শিখন কাকে বলে? শিখনের প্রভাব বিস্তারকারী উপাদান গুলি কি কি? শিখনের সঙ্গে পরিণমনের সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য গুলি উল্লেখ করো।

শিখন কাকে বলে? শিখনের প্রভাব বিস্তারকারী উপাদান গুলি কি কি? শিখনের সঙ্গে পরিণমনের সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য গুলি উল্লেখ করো।

উত্তর:-

শিখন:

ইংরেজি ‘Learning’ শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ হলো শিখন। শিখন হল একটি জটিল প্রক্রিয়া। যে মানসিক প্রক্রিয়ায় অতীত অভিজ্ঞতা ও প্রশিক্ষণের সাহায্যে প্রগতিশীল আচরণ ধারা পরিবর্তনের মাধ্যমে ব্যক্তির দৈহিক ও মানসিক বিকাশ সাধন ঘটে এবং প্রগতিশীল পরিবেশে সার্থকভাবে অভিযোজন করতে সহায়তা করে, তাকে শিখন বলে।

শিখনের প্রভাব বিস্তারকারী উপাদান:

শিখনের যে সকল মানসিক ও বাহ্যিক প্রক্রিয়া প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষভাবে প্রভাব বিস্তার করে, তাদেরকে শিখনের প্রভাব বিস্তারকারী উপাদান বলে। যেমন- পরিণমন (Maturation), প্রেষণা (Motivation), মনােযােগ (Attention), আগ্রহ বা অনুরাগ (Interest), ক্ষমতা বা সামর্থ্য (Mental Abilities)

পরিণমন (Maturation): পরিণমন হল এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে জন্মগত সম্ভাবনাগুলির স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশের মধ্য দিয়ে ব্যক্তির আভরণের গুণগত ও পরিমাণগত পরিবর্তন সাধিত হয়। পরিণমন হল এক ধরনের বৃদ্ধি, যা নির্দিষ্ট সীমায় পৌঁছানাে পর্যন্ত নিজস্ব নিয়মে চলতে থাকে।

প্রেষণা (Motivation): ব্যক্তির অভ্যন্তরীণ ইচ্ছা হল প্রেষণা। প্রেষণা শিখন প্রক্রিয়ার একটি অন্যতম অংশ, যা সৃষ্টি হয় অভাব বােধ থেকে। প্রেষণা একপ্রকার তাড়নার অনুভুতি বা উদ্দীপক যা আমাদের কাজ করতে বাধ্য করে।

মনােযােগ (Attention): কোন বিষয় বা বস্তু সম্পর্কে সুস্পষ্ট জ্ঞানলাভের উদ্দেশ্যে মনকে নিবিষ্ট করার জৈব-মানসিক প্রক্রিয়াকে মনােযােগ বলে। মনােযােগ হল মনের যোগ। উদ্দেশ্য সাধনের জন্য কোন বস্তুকে চেতনার কেন্দ্রস্থলে হাজির করাই হল মনােযােগ। মনোবিদ মাকডুগাল- এর মতে, “যে মানসিক সক্রিয়তা আমাদের প্রত্যক্ষণের উপর প্রভাব বিস্তার করে তাই হল মনােযােগ ।”

আগ্রহ বা অনুরাগ (Interest): শিখনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল আগ্রহ বা অনুরাগ। আগ্রহ হল মনের এমন একটি স্থায়ী প্রবণতা যা ব্যক্তির সুপ্ত মনােযােগকে গতিশীল করার মাধ্যমে তাকে বস্তুধর্মী কর্মসম্পাদনের দিকে অগ্রসর হতে উদ্বুদ্ধ করে। পৌছনাের আগ্রহ থাকে বলেই কোন বিশেষ উদ্দীপকের প্রতি আমরা প্রতিক্রিয়া করে থাকি।

