বেকারত্ব বলতে কী বােঝ? ভারতে বেকার সমস্যার কারণগুলি আলােচনা কর

বেকারত্ব বলতে কী বােঝ? ভারতে বেকার সমস্যার কারণগুলি আলােচনা কর Class 12 | Sociology (সাম্প্রতিক কালের সামাজিক বিচার্য বিষয়) 8 Marks

উত্তর:

বেকারত্বের অর্থ : সকল দেশের আর্থনীতিক ব্যবস্থাতেই সাধারণত দু’ধরনের বেকারত্ব পরিলক্ষিত হয়: (১) ইচ্ছামূলক বেকারত্ব এবং (২) অনিচ্ছামূলক বেকারত্ব। দেশের প্রচলিত মজুরিকাঠামােতে কাজ থাকার অবস্থায়ও কিছু মানুষ কাজ করতে চায় না। এরাই ইচ্ছামূলক বেকার হিসাবে বিবেচিত হয়। বিপরীতক্রমে দেশের প্রচলিত মজুরিকাঠামােতে কাজ করতে আগ্রহী থাকা অবস্থায়ও অনেক মানুষ কাজ পায় না। এদের বলা হয় অনিচ্ছাকৃত বেকার। ইচ্ছামূলক বেকারত্ব কোনাে দেশেরই আর্থনীতিক ব্যবস্থায় সমস্যা হিসাবে দেখা দেয়। কারণ এ রকম ইচ্ছামূলক বেকারের সংখ্যা কোনাে দেশেই তেমন উল্লেখযােগ্য নয় এবং তাই কোনাে সমস্যারও সৃষ্টি করে না। বস্তুত বেকার সমস্যা সম্পর্কিত আলােচনায় এই অনিচ্ছামূলক বেকারত্বের কথাই বলা হয়।

বিভিন্ন সংজ্ঞা : দেশের বিদ্যমান মজুরিকাঠামােতে কাজ করতে আগ্রহী ব্যক্তি কাজ না পেলে তাকে বলা হয় বেকার। একেই বলে কর্মে অনিয়ােগ বা বেকারত্ব। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (ILO— International Labour Organisation)-র সংজ্ঞা অনুযায়ী সপ্তাহে (পাঁচ দিনে) কোনাে ব্যক্তি পনেরাে ঘণ্টা (দু’দিনে) সবেতন কাজে নিযুক্ত থাকলে, সেই ব্যক্তি বেকার হিসাবে বিবেচিত হবে না। কিন্তু বেকারত্ব সম্পর্কিত এই সংজ্ঞা কেবল উন্নত দেশসমূহের ক্ষেত্রেই প্রাসঙ্গিক; ভারতের মত উন্নয়নশীল দেশসমূহের ক্ষেত্রে নয়। কারণ উন্নয়নশীল এই সমস্ত দেশে বেকারদের জন্য কোনােরকম জীবনবিমার সরকারি সুযােগসুবিধা অনুপস্থিত। ভারতের পরিকল্পনা কমিশনের ভাষ্য অনুযায়ী কোনাে নারী বা পুরুষ ছ’মাস কর্মহীন অবস্থায় থাকলে, তাকে প্রান্তিক বেকার’ (marginally unemployed) বলা হবে।

পরিপূর্ণ আর্থনীতিক দৃষ্টিকোণ থেকে কার্ল ব্রিাম (Karl Pribram) বেকারত্বের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন: শ্রমবাজারে কাজের যােগানের থেকে শ্রমের অধিকতর যােগানের অবস্থাই হল বেকারত্ব। সমাজবিজ্ঞানী ফেয়ারচাইল্ড (Fairchild) সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এ বিষয়ে বলেছেন; বেকারত্ব হল জোর করে ও অনিচ্ছাকৃতভাবে সবেতন কর্মনিয়ােগ থেকে বিচ্ছিন্নকরণ। স্বাভাবিক শ্রমশক্তির ক্ষেত্রে, স্বাভাবিক শ্রম-সময়ে, স্বাভাবিক মজুরিতে এবং স্বাভাবিক অবস্থায় এই বিচ্ছিন্নকরণ ঘটে (“Unemployment 1S forced and involuntary separation from remunerative work on the part of the normas working force during normal working time, at normal wages and under norma. conditions.”)। সাধারণভাবে বলা হয়েছে যে কাজ করার ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও কাজ না পাওয়ার অবস্থা 

