প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান আলােচনা করাে।

প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান আলােচনা করাে।

উত্তর : 

প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান : 

বিদ্যাসাগর ছিলেন ঊনবিংশ শতাব্দীর অগ্রগণ্য মনীষী। তিনি অসাধারণ পাণ্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য শিক্ষা-সংস্কৃতি মিলনের পথে তিনিও ছিলেন পথিকৃৎ। তাঁর শিক্ষা ও সমাজ-সংক্রান্ত সংস্কার আজও যুগােপযােগী ও সমানভাবে সমাদৃত। প্রাথমিক শিক্ষার উন্নতি ও অগ্রগতিতে বিদ্যাসাগরের অবদান অনস্বীকার্য। তিনি দেশীয় শিক্ষার শােচনীয় হাল উপলব্ধি করেন এবং তার সংস্কারে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। 

[1] প্রাথমিক শিক্ষার জন্য প্রতিবেদন পেশ : ভারতবর্ষ তখন ছিল ব্রিটিশ পরাধীন। শিক্ষা ছিল অত্যন্ত অবহেলিত। 1853 খ্রিস্টাব্দে প্রাথমিক শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়ােজনীয়তা ব্যাখ্যা করে তিনি একটি প্রতিবেদন রচনা করেন। এই প্রতিবেদনের সুপারিশগুলি তৎকালীন বড়োেলাট লর্ড ডালহৌসি সমর্থন করেন। ফলে প্রাথমিক শিক্ষার পথ প্রশস্ত হতে শুরু করে।

[3] শিক্ষার মাধ্যম : ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রাথমিক শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে মাতৃভাষাকে ব্যবহার সপক্ষে মতামত ব্যক্ত করেন। ইংরেজি ভাষা হল শাসকের ভাষা। প্রত্যেকের ইংরেজি শেখা উচিত কিন্তু সেটি মাতৃভাষা শিখনের পূর্বে নয়। এর ফলে শিশু সহজে বিষয়বস্তু আয়ত্তে আনতে পারবে। 

[4] প্রাথমিক শিক্ষায় বাংলা ভাষায় প্রচলন : প্রাথমিক শিক্ষা বিকাশের জন্য অনেকগুলি পুস্তক রচনা করেন। তার মধ্যে সবচেয়ে অনবদ্য সৃষ্টি হল বর্ণপরিচয় -বর্ণপরিচয় প্রথম ভাগ (1855 খ্রিস্টাব্দ); বর্ণপরিচয় দ্বিতীয় ভাগ (1855 খ্রিস্টাব্দ)। শিশুপযােগী করে স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণের ব্যবহার সরল করেন। এ ছাড়া তিনি বাংলা ভাষার যতি চিহ্নের প্রচলন করেন এবং লেখনীতে কথ্য ভাষার ওপর জোর দেন। 

[5] পাঠ্যবিষয় : বিদ্যাসাগর তৎকালীন পাঠক্রমে পরিবর্তন ও সংস্কার করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন প্রগতিবাদী। প্রাথমিক শিক্ষাস্তরে পড়াশােনার জন্য ভাষাচর্চা, সাধারণ গাণিতিক হিসাব, ইতিহাস, ভূগােল, জীবনবৃত্তান্ত, জ্যামিতি, নীতিবিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ের উল্লেখ করেন। 

[6] মডেল স্কুল স্থাপন : শিক্ষা প্রসারের জন্য তিনি বহু সংখ্যক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনে উদ্যোগী ছিলেন। এমনকি কোনাে কোনাে প্রতিষ্ঠানের গৃহ নির্মাণের খরচ তিনি সম্পূর্ণ বহন করেছিলেন। 1854 খ্রিস্টাব্দে বাংলা প্রদেশের গভর্নর হ্যালিড সাহেব প্রাথমিক শিক্ষার ব্যাপারে বিদ্যাসাগরকে প্রভুত সাহায্য করেন। 1855 খ্রিস্টাব্দ থেকে 1856 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে মেদিনীপুর, হুগলি, বর্ধমান, নদিয়া ইত্যাদি বিভিন্ন জেলাতে 20টি মডেল স্কুল গড়ে ওঠে। তিনি এই বিদ্যালয়ে একজন প্রধানশিক্ষক ও দুজন সহকারী শিক্ষক নিয়ােগের কথা বলেন।

[3] পরিদর্শন ব্যবস্থা: বিদ্যালয়গুলির অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য দুটি জেলা প্রতি একজন করে পরিদর্শক নিয়ােগের জন্য সুপারিশ করেন তিনি। তিনি আরও উল্লেখ করেন সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ অবৈতনিকভাবে পরিদর্শকের অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করবে। 

[4] পরীক্ষা-সংক্রান্ত সংস্কার : তিনি পরীক্ষা ব্যবস্থা সংস্কারে উদ্যোগী হয়েছিলেন। তিনি বছরে একবার পরীক্ষার পরিবর্তে মাসিক পরীক্ষা গ্রহণের মত প্রদান করেছিলেন। এ ছাড়া শিক্ষাক্ষেত্রে অবসর (অর্থাৎ ছুটি) এর প্রয়ােজনীয়তার কথা বলেন। 

[5] শিক্ষক-শিক্ষণের ব্যবস্থা : বিদ্যাসাগর লক্ষ করেছিলেন দেশে ভালাে শিক্ষকের অভাব। উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ছাড়া শিক্ষার্থী গড়ে তােলা সম্ভব নয়। তাই তিনি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকের জন্য শিক্ষক-শিক্ষণের ব্যবস্থা করার সুপারিশ করেন। তারই প্রচেষ্টায় 1855 খ্রিস্টাব্দে শিক্ষক-শিক্ষণের জন্য একটি নর্মাল স্কুল স্থাপিত হয়, অধ্যক্ষপদে নিযুক্ত হন অক্ষয়কুমার দত্ত। 

[6] প্রশাসনিক ব্যবস্থা : বিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কাজে যাতে সুবিধা হয়—সেজন্য বিদ্যাসাগর সার্কেল প্রথা চালু করার সুপারিশ করেন। 

উপসংহার :

তিনি হলেন আধুনিক বাঙালি। তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা সংস্কার তথা শিক্ষা সংস্কারের জন্য সমগ্র জাতি চিরঋণী। প্রাথমিক শিক্ষার দুর্দশার অপসারণ করে জাতিকে সঠিক আলাের দিশা দেখিয়েছিলেন পথপ্রদর্শক বিদ্যাসাগর। শিক্ষাসংস্কারের মধ্য দিয়ে প্রাথমিক শিক্ষা এবং জনসাক্ষরতার পথকে তিনি সুগম করেছিলেন।

Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।

1 thought on “প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান আলােচনা করাে।”

Leave a Comment