তুুলনামূলক শিক্ষার ধর্মনিরপেক্ষ উপাদান আলোচনা করো

তুুলনামূলক শিক্ষার ধর্মনিরপেক্ষ উপাদান আলোচনা করো

উত্তর :

তুুলনামূলক শিক্ষার ধর্মনিরপেক্ষ উপাদান

আমরা দেখেছি বিভিন্ন দেশের শিক্ষাপদ্ধতিকে ধর্ম, ধর্মীয় বিষয় এবং আধ্যাত্মিক উপাদান প্রভাবিত করে থাকে। অন্যদিকে আমরা এও দেখতে পাই যে কিছু কিছু দেশের এমন কোনাে বিষয় থাকে যাকে ধর্মীয় বা ধর্মসংক্রান্ত বলা চলে না বরং ধর্মনিরপেক্ষ বলা যায় তবু সেসব দেশের শিক্ষাকে প্রভাবিত করে। Prof. N. Hans এগুলিকে এইভাবে তালিকাভুক্ত করেছেন 1) মানবতা বা মানবিক উপাদান, 2) সমাজতন্ত্রবাদ, 3) জাতীয়তাবাদ, 4) গণতন্ত্র। ধর্মনিরপেক্ষ উপাদান সংক্রান্ত নিরীক্ষা যা কি না শিক্ষানীতিকে প্রভাবিত করে থাকে, তা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে যদি আমরা উল্লেখিত বিষয়গুলি সম্পর্কে বিস্তৃত আলােচনা না করি।

মানবতা বা মানবিক বিষয়সমূহ ও তুলনামূলক শিক্ষা :

মানবিকতা একাধারে মানবীয় তথা শিক্ষা সংক্রান্ত সমস্যার মানবিক সমাধান সূচিত করে। অন্যভাবে বলা যায়, ধর্মীয় উপাদান দ্বারা মানবমঙ্গল কখনােই অবদমিত হওয়া উচিত নয়। শিক্ষাক্ষেত্রে সব সময় একথা মনে রাখা দরকার যে শিশু ও তার মন বিকাশশীল। তাদের কখনােই কোনাে অবদমনের শিকার করে তােলা ঠিক নয়—সে নিয়মানুবর্তিতা অথবা নিদের্শনামা যার নামেই হােক-না-কেন। যেকোনাে দমনই শিশুর মানস বিকাশে বাধা দেয়। এই বিষয়গুলি সম্পর্কে জেনে মধ্যযুগের মানুষ ধর্মীয় প্রশাসন ও ধর্মীয় শিক্ষার গোঁড়ামির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল। স্বাধীন চিন্তাবিদরা চার্চের বিধিবিধানের বিরােধিতা করেছিল। কেননা জনমতবিরােধী শিক্ষাপদ্ধতি এদের ওপরে চাপিয়ে দিয়েছিল। ইংল্যান্ডেও অনেক স্বাধীন শিক্ষাবিদ শিক্ষার ওপরে ধর্মের আরােপের বিরােধিতা করেছেন। বিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে এই আন্দোলন আরও জোরদার হয়ে ওঠে। পরবর্তীকালে ফ্রয়েবেল, পেস্তালৎসি, জন ডিউই শিক্ষাক্ষেত্রে মানবতাকে বৃহত্তর স্থান দেবার চেষ্টা করেছেন। উনিশ শতকে বিষয়টি আরও বড়াে জায়গা পেল। এইসময় যে বিপ্লব ঘটেছিল তা শিক্ষাক্ষেত্রে মানবতার জন্য আন্দোলনকে সমর্থন করেছে এবং বিভিন্ন দেশের শিক্ষাপদ্ধতিকে বিষয়টি প্রভাবিত করেছে। এখন এটি একটি স্বীকৃত সত্য যে শিক্ষানীতি হওয়া উচিত ধর্মনিরপেক্ষ, গোঁড়ামির বন্ধনমুক্ত, যুক্তির সক্রিয়তা, প্রকৃত তথ্য ও সত্যের দর্পণে ফুটে ওঠা প্রাকৃতিক এবং মানবিক বিষয়ের অনুশীলন যা আজও শুভ এবং মঙ্গলবাচক বলে স্বীকৃত।

সমাজতন্ত্রবাদ ও তুলনামূলক শিক্ষা :

সমাজতন্ত্রবাদের প্রচলন হয় 1917 খ্রিস্টাব্দে রুশ বিপ্লবের পর, যদিও 1831 খ্রিস্টাব্দে P. Leroux দ্বারা এই পরিভাষার পত্তন হয়। প্রকৃতপক্ষে সমাজতন্ত্রবাদ জীবনের এমনই প্রকাশক যা কি না মানবতার চেয়েও আরও উন্নত ভাবনার আকর। শিক্ষাক্ষেত্রে সমাজতান্ত্রিক উপকরণ যুক্ত করার প্রাথমিক কাজটি করেছিলেন Robert Owen; Marx ও Engles তাকে আরও বিজ্ঞানসম্মত করে তােলেন। তারা সমাজকে ধর্ম থেকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন, যার সঙ্গে যক ছিল শিক্ষাও। কেননা ধর্মের প্রভাব খাটিয়ে মানব অস্তিত্বের বড়াে অংশকে অলৌকিক শক্তির মায়ায় আচ্ছন্ন করে রাখা হতাে। বাস্তব ও পার্থিব জগতের সত্য এভাবে ধর্মের অপব্যবহারে চাপা পড়ে যেত।

