মুসলিম নারীশিক্ষা ও বেগম রোকেয়া | উচ্চমাধ্যমিক বাংলা প্রবন্ধ রচনা

প্রিয় ছাত্রছাত্রীরা, এখানে আমরা মুসলিম নারীশিক্ষা ও বেগম রোকেয়া | উচ্চমাধ্যমিক বাংলা প্রবন্ধ রচনা নিয়ে আলোচনা করলাম। খুব সুন্দর করে গুছিয়ে এই প্রবন্ধ রচনাটি লেখা হয়েছে। আশা করি তোমাদের সবারই ভালো লাগবে। ধন্যবাদ

মুসলিম নারীশিক্ষা ও বেগম রোকেয়া

বেকম রোকেয়া ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দের ৯ ডিসেম্বর বর্তমান বাংলাদেশের রংপুর জেলার পায়রাবন্দ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ছিল জহীরুদ্দিন আবু আলী হায়দার সাবের, মাতার নাম রাহাতুন্নেসা চৌধুরী। রোকেয়া জন্মসূত্রে বাঙালি ছিলেন না, ছিলেন হিন্দুস্থানি, কারণ, তাঁর মাতৃভাষা ছিল উর্দু।

বেগম রোকেয়া যে সময়টায় জন্মগ্রহণ করেন, তখন অবিভক্ত বাংলাদেশের হিন্দু ও মুসলিম সমাজে পর্দাপ্রথা প্রচলিত ছিল। তবে রামমোহন- বিদ্যাসাগরের সৌজন্যে হিন্দু ও ব্রায় সমাজের মেয়েরা তখন লেখাপড়া শিখতে শুরু করেছেন, স্থাপিত হয়ে চলেছে বালিকা বিদ্যালয়। অন্যদিকে রোকেয়ার জন্মের অব্যবহিত পরেই পূর্ববাংলার ‘ঢাকা সুহৃদ সম্মিলনী’ নারীশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। এই উদ্যোগের ফলশ্রুতিতেই এই সময় প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত অন্তঃপুর নারীশিক্ষাপ্রণালীর প্রবর্তন হয় মুসলিম মহিলাদের জন্য।

রোকেয়ার পিতা ছিলেন অভিজাত সাবের বংশের সন্তান। আরবি ও ফারসি ভাষায় অত্যন্ত সুপণ্ডিত এই ব্যক্তি ছিলেন অত্যন্ত কুসংস্কারাচ্ছন্ন। তাই রোকেয়ার লেখাপড়া শেখা নিষিদ্ধ ছিল। তবে, ইসলাম ধর্মের ভাষা আরবি এবং খানদানি ভাষা ফারসি এবং মাতৃভাষা উর্দু শেখার ব্যাপারে তাঁর কোনো বিধিনিষেধ না থাকলেও বাংলা ও ইংরেজি শেখার ব্যাপারে তাঁর আপত্তি ছিল। সাবের পরিবারের মেয়েরা টিয়াপাখির মতো কোরান শরিফই পড়তে পারত। তাই, গভীর রাতে বড়দা ইব্রাহিম এবং বড়দি করিমুন্নেসার কাছে বাংলা, ইংরেজি এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের পাঠ নিয়েছেন দিনের পর দিন বেগম রোকেয়া।

ষোলো বছর বয়সে বেগম রোকেয়ার বিয়ে হয় তাঁর দ্বিগুণ-বয়সি, এক কন্যাসন্তানের পিতা, বিপত্নীক সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে। তবে, বিহারের ভাগলপুরের মানুষ সাখাওয়াত ছিলেন বিএ, এমআরএসি ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। ওড়িশার কণিকা স্টেটের তৎকালীন ম্যানেজারও ছিলেন তিনি। বিয়ের পর অবশ্য সাখাওয়াতের প্রথম পক্ষের কন্যা সৎ-মাকে কোনোদিনই মেনে নিতে পারেননি। পরবর্তীকালে রোকেয়া দুই কন্যাসন্তানের জন্ম দিলেও তাদের অকালমৃত্যু ঘটে। তবে স্বামী সাখাওয়াত অবশ্য বিদুষী স্ত্রী রোকেয়াকে তাঁর মর্মসহচরী করে নিয়েছিলেন। ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে তাঁকে পারদর্শী করে তোলেন সাখাওয়াত। স্বামীর উৎসাহেই লেখালেখি শুরু করেন রোকেয়া। তাঁর লেখা উপন্যাস Sultana’s Dream ছাপাও হয় পত্রিকায়। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনকভাবে রোকেয়া মাত্র ঊনতিরিশ বছর বয়সে বিধবা হন ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে।

