কার্য-কাঠামাে দৃষ্টিভঙ্গি বলতে কী বােঝ? কার্য-কাঠামােগত দৃষ্টিভঙ্গিতে ভারতীয় সমাজচর্চায় ভারতীয় সমাজতাত্ত্বিকগণের ভূমিকা উল্লেখ কর।

কার্য-কাঠামাে দৃষ্টিভঙ্গি বলতে কী বােঝ? কার্য-কাঠামােগত দৃষ্টিভঙ্গিতে ভারতীয় সমাজচর্চায় ভারতীয় সমাজতাত্ত্বিকগণের ভূমিকা উল্লেখ কর। Class 12 | Sociology (ভারতে সমাজতত্ত্ব) 8 Marks

উত্তর:

যে দৃষ্টিভঙ্গিতে সমগ্র সমাজকাঠামাের সাথে সংযুক্ত বিভিন্ন অংশের পারস্পরিক সম্পর্ক, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ধরণ বিশ্লেষিত হয়ে থাকে, তাকে কার্য-কাঠামােগত দৃষ্টিভঙ্গি বলা হয়। ভারতীয় সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি, ধ্যান-ধারণা ও সামাজিক ঘটনাসমূহ ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে কার্য-কাঠামােগত তত্ত্ব (Structural-functional theory) এ প্রসঙ্গে বিশেষ উল্লেখযােগ্য। এই তত্ত্বের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতাদ্বয়, বিশিষ্ট নৃতাত্ত্বিক এবং সমাজতত্ত্ববিদ র‍্যাডক্লিফ ব্রাউন ও বি. ম্যালিনাউস্কি আদিম উপজাতিদের উপর পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালােচনা করে তাদের আচার-আচরণের যাবতীয় কার্যধারা বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে সামাজিক সংহতির প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছেন। পরবর্তীকালে মার্কিন সমাজতত্ত্ববিদ ট্যালকট পারসন (Talcott Persons) সমাজ সমীক্ষার ক্ষেত্রে এই তত্ত্ব ব্যবহার করে বিশেষ উপকৃত হন।

সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোন থেকে কাঠামােগত-কার্যনির্বাহী তত্ত্বের উদ্দেশ্য হল সমাজের নানাবিধ আবশ্যিক কার্যনির্বাহী দিকগুলিকে চিহ্নিত করা।

অধ্যাপক রাম আহুজা (Ram Ahuja) তার Society in India গ্রন্থে এই অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে, ভারতের ঐতিহ্যবাদী সমাজের সমাজতাত্ত্বিক অধ্যয়ন-অনুশীলনে ত্রিবিধ প্রেক্ষিত প্রযুক্ত হতে পারে। সেগুলি হল : ক্রিয়াবাদী (Functionalist), মার্কসবাদী (Marxist) এবং সামাজিক ক্রিয়া (Social action)।

ডুকহেইম-এর ক্রিয়াবাদী প্রেক্ষিত অনুসারে পরিবার, আত্মীয়তার সম্পর্ক অর্থনীতি প্রভৃতি মুখ্য সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও উপব্যবস্থাসমূহ মানুষের মৌলিক প্রয়ােজনসমূহ পূরণের জন্যই গড়ে উঠেছে এবং সমাজে অব্যাহত আছে। মার্কসীয় প্রেক্ষিত পৃথক একটি দৃষ্টিভঙ্গির উপর প্রতিষ্ঠিত। এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী শ্রেণীসংঘাত হল একটি মৌলিক সামাজিক শক্তি। সংঘাতের সামিল শ্রেণীসমূহ সমাজের ক্রিয়াকর্মকে প্রভাবিত করে। ওয়েববারের (Max Weber) সামাজিক ক্রিয়ামূলক প্রেক্ষিত অনুযায়ী ব্যক্তিবর্গ সমাজ সৃষ্টি করে এবং সমাজকে প্রভাবিত করে; সমাজ ব্যক্তিবর্গকে সৃষ্টি বা প্রভাবিত করে না।

কাঠামােগত সমাজতাত্ত্বিকেরা বিশেষ ধরনের সমাজতাত্ত্বিক বিষয়াদির আলােচনায় আগ্রহী। সমাজে ব্যক্তিবর্গের অভিপ্রেত আচরণ কি কি বিষয়ের দ্বারা প্রভাবিত বা নিয়ন্ত্রিত হয় সেগুলি আলােচনায় কাঠামােগত সমাজতাত্ত্বিকদের আগ্রহী হতে দেখা যায়। সংশ্লিষ্ট বিষয়াদির মধ্যে উল্লেখযােগ্য হল ধর্মীয় বিশ্বাস ও মূল্যবােধ, পরিবার ও জাতি-গােষ্ঠীর জাত ও শ্রেণী, বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদিতা, যন্ত্রপাতি ও শিল্প-অর্থনীতি প্রভৃতি।