ক্ষমতা বা সামর্থ্য (Mental Abilities): মানুষের যাবতীয় কর্মসম্পাদনের পিছনে যে বিশেষ উপাদান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে তা হল ক্ষমতা বা সামর্থ্য। অর্থাৎ ক্ষমতা হল কোন কর্মসম্পাদনের সামর্থ্য। মনোবিদ মাকতুগালের মতে, Ability is essentially the capacity of making new adjustment’। অর্থাৎ ক্ষমতা হল নতুন পরিস্থিতিতে সংগতিবিধানের প্রক্রিয়া।

প্রাচীন অনুবর্তন ও সক্রিয় অনুবর্তনের মধ্যে পার্থক্য

উদ্দীপক ও প্রতিক্রিয়ার উপর নির্ভর করে অনুবর্তনের শ্রেণি নির্দেশিত হয়। এই অনুবর্তন প্রক্রিয়ার দ্বারা প্রাণীর আচরণের প্রকৃতি অনুশীলন করা হয়। অনুবর্তন দু-প্রকার, যথা—প্রাচীন অনুবর্তন ও সক্রিয় অনুবর্তন। শিখনের ক্ষেত্রে এই দু-ধরনের অনুবর্তনের প্রয়ােগ ভিন্ন। নীচে প্রাচীন ও সক্রিয় অনুবর্তনের পার্থক্য আলােচিত হল—

প্রাচীন অনুবর্তন

  • প্রাচীন অনুবর্তন তত্ত্বের প্রবক্তা হলেন শারীরবিজ্ঞানী প্যাভলভ।
  • প্যাভলভ তার গবেষণাটি করেছিলেন কুকুর নিয়ে।
  • এই অনুবর্তন উদ্দীপককেন্দ্রিক (S-type)
  • প্রাচীন অনুবর্তনে শক্তিদায়ক উদ্দীপককে পূর্বেই উপস্থাপন করা হয়।
  • এই অনুবর্তন প্রাণীর স্বয়ংক্রিয় স্নায়ুতন্ত্র দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।
  • প্রাচীন অনুবর্তন কৌশলটি প্রাণীর ইচ্ছাধীন নয়।
  • এই অনুবর্তনে যে S-R বন্ধন তৈরি হয় তা মূলত সাযুজ্যের (Contiguity) জন্য হয়ে থাকে।
  • প্রাচীন অনুবর্তনে  প্যাভলভের তত্ত্বটিকে Type i শিখন বলে।
  • প্রাচীন অনুবর্তনে স্বাভাবিক উদ্দীপক অনুবর্তিত উদ্দীপকের সঙ্গে যুক্ত থাকে। 
  • এই অনুবর্তনে দুটি উদ্দীপক থাকে— একটি স্বাভাবিক এবং অপরটি বিকল্প।
  • প্রাচীন অনুবর্তনে উদ্দীপকের প্রতিস্থাপন হল অনুবর্তনের মূল বিষয়।
  • এই অনুবর্তনে সময় নিয়ন্ত্রণের উপর জোর দেওয়া হয়।
  • প্রাচীন অনুবর্তনের গতি সামনের দিকে অর্থাৎ আগে উদ্দীপক, তারপর প্রতিক্রিয়া।
  • এখানে মূলত অনুবর্তিত প্রতিক্রিয়া প্রত্যাশামূলক।
  • অনুবর্তিত প্রতিক্রিয়ার শক্তি প্রারম্ভিক অবস্থায় শূন্য থাকে।
  • শিশু ও ইতর প্রাণীদের ক্ষেত্রে এই ধরনের অনুবর্তন বেশি কার্যকরী।