ঊনতিরিশ বছরের সুন্দরী, বিদুষী বিধবা রোকেয়া এবার তাঁর একাকী জীবনটাকে বইয়ে দিলেন মুসলিম নারীসমাজের উন্নতিকল্পে। মুসলিম নারীদের সংঘবদ্ধ করতে, তাদের শিক্ষিত ও সচেতন করতে জীবনপণ করলেন তিনি। তাঁর এই স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার উদ্দেশ্যেই লেখনী ধারণ করেন তিনি।

রোকেয়ার লেখা উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হল মতিচুর প্রথম খণ্ড (১৯০৫) [প্রবন্ধ সংকলন], মতিচুর দ্বিতীয় খণ্ড (১৯২১) [প্রবন্ধ সংকলন]। মতিচুর গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডে অবশ্য লেখিকার ইংরেজি উপন্যাস Sultana’s Dream-এর বঙ্গানুবাদ সুলতানার স্বপ্ন এবং ডেলিশিয়া হত্যা নামক এক অনুবাদ- আখ্যানও প্রকাশিত হয়। নারীমুক্তি ও নারীজাগরণের দোসরহীন উপন্যাস- হল সুলতানার স্বপ্ন। এ ছাড়াও পদ্মরাগ উপন্যাস, গল্পগ্রন্থ অবরোধবাসিনী এবং পুস্তকাকারে অপ্রকাশিত অসংখ্য প্রবন্ধ, কবিতা, গল্প লিখেছেন লেখিকা। রোকেয়া রচনাবলি-র ভূমিকায় আবদুল কাদির যথার্থই বলেছেন—“মুখ্যত উদ্দেশ্যমূলক ও শিক্ষাত্মক হলেও শিল্পবিচারেও প্রায়শ রসোত্তীর্ণ।”

সাহিত্যিক হিসেবে যতটা, তারচেয়েও বেশি সমাজ-সংস্কারক হিসেবে রোকেয়া স্মরণীয়। বিধবা হওয়ার পর কলকাতায় এসে রোকেয়া তাঁর স্বামীর সহায়তা-ধন্য টাকা দিয়ে গড়ে তোলেন সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল (১৯১১) এবং ক্রমে ক্রমে স্কুলটিকে প্রথম শ্রেণির বালিকা বিদ্যালয়ে পরিণত করেন। এরপর বঙ্গদেশের মুসলিম নারীদের মধ্যে শিক্ষা, স্বাবলম্বন এবং বিজ্ঞানমনস্কতার আলো ছড়িয়ে দিতে স্থাপন করেন ‘আঞ্জুমন-ই- খাওয়াতীনে ইসলাম’ বা ‘নিখিলবঙ্গ মুসলিম মহিলা সমিতি’ (১৯১৬)।

১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের ৯ ডিসেম্বর, মাত্র তিপ্পান্ন বছর বয়সে রোকেয়া আমাদের ছেড়ে চলে গেলেও বঙ্গদেশের মুসলিম নারীজগতের শিক্ষা-বিস্তার এবং সমাজ-সংস্কারের ইতিহাসে তিনি অমর হয়ে আছেন। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে বাংলাদেশ সরকার ২০০৯ খ্রিস্টাব্দে রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পালটে করেছে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়। এ ছাড়া তাঁর পৈতৃক ভিটেয় তৈরি হয়েছে বেগম রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্র।

Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।

Leave a Comment