বিশিষ্ট গবেষক রিচার্ড ডি. ল্যামবার্ট (R. D. Lambert) ভারতীয় সমাজজীবনের আধুনিকীকরণের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হিসাবে আধুনিক শিল্পায়নের গুরুত্বপূর্ণ অবদানের কথা উল্লেখ করেছেন। চুক্তিবদ্ধ উৎপাদন ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে প্রাথমিক গােষ্ঠীগুলি কেমন করে জটিল শ্রমবিভাজন দ্বারা জটিলতর- কেমন করে আরােপিত সামাজিক মর্যাদাগুলি অর্জিত সামাজিক মর্যাদায় স্থানান্তরিত হচ্ছে। ফলশ্রুতি হিসাবে সমাজে মর্যাদাভিত্তিক ক্রমােচ্চ বিন্যাস, প্রাথমিক গােষ্ঠীর দায়িত্ব কমে গিয়ে গৌণগােষ্ঠীর প্রাধান্য প্রভৃতি উপাদানগুলিকে কার্য-কাঠামােগত পরিবর্তনরূপে উপস্থাপিত করেছেন।

মুষ্ঠিমেয় ভারতীয় সমাজতাত্ত্বিক কার্য-কাঠামােগত তত্ত্বের উপর ভারতীয় সমাজ কাঠামাের পরিবর্তিত গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে পর্যালােচনায় সক্ষম হয়েছেন। এদের মধ্যে এস. সি. দুবে (S, C. Dube) এবং অধ্যাপক এম. এন. শ্রীনিবাস (M. N. Srinivas) অন্যতম। তারা মূলত ভারতীয় জাতিভেদ প্রথা, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, ধর্মীয় আচরণবিধি এবং ভারতীয় সমাজে পাশ্চাত্য প্রভাব প্রভৃতির উপর গুরুত্ব আরােপ করে ভারতীয় সমাজ কাঠামাের পরিবর্তনশীলতাকে তুলে ধরেছেন।

ভারতীয় সমাজতত্ত্বের আলােচনায় কাঠামােগত-কার্যগত প্রেক্ষিতের প্রয়ােগকারী হিসাবে শ্রীনিবাস বিশেষভাবে পরিচিত। র‍্যাডক্লিফ ব্রাউন (Radcliffe Brown) ও তার তাত্ত্বিক কাঠামােগত প্রেক্ষিত হিসাবে কাঠামােগত-কার্যগত দৃষ্টিভঙ্গির জন্য সুপরিচিত। 

শ্রীনিবাসের Religion and Society Among the Coorgs of South India শীর্ষক ক্ষেত্র সমীক্ষামূলক বিখ্যাত রচনাটি অভিন্ন প্রকৃতির তাত্ত্বিক কাঠামাের উপর ভিত্তিশীল। আচারানুষ্ঠান এবং সামাজিক সংহতির মধ্যে পারস্পরিক জটিল সম্পর্ক উল্লিখিত গ্রন্থটিতে সহজ-সরলভাবে অভিব্যক্ত হয়েছে। তার এই বিখ্যাত রচনাটি হল আসলে স্থানীয় একটি জনসম্প্রদায়কে নিয়ে একটি কাঠামােগত সমাজতাত্ত্বিক পর্যালােচনা। অধ্যাপক শ্রীনিবাস বিভিন্ন সমাজ প্রতিষ্ঠানের কাঠামােগত এবং কার্যনির্বাহী ক্রিয়া-প্রক্রিয়া বিশ্লেষণ করে ভারতীয় সমাজে সংস্কৃতায়ন, পশ্চিমীকরণ, আধুনিকীকরণ এবং ধর্মনিরপেক্ষতার তাৎপর্য ব্যাখ্যা করেছেন। তার পর্যালােচনার মধ্য দিয়ে ভারতীয় সমাজ কাঠামাের পরিবর্তনশীলতার দিকগুলি বৃহত্তর বুদ্ধিজীবী মহলকে কেবল আকৃষ্ট করেনি, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তার পর্যালােচনা বিশেষ প্রশংসা প্রাপ্ত হয়েছে।

Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।

Leave a Comment