সক্রিয় অনুবর্তন

  • অপারেন্ট অনুবর্তনের স্রষ্টা হলেন মনােবিজ্ঞানী বি এফ স্কিনার।
  • স্কিনার তার গবেষণাটি করেছিলেন ইদুর ও পায়রা নিয়ে।
  • এই অনুবর্তন প্রতিক্রিয়াকেন্দ্রিক (R-type)
  • সক্রিয় অনুবর্তনে শক্তিদায়ক উদ্দীপকটিকে প্রতিক্রিয়া করার পর উপস্থাপন করা হয়।
  • এই অনুবর্তন কৌশল প্রাণীর কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।
  • সক্রিয় অনুবর্তন কৌশলটি প্রাণীর ইচ্ছাধীন।
  • এই অনুবর্তনে যে S-R বন্ধন তৈরি হয় তা মূলত ফলাফলের (effect) দ্বারা হয়ে থাকে।
  • অপারেন্ট অনুবর্তনে  তত্ত্বটিকে Type i শিখন বলে।
  • অপারেন্ট অনুবর্তনে প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে শক্তিদায়ক উদ্দীপক যুক্ত থাকে।
  • সক্রিয় অনুবর্তনে শুধুমাত্র একটি উদ্দীপক থাকে।
  • সক্রিয় অনুবর্তনে আচরণের উন্নতিকরণই হল মূল বিষয়।
  • সক্রিয় অনুবর্তনে প্রেষণা ও পুরস্কারের উপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়।
  • সক্রিয় অনুবর্তনে গতি পশ্চাৎমুখী। অর্থাৎ আগে প্রতিক্রিয়া, তারপর উদ্দীপক।
  • এখানে অনুবর্তিত প্রতিক্রিয়া নির্দেশমূলক।
  • অপারেন্ট অনুবর্তনে কোনাে শূন্য শক্তিসম্পন্ন প্রতিক্রিয়ার কথা ভাবা হয় না।
  • উন্নত বুদ্ধি ও মানুষের দৈনন্দিন জীবনে অপারেন্ট অনুবর্তন বেশি কার্যকরী।

শিখন ও পরিণমনের মধ্যে সাদৃশ্য

➽ শিখন 

(১) শিখন ব্যক্তিনির্ভর প্রক্রিয়া।

(২) শিখনের মাধ্যমে ব্যক্তি জীবনের আচরণগত পরিবর্তন সাধিত হয়।

(৩) শিখন হল একপ্রকার বৃদ্ধি বা বিকাশের প্রক্রিয়া।

(৪) শিখন প্রক্রিয়া পরিণমনের উপর নির্ভরশীল অর্থাৎ পরিণমন ছাড়া শিখন সম্ভব নয়।

(৫) শিখন ব্যক্তির জীবনবিকাশে সাহায্য করে।

(৬) শিখনের ফলে আচরণের গুণগত ও পরিমাণগত পরিবর্তন সাধিত হয়।

➽ পরিণমন 

(১) পরিণমনও ব্যক্তিনির্ভর প্রক্রিয়া।

(২) পরিণমনের ফলশ্রুতি হিসেবেও ব্যক্তিজীবনে আচরণের পরিবর্তন আসে।

(৩) পরিণমনও একটি বৃদ্ধি বা বিকাশের প্রক্রিয়া।

(৪) অপরপক্ষে পরিণমনও শিখনের উপর নির্ভরশীল প্রক্রিয়া, কারণ পরিণমনলব্দ অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে আমরা পরবর্তী শিখনের দিকে এগিয়ে যাই।

(৫) পরিণমনও ব্যক্তির জীবনবিকাশে সাহায্য করে।

(৬) পরিণমনের ফলেও আচরণের উৎকর্ষসাধন হয়।

শিখন ও পরিণমনের মধ্যে বৈসাদৃশ্য

শিখন 

(১) শিখন হল সেই প্রক্রিয়া, যার সাহায্যে ব্যক্তি বা শিশু তার আচরণের মধ্যে এমন পরিবর্তন আনে যা

পরিবেশের সঙ্গে তাকে মানিয়ে নিতে সাহায্য করে।

(২) শিখন প্রক্রিয়ায় ব্যক্তির সচেতনতা থাকে। অর্থাৎ শিখনে শিক্ষার্থীর আত্মসচেতনতাই হল মূল উপাদান।

