ধর্মনিরপেক্ষীকরণ বলতে কী বােঝায়? ধর্মনিরপেক্ষীকরণের বিভিন্ন উপাদান বা কারণগুলি আলােচনা কর।

ধর্মনিরপেক্ষীকরণ বলতে কী বােঝায়? ধর্মনিরপেক্ষীকরণের বিভিন্ন উপাদান বা কারণগুলি আলােচনা কর।  Class 12 | Sociology (ভারতীয় সমাজ) 8 Marks

উত্তর:

ধর্মনিরপেক্ষীকরণ বলতে বােঝায় ধর্মের মূল আদর্শ অনুসরণ করে অন্য কোন ধর্ম সম্পর্কে বৈরীতা বা অপর ধর্মের প্রতি অসহিষ্ণুতামূলক মনােভাব থাকবে না। সব ধর্মের সমান মর্যাদা থাকবে এবং রাষ্ট্র বা সরকারের কাছে কোনও ধর্ম বা ধর্মাবলম্বী মানুষ বিশেষ সুযােগ-সুবিধা পাবেন না।

ধর্মনিরপেক্ষকরণের বিভিন্ন উপাদান বা কারণ ভারতীয় প্রেক্ষিত (Factors of Seculerization Indian Perspective) : ধর্মনিরপেক্ষতায়নের অনুঘটক হিসাবে বহু ও বিভিন্ন উপাদান উল্লেখযােগ্য ভূমিকা পালন করে। সংশ্লিষ্ট উপাদানসমূহের মধ্যে কতকগুলি বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য।

১) আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার বিস্তার : আধুনিক শিক্ষার বিকাশ ও বিস্তারের পরিপ্রেক্ষিতে ধর্মনিরপেক্ষ ধান-ধারণা বিশেষভাবে শক্তিশালী হয়েছে। আধুনিক শিক্ষার সম্প্রসারণের সুবাদে ধর্মনিরপেক্ষতায়ন প্রক্রিয়া জোরদার হয়েছে। আধুনিক শিক্ষাদীক্ষা মানবিক মূল্যবােধসমূহকে মানুষের মধ্যে সঞ্চারিত করে। গণতান্ত্রিক মতাদর্শ ও মূল্যবােধসমূহ আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার সুবাদে বিকশিত ও সম্প্রসারিত হয়। এ ধরনের শিক্ষার বিস্তার জনসাধারণের মধ্যে যুক্তিবাদী মন, প্রগতিশীল মানসিকতা এবং বিজ্ঞানভিত্তিক চিন্তাচেতনার সৃষ্টি করে। তারফলে ধর্মীয় কুসংস্কারসমূহ হীনবল হয়ে পড়ে। যাবতীয় ধর্মীয় গোঁড়ামির অন্ধকার কেটে যায়।

২) পশ্চিমী সংস্কৃতি : পশ্চিমী সংস্কৃতি প্রগতিশীল প্রকৃতির বলে পরিগণিত হয়। পশ্চিমী সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্যসূচক বিষয় হিসাবে উল্লেখযােগ্য হল ও বস্তুবাদ, বিজ্ঞানমনস্কতা, ধর্ম-নিরপেক্ষতা, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ প্রভৃতি। এ জাতীয় সংস্কৃতির উপাদানসমূহ অনেকাংশে ভারতীয় জনজীবনে অনুপ্রবিষ্ট হয়েছে। তারফলে ভারতীয় জীবনধারা অনেকক্ষেত্রে ধর্মনিরপেক্ষ হয়েছে। পশ্চিমী সংস্কৃতির প্রভাবে এ দেশের বিবাহব্যবস্থা ও পরিবারব্যবস্থা অনেকাংশে পরিবর্তিত হয়েছে। পশ্চিমী সংস্কৃতি ভারতীয় রাজনীতিক ব্যবস্থা ও আর্থনীতিক ব্যবস্থাকে ধর্মীয় প্রভাব থেকে অনেকাংশে মুক্ত করেছে।

৩) নগরায়ণের প্রক্রিয়া : শিল্পায়নের হাত ধরে ভারতে নগরায়ণের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। নগরায়ণ ধর্মনিরপেক্ষতায়নের সহায়ক। নগরাঞ্চলেই ধর্মনিরপেক্ষতায়নের অনুকূল উপাদানসমূহ অধিক মাত্রায় বর্তমান থাকে। শহরাঞলেই ধর্মনিরপেক্ষতায়নের প্রক্রিয়া অধিকমাত্রায় সক্রিয় থাকতে দেখা যায়।

