ভারততাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি বলতে কী বােঝায় | এই বিষয়ে ভারতীয় সমাজতাত্ত্বিকগণের অবদান আলােচনা কর Class 12 | Sociology (ভারতে সমাজতত্ত্ব) 8 Marks
উত্তর:
ভারতে সমাজতত্ত্বের বিকাশের ক্ষেত্রে ভারততত্ত্ব বিদদের অবদান অনস্বীকার্য। এক্ষেত্রে উল্লেখযােগ্য স্মরণীয় নামগুলি হল উইলিয়াম জোনস, হেনরি মেইন, অ্যালফ্রেড লাইয়েল, ম্যাক্সমুলার প্রমুখ। সংশ্লিষ্ট পণ্ডিতরা ভারতের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ও দার্শনিক ঐতিহ্য অধ্যয়ন-অনুশীলন করেছেন। এই কারণে তাঁরা ভারততত্ত্ববিদ হিসাবে পরিচিত।
ভারততাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি হল ভারতীয় সংস্কৃতি, ইতিহাস, সাহিত্য প্রভৃতির বিচার বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে ভারত তথা ভারতীয় উপমহাদেশ সংলগ্ন দেশগুলির সমাজব্যবস্থা ও তার উপাদানগুলি সম্পর্কে ধারণা গ্রহণ করার দৃষ্টিভঙ্গি। এককথায়, ভারত ও ভারতের সংস্কৃতির অধ্যয়ন-অনুশীলনই হল ভারততত্ত্ব।
ভারতবিদ্যা হল গ্রামীণ ভারতীয় শাস্ত্রসমূহের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ এবং প্রাচীন ভারতের সাংস্কৃতিক সমস্যাসমূহের ভাষাতত্ত্ব সম্পর্কিত আলােচনা। ভারতবিদ্যার সম্পূরক বিষয়গুলি হল সমাজতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব, নৃকুলবিজ্ঞান এবং মুদ্রাবিষয়ক বিদ্যা। উল্লিখিত বিষয়গুলি ভারতবিদ্যার দ্বারা অনুপূরিত হবে। কোনও একক প্রক্রিয়ায় প্রাচীন ভারত সম্পর্কে স্বীকার্য বা কার্যকর সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় না। তারজন্য অপরিহার্য হল সংযুক্ত অভিজ্ঞতাবাদী উদ্যোগ-আয়ােজন।
ভারতীয় সামাজিক প্রতিষ্ঠানসমূহের আলােচনার ক্ষেত্রে ভারততত্ত্ববিদরা প্রাচীন ইতিহাস, মহাকাব্য, ধর্মশাস্ত্র ও পাণ্ডুলিপি ব্যবহার করেন। ভারতীয় সমাজ সম্পর্কে ধারণা লাভের ভারততাত্ত্বিক প্রেক্ষিতে শাস্ত্রীয় উৎসসমূহের অধ্যয়ন-অনুশীলনের উপর জোর দেওয়া হয়। হিন্দু সংস্কৃতির অপরিহার্য উপাদানসমূহ চিহ্নিত করার জন্য ভারততাত্ত্বিক উপাত্তসমূহ ব্যবহার করা হয়। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে সংস্কৃতির উপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়। এই কারণে এই দৃষ্টিভঙ্গিকে বলা হয় “Culturological”। ধ্রুপদী-হিন্দু শাস্ত্রসমূহের অধ্যয়ন-অনুশীলনের মাধ্যমে ভারতীয় সমাজ ও সংস্কৃতির অনুধাবনের চেষ্টা করা হয় বলেই এম. এ. শ্রীনিবাস “ভারততত্ত্ব”কে বলেছেন “The book view”।
ভারততাত্ত্বিক প্রেক্ষিত প্রাচীন ভারতীয় শাস্ত্রসমূহের উপর নির্ভরশীল। এই কারণে এই দৃষ্টিভঙ্গি সামাজিক বিষয়াদি সম্পর্কিত “শাস্ত্রীয় দৃষ্টিভঙ্গি” (textual view) বা “শাস্ত্রীয় প্রেক্ষিত” (textual perspective) হিসাবে পরিচিত। এক্ষেত্রে শাস্ত্র বলতে ধ্রুপদী প্রাচীন শাস্ত্রসমূহের কথা বলা হয়েছে। যেমন— বেদ, উপনিষদ, পুরাণ, মনুস্মৃতি, রামায়ন, মহাভারত প্রভৃতি।
চিরায়ত ভারতীয় শাস্ত্রভিত্তিক ভারতীয় সমাজতত্ত্বের অনুশীলন করেছেন অনেকে। সংশ্লিষ্ট সমাজতাত্ত্বিকদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য হলেন : ইনডেন ও নিকোলাস, মারে, ডেভিড, বারনেট, দাস ও নন্দী, পােকক প্রমুখ। এই প্রেক্ষিত বা দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিদেশী চিন্তাবিদদের দ্বারা বেশকিছু সমাজতাত্ত্বিক গ্রন্থ প্রণীত হয়েছে। উপরিউক্ত সমাজতাত্ত্বিকদের অধিকাংশ রচনা বা আলােচনা প্রকাশিত হয়েছে টি. এন. মদন কর্তৃক সম্পাদিত Contribution to Indian Sociology (New Service) শীর্ষক গ্রন্থে।