হল বেকারত্ব। অধ্যাপক পিগাে (A. C. Pigo) তার Unemployment শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন: “Unemployment means unemployment among the wage-earning classes and in respect of wage work only” সমাজবিজ্ঞানী ডি মেল্লো (D’Mello) দিল্লিতে এক সেমিনার বক্তৃতায় (August, 1969) বেকারত্বের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন: “Unemployment is a condition in which an individual is not in a state of remunerative occupation despite his desire to do so. অর্থাৎ বেকারত্ব হল একটি অবস্থা। সংশ্লিষ্ট অবস্থায় ও কর্মপ্রবণতার অস্তিত্ব সত্ত্বেও কোনাে ব্যক্তি মজুরির। বিনিময়ে কর্মপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত থাকে। 

ভারতে বেকার সমস্যার কারণ (Causes of Unemployment in India)

ভারতে বেকার সমস্যার পিছনে বিবিধ কারণ ক্রিয়াশীল। সংশ্লিষ্ট কারণসমূহের মধ্যে কতকগুলি। বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য।

(১) জনসংখ্যা বৃদ্ধির দ্রুত হার : দ্রুত হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে দেশের সীমাবদ্ধ সম্পদ-সামগ্রী বিপুল জনসংখ্যার ভরণপােষণের জন্য ব্যয়িত হয়। অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপে মূলধন সুনিদিষ্টভাবে বণ্টন করা যায় না। স্বভাবতই কর্মসংস্থান সৃষ্টির হারও প্রতিহত হয়। অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপে বেকার সমস্যা তীব্রতর হয়। ” 

(২) আর্থনীতিক উন্নয়নের কম হার : আর্থনীতিক উন্নয়নের হারের উপর দেশের কর্মসংস্থানের সুযােগসুবিধা নির্ভরশীল। দেশের আর্থিক প্রগতি ঘটলে কর্মসংস্থানের সুযােগ বাড়ে এবং বেকারত্ব হ্রাস পায়। দেশের জনসংখ্যা ও কর্মপ্রার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে অতি দ্রুতহারে। কিন্তু কর্মসংস্থানের সুযােগ হয়েছে অপেক্ষকৃত কম হারে। ক্রমবর্ধমান কর্মপ্রার্থীর জন্য প্রয়ােজনীয় কর্মসংস্থান পরিকল্পনাকালে সৃষ্টি করা যায়নি। তারফলে বেকারত্ব বেড়েছে।

(৩) শিল্পক্ষেত্রের সীমাবদ্ধতা : ভারতের শিল্পক্ষেত্রে বিবিধ সীমাবদ্ধতা বর্তমান। শিল্পক্ষেত্রের উৎপাদনক্ষমতার পরিপূর্ণ ব্যবহার করা সম্ভব হয় না। তারফলে কর্মসংস্থানের সুযােগ-সুবিধা বৃদ্ধি করা সম্ভব হয় না। বিংশ শতাব্দীর সাতের দশক থেকে শিল্পে রুগ্নতার সৃষ্টি হয় । তারফলে বেকারসমস্যাজনিত সংকট বৃদ্ধি পেতে থাকে।

(৪) অনুসৃত প্রযুক্তি অনুপযুক্ত : ভারতে তুলনামূলক বিচারে শ্রমিক সুলভ এবং মূলধন মহার্ঘ। সুতরাং ভারতে শ্রম-নিবিড় প্রযুক্তি ব্যবহার করাই যথাযথ। কিন্তু এদেশে শ্রমনিবিড় প্রযুক্তির পরিবর্তে শ্রমসাশ্রয়কারী মূলধননির্ভর প্রযুক্তি ব্যবহার করার প্রবণতা প্রবল। শিল্পের ক্ষেত্রে ত’ বটেই, আজকাল কৃষিক্ষেত্রেও মূলধননির্ভর প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে ব্যাপকভাবে। স্বভাবতই কর্মসংস্থান বৃদ্ধির সুযােগ-সুবিধা হ্রাস পাচ্ছে। ভারতে মূলধন নিবিড় প্রযুক্তি প্রয়ােগ করা হচ্ছে এবং ভারী ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পের উপর জোর দেওয়া হচ্ছে। তারফলে আর্থনীতিক অগ্রগতির পথ প্রশস্ত হচ্ছে, কিন্তু কর্মসংস্থানের সুযােগ-সুবিধা হ্রাস পাচ্ছে।

