মানবধর্ম – মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা
উত্তর:
মানবধর্ম
“মানুষের মৃত্যু হলে তবুও মানব থেকে যায়।” —জীবনানন্দ দাশ
প্রাণীজগতে মানুষের স্বাতন্ত্র শুধু তার বুদ্ধিবৃত্তিতে নয়, তার সমাজবদ্ধতায়। আর সমাজে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের যে ভিত্তি তাই হল মানবতাবাদ। মানবতা মানুষের ধর্ম, যা মানুষের মধ্যে সৌভ্রাতৃত্ব ও সহমর্মিতার বােধ জাগিয়ে তােলে, সংকীর্ণ স্বার্থপরতার ঊর্ধ্বে উঠে মানুষকে উদারতার শিক্ষা দেয়। মানবতার ছোঁয়ায় দাঙ্গা, দারিদ্র্য, প্রাকৃতিক ও সামাজিক বিপর্যয় পীড়িত পৃথিবীতে লাগে প্রাণের ছোঁয়া, সুন্দর হয় পৃথিবী।
মানবধর্ম মানুষের ধর্ম। তার অনায়াস প্রতিষ্ঠাই পৃথিবীতে প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু নানা কারণে মানবধর্মকে বারবার খণ্ডিত হতে হয়। জাতিগত, ধর্মর্গত, বিত্তগত, বর্ণগত নানা বিভাজন তৈরি করে মনুষ্যত্বকে খণ্ডিত করে ফেলা হয়। কখনও রাষ্ট্রনায়কদের উদগ্র লালসা, কখনও ক্ষমতাবানের সীমাহীন লােভ মানবধর্মের হানি ঘটায়। অধিকাংশ সময়ে সংকীর্ণ রাজনৈতিক অভিসন্ধি মানবতাকে লঙ্ঘন করে। মধ্যযুগে নানাভাবে এর প্রকাশ দেখা গেছে। নারীদের তাদের প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রাখার মধ্যে
যেমন ছিল অমানবিকতাকে প্রশ্রয় দেওয়া, তেমনি শূদ্রদের শিক্ষা ও অন্যান্য সামাজিক অধিকার থেকে দূরে রাখার মধ্যেও ছিল মনুষ্যত্বহীনতারই প্রকাশ। কিছু মানুষ শুধুমাত্র নিজেদের অপ্রতিদ্বন্দ্বী ক্ষমতার অধিকারী করে তােলার জন্য বর্ণাশ্রম ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রেখেছিল আর লালন করেছিল অমানবিকতাকে। প্রাচীন বা মধ্যযুগে তাে বটেই, সাম্প্রতিক কালেও পথিবীর বিভিন্নপ্রান্তে ঘটে গেছে অজস্র সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন। নষ্ট হয়েছে স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব; আর বিপন্ন হয়েছে মানবতা। কখনও আফগানিস্তানে, কখনও ইরাকে সন্ত্রস্ত পৃথিবী মানবতার এই বিপর্যয় দেখেছে। ধর্মীয় শ্রেষ্ঠত্বের প্রশ্নও অমানবিকতাকে আবাহন করে আনে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ধর্মীয় অন্ধত্বকে আদর্শ করে গড়ে-ওঠা মৌলবাদী সংগঠনগুলির কার্যকলাপ আসলে বিপর্যস্ত করে মানবতাকেই।
মানব সভ্যতার সূচনা থেকেই অজস্র রক্ত ঝরেছে পৃথিবীতে। কিন্তু তারপরেও বারবার ইতিহাস মুগ্ধ হয়েছে শান্তি আর ভালােবাসার স্পর্শে। হজরত মহম্মদ, জিশুখ্রিস্ট থেকে শুরু করে আমাদের দেশের চৈতন্য, কবীর, নানক, দাদু কিংবা শ্রীরামকৃষ্ণ এই মানবতার জয়গানই ঘােষণা করেছেন। চণ্ডীদাসের পদে, লালনের গানে কিংবা রবীন্দ্রনাথের লেখায় মানুষই হয়ে। উঠেছে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ। পৃথিবীর কোনাে দর্শনই মানুষকে বাদ দিয়ে তৈরি হয়নি। যখনই ক্রীতদাসের কান্না ভেসে এসেছে, উঠে দাঁড়িয়েছেন একজন স্পার্টাকাস। তাই পৃথিবীতে যত দাঙ্গা হয়েছে, যত বৈষম্য আর অত্যাচারের কাহিনি রচিত হয়েছে, মানবতার প্রকাশ ঘটেছে তার থেকেও অনেকগুণ বেশি। আর পৃথিবীর সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষও ভরসা রেখেছেন এই মানবৃতাতেই। এলাকার মানুষের কোনাে সাহায্যার্থে তােক, অসুস্থ ব্যক্তির চিকিৎসায় পাশে দাঁড়ানাে তােক অথবা আয়লা বা সুনামিতে বিধ্বস্ত মানুষের প্রতি সহমর্মিতায় হােক—মানবতার প্রকাশ ঘটে নব নব রুপে।
তবুও গ্রাহাম স্টেইনকে পুড়িয়ে মারা হয়, তবুও নিঠারি হত্যাকাণ্ড হয়, প্যালেস্টাইনে রক্তস্নান থামে না। আধুনিক যন্ত্রজীবন মানবিক সম্পর্ককে নষ্ট করছে, আর রাজনীতি কলুষিত করছে মানুষের হৃদয়কে। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন—“মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানাে পাপ”। এই বিশ্বাসকে বাঁচিয়ে রেখেই পথ চলতে হবে আমাদের, যে পথে হেঁটেছেন মহম্মদ কিংবা পরমহংস। “এই পথে আলাে জ্বলে -পথেই পৃথিবীর ক্রম-মুক্তি হবে;/ সে অনেক শতাব্দীর মনীষীর কাজ”। (জীবনানন্দ)
আরো পড়ুন
আধুনিক জীবনে সংবাদপত্রের ভূমিকা – মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা
বাংলার উৎসব – মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা
হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা – মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা
শিক্ষাবিস্তারে গণমাধ্যম | মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা
সর্বশিক্ষা অভিযান – মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা
Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।