অবকাশযাপন – মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা
উত্তর:
অবকাশযাপন
What is this life, if full of Care,
We have no time to stand and stare?” –W.H. Davis
কর্মক্লান্ত মানুষ জীবনের অভ্যস্ত ধারাপাতে কিছুটা অবসর সন্ধান করে। অবসরের একান্ত মুহূর্ত আসলে জীবনের গতানুগতিকতার বাইরে গিয়ে নিজেকে নতুন করে খুঁজে পাওয়া। অবসর মুহুর্তে স্মৃতি রােমন্থনের মেদুরতায় মনের বিমুগ্ধ বিস্তার ঘটে আর তার মধ্যে দিয়েই খুঁজে নেওয়া যায় আগামীর প্রেরণা। অর্থ-ফশ প্রতিষ্ঠার আবর্তে ঘুরপাক খাওয়া মানুষের। জীবনে অবকাশ তাই পরশপাথর’-এর মতাে অতি আকাঙ্ক্ষিত বিষয়।
একটা সময় ছিল যখন মানুষের জীবন ছিল নির্ভার, নিশ্চয়তাপূর্ণ। কাজের অবসানে ছিল নিশ্চিন্ত অবসর। বাঙালি তখন সময় কাটাত চণ্ডীমণ্ডপের আটচালায় সান্ধ্য মজলিশে। সেই অবসরযাপনে যেমন ছিল দাবা কিংবা পাশা খেলা, তেমনই পরনিন্দা-পরচর্চাও থাকত অনেকটা পরিসরজুড়ে। ক্রমশ আটচালার স্থান দখল করে চায়ের দোকান, রেস্টুরেন্ট, খেলার মাঠ, থিয়েটার হল বা গানের জলসা। কিন্তু পেশাগত ব্যস্ততার ফাঁকে অবসরের সন্ধানে মানুষের চলা থেমে থাকেনি কখনও।
একুশ শতক, মানুষের সময়কে শাসন করার যুগ। যন্ত্রসভ্যতার প্রবল দাবি মেনে মানুষও এখন যন্ত্রে রূপান্তরিত। পরিবর্তিত এই সময়ে ‘ডাকঘর’-এর অমল আর দইওয়ালার ডাক শুনতে পায় না, বরং ছুটি’ গল্পের ফটিকের মতােই বিকারগ্রস্ত হয়ে যায়—“এক বাও মেলে না, দো বাও মেলে না।” পেশাগত পরিধি যেমন এখন বহুধাবিস্তৃত, তেমনি ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক চাহিদাও ক্রমশ বেড়ে চলেছে। এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে, বিশ্বায়নের তীব্রতায় বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ, অনাবিল প্রশান্তি। আজকের পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে বারাে ঘণ্টা কাজের জীবনে অবকাশ নেই, আর তাই হয়ত অবকাশের তাৎপর্য উপলব্ধ হয় আরও তীব্রভাবে।
অবকাশ মানুষকে পেশাগত জীবনের একঘেয়েমি থেকে মুক্তি দেয়। বৈচিত্র্যের স্পর্শে সঞ্জীবিত হয় তার জীবন। পরিশীলিত অবকাশযাপন সত্য
ও সন্দরের বােধে আস্থাশীল করে তােলে তাকে। ছাত্রদের জীবনে এই অবকাশ নিয়ে আসতে পারে মুক্তির সােচ্চার উল্লাস। একদিকে অবকাশের মুহূর্তে মানুষ যেমন তার দৈনন্দিন ছক ভেঙে নতুন কর্মপ্রবাহের সঙ্গে নিজেকে সংযুক্ত করতে পারে, তেমনই অন্যদিকে সংগ্রহ করে নিতে পারে তার পরবর্তী দিনগুলাের প্রেরণা। অবকাশের মুহূর্তে জন্ম নিতে পারে স্মরণীয় কবিতা, গান বা চিত্রকলা, আবার এই সময়েই সাক্ষরতা আন্দোলন, বিজ্ঞান চেতনা প্রসারে বিভিন্ন আন্দোলনে নিজেকে যুক্ত করা যায়। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “সত্যকে খুব বড়াে করে ধ্যান করবার এবং উপলদ্ধি করবার মতাে মনের উদার অবকাশ প্রয়ােজন।” অবকাশ আসলে একটি মধ্যবর্তী পর্ব— কাজের এক অধ্যায় থেকে অন্য অধ্যায়ে যাওয়ার জন্য নিজেকে আরও উপযােগী, শুদ্ধতর ও সঠিক করে তােলার উপযুক্ত সময়। অবকাশ তাই একদিকে হালকা হাওয়ায় অবরুদ্ধ আবেগকে যেমন অবাধ করে দেওয়া, তেমনি অন্যদিকে জীবনকে আরও ব্যাপকভাবে উপলদ্ধি করারও সময়।
চলাই জীবন, থেমে থাকাই মৃত্যু। কিন্তু ক্ষণিকের বিরতিও প্রয়ােজন, চলার রসদ সংগ্রহের জন্য। বুননা ফুলের গন্ধে, নদীর বুক থেকে ভেসে আসা ভাটিয়ালি সুরে, অ্যাকাডেমিতে চলতে থাকা বিমূর্ত চিত্রকলার তুলির পোঁচে, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের হৃদয় নিংড়ানাে শব্দমালায় কিংবা ‘মেঘে ঢাকা তারা’র। পাহাড় কাঁপানাে ‘আমি বাঁচতে চাই’ চিৎকারে—যেভাবেই হােক না কেন মানুষ খুঁজে নেয় অবসরের মণিমাণিক্য—বেঁচে থাকারই তাগিদে।
আরো পড়ুন
বিজ্ঞানসাধনায় ভারত – মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা
ভারতের জাতীয় সংহতি | মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা
উন্নয়ন বনাম পরিবেশ | মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা
প্রয়াত বাঙালি রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখােপাধ্যায় – জীবনীমূলক প্রবন্ধ রচনা
বিজ্ঞাপন ও আধুনিক জীবন | মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা
Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।