(৫) জাতীয় কর্মসংস্থান নীতির অনস্তিত্ব ; স্বাধীন ভারতে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সূত্রপাতের সময় থেকে কর্মসংস্থানের ব্যাপারে সঠিক নীতি নির্ধারিত ও গৃহীত হয়নি। মানবসম্পদের সম্যক ও সঠিক ব্যবহারের ব্যাপারে যথাযথ নীতি বা কর্মসূচী নির্ধারিত বা গৃহীত হয়নি। ভারতে বেকারের সংখ্যা বিশাল। কর্মপ্রার্থীর সংখ্যা বিপুল। তাদের কর্মসংস্থানের জন্য আবশ্যক হল দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার। তা কিন্তু গ্রহণ করা হয়নি। স্বভাবতই বেকার সমস্যা ক্রমবর্ধমান।

(৬) শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটিবিচ্যুতি : স্বাধীন ভারতের বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থা ত্রুটিপূর্ণ; বিবিধ সীমাবদ্ধতার শকার। এই শিক্ষাব্যবস্থা বাস্তবতাবর্জিত ও কেতাবি। ভারতীয় অর্থনীতির প্রয়ােজনীয়তা এবং দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার উদ্দেশ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থার পরিকল্পনা করা হয়নি।

(৭) কৃষিব্যবস্থার প্রকৃতি-নির্ভরতা : প্রকৃতি-নির্ভরতার কারণে কৃষিকর্মে সারাবছর কৃষিজীবীদের। মসংস্থানের ব্যবস্থা হয় না। তারফলে কৃষকদের মধ্যে মরসুমি বেকারত্বের সৃষ্টি হয়। তা ছাড়া গ্রামাঞ্চলে কৃষিকার্যের বাইরে কর্মনিযুক্তির বিকল্প ব্যবস্থা অমিল।

(৮) বর্ধিত শ্রমশক্তি : বেকারত্ব বৃদ্ধির পিছনে আর একটি বড় কারণ হল শ্রমশক্তি বৃদ্ধি। অত সাধারণভাবে কাজের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির বা মনােভাবের পরিবর্তন ঘটেছে। সাম্প্রতিককালে মহিলারাও সংখ্যায় ঘরের বাইরে পা রেখেছে কাজ করতে বা কর্মনিযুক্তির সন্ধানে। আবার গ্রামাঞ্চলের প্রচ্ছন্ন বেকারতos শহরাঞ্চলে এসে প্রকাশ্যে কর্মপ্রার্থীর দল ভারি করছে। গ্রামাঞ্চলের বেকারত্বের উপচে পড়া অংশ শহee বেকার বাহিনীর সামিল হচ্ছে। সামগ্রিক বিচারে কর্মপ্রার্থীর মােট সংখ্যা বাড়ছে ব্যাপকভাবে। কি অনুপাতে কর্মসংস্থানের সুযােগ বাড়ছে না। স্বাভাবিকভাবে বেকারত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে বিশেষভাবে।

(৯) দারিদ্র্য : দারিদ্র্য এবং বেকারত্ব পরস্পরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে সম্পর্কিত। জাতীয় নমনা স. সংস্থা (NSSO)-র প্রতিবেদন ও পরিসংখ্যান (৩২তম পর্যায়) অনুযায়ী বেকারত্ব বেশি দরিদ্রদের মধ্যেই। গ্রামাঞ্চলের অধিবাসীদের মধ্যে বেকারত্বের হার অধিক। কারণ গ্রামাঞ্চলের অধিবাসীদের মধ্যে দরিদ্র অধিক।

(১০) অন্যান্য কারণ : ভারতে বেকারসমস্যাকে অধিকতর তীব্র করে তােলার পিছনে আরও কতকগুলি। কারণ কাজ করেছে। ভারত বিভাজন, শ্রমের গতিশীলতার অভাব, মূলধনের অভাব, গ্রামাঞ্চলে ক্ষুদ্র ও । কুটির শিল্পের অবক্ষয়, কৃষির উপর বর্ধিত জনসংখ্যার অতিরিক্ত চাপ, উদ্যোগের অভাব, শ্রমনির্ভর অদক্ষ জনসংখ্যা প্রভৃতি।

Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।

Leave a Comment