আজকের যুগে শিক্ষার ক্ষেত্রে সমাজতন্ত্রবাদের বিশেষ প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে। সমাজ পুনর্বিন্যাসে শিক্ষাই হলাে উপযুক্ত অস্ত্র, যার মাধ্যমে ধনী ও দরিদ্রের ব্যবধান ঘুচিয়ে। দেওয়া সম্ভব। কমিউনিস্ট দেশগুলি তাদের শিক্ষাভিত্তিকে মার্কসীয় ও লেনিনীয় ব্যাখ্যায়। মার্কসবাদের উপরে প্রতিষ্ঠা করেছে। তাঁরা রাষ্ট্রের একচেটিয়া অধিকারে বিশ্বাসী, ধর্মনিরপেক্ষতা, ট্রেনিং-এর একটি অবিচ্ছিন্ন অংশ হিসাবে উৎপাদনশীল কাজ, শারীর শিক্ষণ ও মিলিটারি ট্রেনিং, রাজনৈতিক দীক্ষা, স্কুলের বাইরে ও ভিতরে যুব সংগঠনের অংশগ্রহণ এবং বিজ্ঞান বিষয়গুলির ওপর জোর দেওয়া—এগুলিই শিক্ষার মূলভিত্তি হিসাবে তারা গ্রহণ করেছিল। তুলনামূলক শিক্ষায় সমাজতন্ত্রবাদের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

জাতীয়তাবাদ এবং তুলনামূলক শিক্ষা :

প্রতিটি জাতীয় জীবনে জাতীয়তাবাদ একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ, এটি একটি মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার। সমবেত দৃষ্টিভঙ্গি এবং অভিন্ন ঐতিহ্যের ওপরে নির্ভর করে সৃষ্ট কোনাে বৃহৎ বংশধারা, ভাষা, ধর্ম, অঞ্চল বিশেষ ইত্যাদি এই অনুভূতিকে আরও জোরদার করে। এটি আসলে মনের এক অবস্থা যা সামাজিক পরিবেশ এবং শিক্ষার পরিণাম। প্রকৃতপক্ষে এটি একটি আন্দোলন যাকে একটি বিশেষ উপস্থাপিত স্বেচ্ছাকৃত তথ্য উপস্থাপনাও বলা যেতে পারে। 

শিক্ষা জাতীয়তাবাদী চেতনায় জনগণকে সজাগ রাখার একটি শক্তিশালী মাধ্যম। জাতীয়তাবাদের ধারণা বলতে যা বুঝি তা একটি ঐতিহাসিক বিকাশের পরিণাম এবং উনবিংশ শতাব্দীর ফল। এই জাতীয়তাবাদী চেতনার সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়েছে। শিক্ষাপদ্ধতিসমূহের ওপর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে জার্মানি শুধুমাত্র শিক্ষাপদ্ধতির মাধ্যমেই জাতীয় চেতনা সৃষ্টি করেছিল। একইভবে জাপানের মতাে ক্ষুদ্র দেশও শক্তিশালী। হতে পেরেছে তার জনসাধারণের মধ্যে শিক্ষার মাধ্যমে জাতীয় প্রেরণা সঞ্চার করে। এই জাতীয়তাবাদী চেতনা তুলনামূলক শিক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।

গণতন্ত্র এবং তুলনামূলক শিক্ষা :

সহনশীলতার উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত গণতন্ত্র জীবনের পথ নির্ধারণ করে। জনপ্রিয়তার নিরিখে বিচার করে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা গঠিত একটি সাংবিধানিক সরকার দেশ শাসন করে। তারা সামাজিক, আর্থনীতিক ও একচেটিয়া স্বত্বাধিকারে বিশ্বাস করে এবং একেই গণতান্ত্রিক পরিকাঠামাে বলে মানে। একটি গণতান্ত্রিক সমাজে লিঙ্গ, জাতি, ভাষা, ধর্ম ও অর্থনৈতিক মর্যাদাভেদে কোনাে পৃথক সম্মান লাভের স্থান নেই। এই পরিকাঠামােয় প্রতিটি নাগরিককে শিক্ষাদান এবং তার ব্যক্তিত্ব বিকাশে সুযােগ থাকে। শিক্ষার ক্ষেত্রে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। একটি গণতান্ত্রিক পরিকাঠামােয় প্রত্যেকরই জ্ঞানলাভ ও বিস্তার করার বিস্তৃত সুযােগ থাকে। যেসব দেশ গণতন্ত্রে বিশ্বাসী সেখানেই শিক্ষার গণতন্ত্রীকরণের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। ভারত, আমেরিকা, ইংল্যান্ড প্রভৃতি দেশে জীবনের এই দিকটি সম্পর্কে বিশেষভাবে মনােনিবেশ করা হয়েছে। পুরুষ ও স্ত্রী সমানভাবে শিক্ষালাভের অধিকারী। N. Hans তুলনামূলক শিক্ষাচর্চায় গণতন্ত্রের উপর গুরুত্ব দিয়েছেন। J. Louis শিক্ষা ও গণতন্ত্রের সম্পর্কের আলােচনায় শিক্ষার গণতান্ত্রিক মূল্যবােধের উপর গুরুত্ব দিয়েছেন।

Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।

Leave a Comment