দ্বন্দ্বমূলক প্রেক্ষিত কাকে বলে? দ্বন্দ্বমূলক প্রেক্ষিত বা দ্বান্দ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে বিস্তারিত আলােচনা কর।

দ্বন্দ্বমূলক প্রেক্ষিত কাকে বলে? দ্বন্দ্বমূলক প্রেক্ষিত বা দ্বান্দ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে বিস্তারিত আলােচনা কর। Class 12 | Sociology (ভারতে সমাজতত্ত্ব) 8 Marks

উত্তর:

দুটি পরস্পরবিরােধী শক্তির সংঘাতজনিত প্রক্রিয়াকে দ্বন্দ্ববাদ বা দ্বান্দ্বিকতা বলে। সমাজে সব কিছুর বিকাশ তার অন্তর্নিহিত দ্বান্দ্বিকতার ফলেই ঘটে থাকে। সামাজিক বাস্তবতার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে দ্বন্দ্বমূলক প্রেক্ষিত বিশেষভাবে অর্থবহ। দ্বন্দ্বমূলক ঐতিহাসিক অভিযােজন প্রাথমিকভাবে মার্কসবাদী উপায়-পদ্ধতির সঙ্গে সংযুক্ত। সমাজতাত্ত্বিক যােগেন্দ্রসিং (2008) মার্কসীয় দ্বন্দমূলক দৃষ্টিভঙ্গি কথাটির পরিবর্তে শুধু দ্বন্দ্বমূলক দৃষ্টিভঙ্গি কথাটি ব্যবহার করেছেন। কারণ ভারতীয় সমাজতত্ত্বের ক্ষেত্রে বিভিন্ন অবলম্বনমূলক মডেল মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গির অন্তর্ভুক্ত।

“Dialectic”—এই ইংরেজি শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ Dialogo থেকে। যার অর্থ হল আলাপ-আলােচনা বা তর্ক-বিতর্ক। দুটি পরস্পরবিরােধী শক্তির সংঘাতজনিত প্রক্রিয়াকে দ্বন্দ্ববাদ বা দ্বান্দ্বিকতা (dialectics) বলে। এই দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়ার কথা প্রথম বলেন ভাববাদী জার্মান দার্শনিক হেগেল। হেগেলের মতানুসারে সবকিছুর বিকাশ তার অন্তর্নিহিত দ্বান্দ্বিকতার ফলেই ঘটে থাকে।

ভারতীয় সমাজ-বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে সমাজ ধারাবাহিকতার ইতিহাস পর্যালােচনার মধ্য দিয়ে বিভিন্ন তাত্ত্বিক বিভিন্ন পন্থা-পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন। এক্ষেত্রে বিশিষ্ট রাষ্ট্রনীতিবিদ এবং তাত্ত্বিক কালমার্কস অনুসৃত দ্বন্দ্ব তত্ত্বের একটা গুরুত্বপূর্ণ অবদান আছে। প্রসঙ্গত মার্কস সমাজ বিবর্তনের অন্যান্য তত্ত্বগত দৃষ্টিভঙ্গিকে দূরে রেখে বহু সমালােচনা সত্ত্বেও দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিকেই পাথেয় করেছেন। দ্বান্দ্বিক দৃষ্টিভঙ্গির অন্যতম গতিশক্তি হল বাদ, প্রতিবাদ এবং সম্বাদ (Thesis, Antithesis and Synthesis)-এর ক্রমান্বয়িক দ্বন্দ্বশীল প্রক্রিয়া। মার্কস বলেছেন সমাজে অবস্থিত দ্বন্দ্ব বস্তুজগতের অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপের সঙ্গে যুক্ত। এক্ষেত্রে তিনি হেগেলীয় ভাববাদী দৃষ্টিভঙ্গির আশ্রয় নিলেও তিনি ভাববাদের দিক পরিহার করে বস্তুজগতের বাস্তব চিন্তাভাবনাকে প্রাধান্য দিয়েছেন।

দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদী ধারণার পরিপ্রেক্ষিতে কার্ল মার্কস সমাজবাদকে বৈজ্ঞানিক নির্দিষ্টতাযুক্ত করেছেন। দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদী মতাদর্শের ভিত্তিতে সমাজবাদের প্রায়ােগিক ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক ও সামাজিক প্রগতির ব্যাখ্যার ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছে। এই মতবাদে মার্কসের অভিমত অনুযায়ী সামাজিক পরিবর্তন আর্থিক কারণেও হয়। সুতরাং মার্কসীয় এই মতবাদ “ইতিহাসের আর্থনীতিক ব্যাখ্যা” হিসাবে আখ্যায়িত হওয়াই সঠিক। বৈজ্ঞানিক সমাজবাদের প্রবর্তন ও পৃষ্ঠপােষকতার লক্ষ্যে কার্ল মার্কস ইতিহাসের দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদী ধারণা প্রয়ােগ করেছেন। তিনি মানবসমাজের দ্বন্দ্বমূলক আর্থনীতিক বা বস্তুবাদী ব্যাখ্যা দিয়েছেন।

১৯৩০-র পরবর্তী সময়ে ভারতবর্ষে মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রভাব উত্তরােত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। বিশিষ্ট বাঙ্গালী চিন্তাবিদ এবং মার্কসবাদী দ্বন্দ্বের অন্যতম পৃষ্ঠপােষক গােপাল হালদার “সংস্কৃতির রূপান্তর” নামক গ্রন্থ রচনা করে ভারতীয় সমাজ ও সংস্কৃতির বিকাশ ধারাকে স্বতন্ত্র পথে ব্যাখ্যা করেন। পরবর্তীতে বিশিষ্ট ভারতীয় সমাজতাত্ত্বিক ও লখনউ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ধূর্জটিপ্রসাদ মুখােপাধ্যায় (D.P.) এই ধারা অনুসরণ করে সমাজ বিকাশের গতি প্রকৃতি পর্যালােচনা করেছেন। পরবর্তীকালে দ্বন্দ্ব তত্ত্বের প্রেক্ষাপটে ভারতীয় সমাজতত্ত্বের পর্যালােচনায় বহু বিশিষ্ট সমাজতাত্ত্বিক নিয়ােজিত বা সামিল হয়েছেন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য হলেনঃ রামকৃষ্ণ মুখার্জী, ডি. পি. মুখার্জী, অম্লান দত্ত, ডি. ডি. কোশাম্বি, কে. এস. কাপাডিয়া, এ আর দেশাই, ইরফান হাবিব প্রমুখ।

অধ্যাপক এ. আর. দেশাই ভারতীয় সমাজতাত্ত্বিক আলােচনায় দ্বন্দ্বমূলক-ঐতিহাসিক (dialectical historical) মডেল সমর্থন করেছেন ও প্রয়ােগ করেছেন। আর একজন দ্বন্দ্বতাত্ত্বিক পৃষ্ঠপােষক ডি. ডি.কুসাম্বি মনে করেন, শ্রেণীগত দৃষ্টিকোন থেকে ভারতীয় সমাজের ইতিহাস হচ্ছে উৎপাদনের উপকরণ এবং উৎপাদন সম্পর্কে এক পর্যায়ক্রমিক বিবর্তনের ইতিহাস। ভারতের বঞ্চিত শ্রেণীসমূহ সম্পর্কে অধ্যয়ন-অনুশীলন ছিল এ. আর. দেশাই-এর আগ্রহের বিষয় স্বভাবতই তিনি মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গিকেই সমর্থন করেছেন। তাঁর রচিত গ্রন্থ Social Background of Indian Nationalism বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। এই গ্রন্থটি কার্ল মার্কস-এর দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের উপর প্রতিষ্ঠিত। D.P.-র মতে ভারতীয় সমাজে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আবির্ভাবের অন্তরালে মার্কসবাদী দ্বন্দ্বতত্ত্বের স্থায়িত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। D.P.-র মতে পরম্পরা ও অগ্রগতির মধ্যে সংঘাত ও স্থিতিশীলতার সমন্বয় সাধনই হল দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির শেষ কথা।

Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।

Leave a Comment