ভারততাত্ত্বিক প্রেক্ষিত প্রসঙ্গে নৃকুল-সমাজতত্ত্ব (ethnosociology) সম্পর্কে উল্লেখ আবশ্যক। নৃকুল সমাজতত্ত্বের উদ্দেশ্য হল কোনও মানবগােষ্ঠীর নিজস্ব সংস্কৃতির ভাষা ও শাস্ত্রসমূহ থেকে অর্থ ও প্রতীক, সাংকেতিক ভাষা ও সংক্ষিপ্তসার অনুসন্ধান। এই সময় ভারততাত্বিক প্রেক্ষিত থেকে আলােচিত উল্লেখযােগ্য বিষয়াদি হল— সামাজিক কাঠামাে ও সম্পর্কসমূহ; সাংস্কৃতিক মূল্যবােধ, আত্মীয়তার সম্পর্ক, মতাদর্শ প্রভৃতি।
শাস্ত্রীয় দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে প্রাচ্যবিদ্যাবিদদের প্রেক্ষিত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন বার্নাড কোহন। প্রাচ্যবিদ্যাবিদরা ভারত সম্পর্কে একটি শাস্ত্রীয় দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেন। ভারতীয়, সমাজ সম্পর্কিত প্রাচ্যবিদ্যাবিদদের চিত্রকল্পের মূল কথা হল এই সমাজ স্থির-নিশ্চল এবং সময় ও পরিসরের সীমাহীন (Static, timeless and spaceless)।
১৭৮৪ সালে বাংলায় স্যার উইলিয়াম জোনস প্রতিষ্ঠিত এশিয়াটিক সােসাইটিতে সংস্কৃত ও ভারতবিদ্যার পঠন-পাঠনের ব্যবস্থা হয়। সংস্কৃতের জ্ঞান ভারতের মহান সংস্কৃতি ও সমৃদ্ধ দার্শনিক ঐতিহ্য অনুধাবনে সাহায্য করে। ভারতীয় দর্শন, শিল্পকলা ও সংস্কৃতি সম্পর্কিত ভারততাত্ত্বিক রচনাসমূহের প্রতিফলন ও পরিচয় পাওয়া যায় বিভিন্ন ভারতীয় সমাজতাত্ত্বিকের বৌদ্ধিক ক্রিয়াকর্মে। এঁদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য হলেন— কুমারস্বামী, ধূর্জটীপ্রসাদ মুখার্জী, রাধারমন মুখার্জী, জি.এস. ঘুরে প্রমুখ। সমাজতাত্ত্বিক গবেষণায় ভারততাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ ও অনুসরণ করে রাধারমন মুখার্জী, জি. এস. ঘুরে ও অন্যান্যরা ভারতীয় সমাজতত্ত্বকে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করেছেন।
ভারতীয় সমাজতত্ত্ব এবং সামাজিক নৃতত্ত্বের গঠনমূলক বছরগুলির গােড়ার দিকে ভারততাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গির ব্যবহার বিভিন্ন ভারতীয় সমাজতাত্ত্বিকের রচনাকার্যে পরিলক্ষিত হয়। এঁদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য হলেন— এস. ভি কেতকার, ব্রজেন্দ্রনাথ শীল, বিনয়কুমার সরকার, জি. এস. ঘুরে, কে. এম. কাপাডিয়া, ইরাবতী কারভে প্রমুখ।
ভারতত্ত্বিক ও সংস্কৃতিতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গিকে বিভিন্ন সমাজতাত্ত্বিক প্রধান বিষয় হিসাবে গ্রহণ করেছেন। ভারতীয় সমাজের অনুশীলনের ভিত্তি হিসাবে সাকসেনা (R. N. Saxena, 1965) ভারততাত্ত্বিক ও শাস্ত্রীয় ভিত্তির ব্যাপারে সহমত পােষণ করেছেন। ভারতবিদ্যা তাৎপর্যপূর্ণভাবে জনসাধারণের আচার-ব্যবহারকে পরিচালিত করে। ভারতীয় সমাজতত্ত্বে ভারতবিদ্যার গুরুত্ব সম্পর্কে ডুমন্ট ও পােকক বলেছেন : “In Principle, a Sociology of India lies at the Point of Confluence of Sociology and Indology.”
ইরাবতী কারভে তার সমাজতাত্ত্বিক লেখালেখিতে ভারততাত্ত্বিক উপাদানসমূহকে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেছেন। শ্রীনিবাস ও পাণিনির অভিমত অনুযায়ী শ্রীমতী কারভের লেখা গ্রন্থ “Kinship Organisation in India (1952)” ভারতের আত্মীয়তার সম্পর্ক ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে অন্যতম নির্ভরযােগ্য গ্রন্থ।
Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।