(৩) শিখনে ব্যক্তির আত্মসক্রিয়তার প্রয়ােজন হয়।

(৪) শিখন প্রক্রিয়ার মূলে কোনাে না কোনাে উদ্দেশ্য থাকে। অর্থাৎ শিখন উদ্দেশ্যভিত্তিক প্রক্রিয়া।

(৫) শিখনে শিক্ষার্থীর মানসিক প্রস্তুতির প্রয়ােজন।

(৬) শিখন চাহিদা নিয়ন্ত্রিত প্রক্রিয়া অর্থাৎ চাহিদাগত পরিতৃপ্তির প্রয়ােজনে শিখন ঘটে।

(৭) শিখন একটি কৃত্রিম প্রক্রিয়া।

(৮) শিখন একটি মানসিক প্রক্রিয়া।

(৯) শিখন পূর্ব অভিজ্ঞতার  উপর নির্ভরশীল।

(১০) শিখনকে দৃঢ় করতে গেলে  শিক্ষণীয় বিষয় অনুশীলনের প্রয়ােজন হয়।

(১১)  শিখন একটি জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত এই প্রক্রিয়াটি চলে। 

(১২) শিখনের ফলে ব্যক্তির  যে পরিবর্তন আসে তা চিরস্থায়ী নাও হতে পারে

(১৩) লিঙ্গভেদে শিখনে কোনাে পার্থক্য দেখা যায় না।

(১৪) শিখন কোনাে নির্দিষ্ট ধারা মেনে চলে না।

(১৫) শিখন একটি প্রশিক্ষণনির্ভর প্রক্রিয়া। অর্থাৎ শিখনের মানােন্নয়নের জন্য প্রশিক্ষণের প্রয়ােজন হয়।

(১৬) শিখন শর্তসাপেক্ষ প্রক্রিয়া।

পরিণমন

(১) পরিণমন হল জন্মগত সম্ভাবনাগুলো বাস্তবায়িত হওয়ার  প্রক্রিয়া, যেগুলির মাধ্যমে ব্যক্তি বা শিশুর আচরণগত পরিবর্তন আসে। 

(২) পরিণমনে শিক্ষার্থীর সচেতনতা থাকে না। অর্থাৎ পরিণমন প্রাণীর অজান্তেই ঘটে থাকে।

(৩) পরিণমনের ক্ষেত্রে ব্যক্তির আত্মসক্রিয়তার কোনাে প্রয়ােজন হয় না।

(৪)  পরিণমন কোনাে উদ্দেশ্যভিত্তিক প্রক্রিয়া নয়।

(৫) পরিণমনে শিক্ষার্থীর মানসিক প্রস্তুতির প্রয়ােজন হয় না। 

(৬) পরিণমন চাহিদার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত প্রক্রিয়া নয়।

(৭) পরিণমন একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। 

(৮) পরিণমন একটি জৈবিক প্রক্রিয়া।

(৯) পরিণমন শর্তনিরপেক্ষ প্রক্রিয়া।

(১০) পরিণমনের ক্ষেত্রে পূর্ব অভিজ্ঞতার প্রয়োজন হয় না।

(১১) পরিণমন স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হওয়ায় তার কোনাে প্রয়ােজন নেই। 

(১২) পরিণমন নির্দিষ্ট সময়ভিত্তিক প্রক্রিয়া।

(১৩) পরিণমনের ফলে ব্যক্তির মধ্যে যে পরিবর্তন ঘটে, তা চিরস্থায়ী প্রকৃতির হয়।

(১৪) লিঙ্গভেদে পরিণমনে পার্থক্য দেখা যায়। 

(১৫) পরিণমন নির্দিষ্ট ধারা মেনে চলে।

(১৬) পরিণমনের জন্য কোনাে প্রকার প্রশিক্ষণের প্রয়ােজন হয় না।

Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।

Leave a Comment