষােলাে বছর বয়সি বালিকাদের জন্য ‘পর্দা স্কুল’-এর ব্যবস্থা করতে হবে।
[4] বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সঠিকভাবে চালানাের জন্য :
(i) বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালন ব্যবস্থা সরকারি নিয়ন্ত্রণমুক্ত করতে হবে।
(ii) বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালক কমিটিতে মহাবিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সদস্য হিসেবে গ্রহণ করতে হবে।
(iii) বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনার ক্ষেত্রে সিনেট ও সিন্ডিকেট-এর পরিবর্তে কোর্ট ও এগজিকিউটিভ কাউন্সিল (Executive Council) গঠন করতে হবে।
(iv) বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘অ্যাকাডেমিক কাউন্সিল’, ‘ফ্যাকাল্টি কাউন্সিল’ ও ‘বাের্ড অফ স্টাডিজ’ গঠন করতে হবে।
(v) প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পূর্ণ সময়ের বেতনভুক উপাচার্য নিয়ােগ করতে হবে।
(vi) বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সমন্বয়সাধনের জন্য ‘আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় বাের্ড’ গঠন করতে হবে।
(vii) চাকুরি ও পদোন্নতি বিষয়গুলি পরিচালনার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় সার্ভিস কমিশন গঠন করতে হবে।
(viii) বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর স্তরে বিষয়ভিত্তিক বিভাগ চালু করে প্রতি বিভাগে ‘হেড অফ দ্য ডিপার্টমেন্ট’ নিয়ােগ করতে হবে।
সমালােচনা : কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন বা স্যাডলার কমিশনের সুপারিশগুলি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। পরবর্তীকালে ওই সুপারিশের ভিত্তিতে
(i) আন্নামালাই (1920 খ্রি.), আগ্রা (1922 খ্রি.), অন্ধ্রপ্রদেশ (1923 খ্রি.), আন্দামান (1926 খ্রি.) প্রভৃতি স্থানে বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে ওঠে;
(ii) উত্তরপ্রদেশ, বিহার, পাঞ্জাব প্রভৃতি প্রদেশে শিক্ষা পর্ষদ গঠিত হয়;
(iii) স্বশাসিত মহাবিদ্যালয়, স্বশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যধারার সূচনা হয়;
(iv) দেশের মাধ্যমিক শিক্ষা দ্বাদশ (10 + 2) শ্রেণি পর্যন্ত। বিস্তৃত হয়;
(v) তিন বছরের স্নাতক কোর্স, পাস কোর্স এবং অনার্স কোর্স। চালু হয়।
(vi) কারিগরি শিক্ষা, চিকিৎসাবিদ্যা, আইন ও বৃত্তিশিক্ষার প্রচলন ঘটে।
স্যাডলার কমিশনের সুপারিশ-এ কিছু ত্রুটিও লক্ষ করা যায়। যেমন—
(i) ভারতের মতাে দেশে আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ বহন করা সত্যিই অসুবিধাজনক।
(ii) মাধ্যমিক ও ইন্টারমিডিয়েট বাের্ড গঠনের ক্ষেত্রে সদস্য নির্বাচন বিষয়ে যে সাম্প্রদায়িক নীতির প্রস্তাব প্রতিবেদনে ছিল—তাও গ্রহণযােগ্য নয়।
Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।