৪) শিল্পায়ন প্রক্রিয়া : শিল্পায়ন প্রক্রিয়া ধর্মনিরপেক্ষতায়নের অন্যতম অনুঘটক। কলকারখানার পরিবেশ- পরিমণ্ডল ধর্মনিরপেক্ষতায়নের সহায়ক। এ জাতীয় পরিবেশে জাত-পাত নির্বিশেষে সকলে  একসঙ্গে ক্রিয়াকর্ম সম্পাদনের সামিল হয় l 

৫) যােগাযােগ ব্যবস্থার বিকাশ ও বিস্তার : আধুনিক কালে যােগাযােগ ও পরিবহণব্যবস্থার অভাবিত উন্নতিসাধিত হয়েছে। ট্রেনে-বাসে মানুষের যাতায়াত ও সচলতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ট্রেনে-বাসে যাত্রীদের মধ্যে ধর্মীয় গােড়ামি, জাতিগত ভেদাভেদ, পারস্পরিক ভুল বােঝাবুঝি এসব থাকে না। মিলেমিশে সকলে যাতায়াত করে। তার ফলে পারস্পরিক সামাজিক দূরত্ব হ্রাস পায়। এবং উদারনীতিক ও প্রগতিশীল সামাজিকতা শক্তিশালী হয়।

৬) সংস্কার আন্দোলন :  ভারতে সামাজিক ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে বিভিন্ন সময়ে বহু সংস্কার আন্দোলন সংঘটিত হয়েছে। এ জাতীয় আন্দোলনের সুবাদে বিবিধ ধর্মীয় কুসংস্কার ও গোঁড়ামি হীনবল হয়েছে এবং ধর্মনিরপেক্ষতায়ন প্রক্রিয়া শক্তিশালী হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সংস্কার আন্দোলনসমূহ আধুনিক, প্রগতিশীল ও উদারনীতিক চিন্তা-চেতনাকে পরিপুষ্ট করেছে। তার ফলে ধর্মনিরপেক্ষতায়ন শক্তিশালী হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সামাজিক ও ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনসমূহে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন অনেকে। তারমধ্যে কয়েকজনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। এরা হলেন : রাজা রামমােহন রায়, স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী, স্বামী বিবেকানন্দ, পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, সৈয়দ অহমেদ খান, ভিভিয়ান ডিরােজিও, কেশবচন্দ্র সেন প্রমুখ।

৭) ভারতীয় সংবিধান : পুণ্যভূমি ভারতে সকল ধর্মই সমান। বিভিন্ন ধর্ম ও ধর্মীয় গােষ্ঠীর মধ্যে সদ্ভাব-সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য ভারতে ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ স্বীকার ও কার্যকর করা হয়েছে। রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরােপের জন্য ১৯৭৬ সালের বিয়াল্লিশতম সংবিধান সংশােধনের মাধ্যমে প্রস্তাবনায় “ধর্মনিরপেক্ষ’ শব্দটি যুক্ত করা হয়েছে। সংবিধানের ২৫-২৮ ধারার মধ্যে ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকারকে মৌলিক অধিকারের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে।

১১) আইনমূলক উদ্যোগ : ভারতে ধর্মনিরপেক্ষিকরণ প্রক্রিয়ার সহায়ক বহু আইন বিভিন্ন সময় প্রণীত হয়েছে। স্বাধীনতাপ্রাপ্তির পর ত বটেই তার আগেও এরকম বহু আইন প্রণীত হয়েছে। এইরকম আইনের উদাহরণ হিসাবে উল্লেখযােগ্য হল ও বিধবা পুনর্বিবাহ আইন (১৮৫৬), বিশেষ বিবাহ আইন (১৮৭২), হিন্দু বিবাহ আইন (১৯৫৫), হিন্দু উত্তরাধিকার আইন (১৯৫৬) প্রভৃতি। উল্লিখিত আইনসমূহের সুবাদে পরিবারব্যবস্থা, বিবাহব্যবস্থা, জাতব্যবস্থা প্রভৃতি ক্ষেত্রে অর্থবহ পরিবর্তন সূচিত হয়।

Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।

Leave a Comment