Q: বিশ্বায়নের প্রেক্ষাপটে সার্বভৌমিকতার প্রকৃতি আলোচনা কর ।
অথবা, ‘আধুনিক রাষ্ট্রের সার্বভৌম অস্তিত্ব বর্তমানে কোন এক ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে’ – এই উত্তরের স্বপক্ষে যুক্তি দাও ।
উত্তরঃ-
বিশ্বায়নের প্রেক্ষাপটে সার্বভৌমিকতার প্রকৃতি :
সাবেকী ধারণা অনুসারে সার্বভৌমিকত্বের অর্থ হল, রাষ্ট্রের চূড়ান্ত, অসীম ও অপ্রতিহত ক্ষমতা। অর্থাৎ অন্যান্য রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র একাই সিদ্ধান্ত নেবে এবং সেই সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত হবে। এই ক্ষমতাকে স্বীকার করা হলে একটি রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের উপর কর্তৃত্ব করতে পারবে-এই অধিকারকে স্বীকার করতে হয়। কিন্তু এটা স্বীকার করলে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিপর্যয় দেখা দেবে। বিশ্বের শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলি দুর্বল রাষ্ট্রের উপর আধিপত্য বিস্তার করতে পারবে। এতে ভয়াবহ যুদ্ধের পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। তাতে মানবসভ্যতা সংকটের সম্মুখীন হবে।
এই অবস্থার জন্যে বর্তমানে চরম রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিত্বের ধারণা অচল হয়ে পড়েছে। অধ্যাপক লিন্ডসের (Lindsay) ভাষায় বলা যায়,-” সার্বভৌম রাষ্ট্র সম্পর্কে ধারণা ভেঙে পড়েছে। ” আজ সব রাষ্ট্র বুঝতে পারছে-সার্বভৌম ক্ষমতা প্রয়োগ করে যদি প্রতিটি রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে নিজের ইচ্ছা মতো সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে তাতে বিশ্বসভ্যতার সমূহ ক্ষতি হবে। এই সভ্যতাকে বজায় রাখতে সার্বভৌমিকতার তত্ত্বকে সীমিত করতে হবে। অধ্যাপক ল্যাস্কি (Laski) যথার্থই বলেছেন, “সার্বভৌমিকতা সম্পর্কে সমগ্র ধারণাটিকে পরিত্যাগ করলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পক্ষে স্থায়ী উপকার হবে।
বর্তমান প্রবণতাঃ
বিশ্বশান্তি ও সভ্যতার প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রগুলি বর্তমানে আন্তর্জাতিক আইন ও রীতিনীতিকে মেনে চলতে আগ্রহী হচ্ছে। এ ব্যাপারে বিশ্বজনমত গড়ে উঠছে। আন্তর্জাতিক আইন যাতে মেনে চলে এবং বিশ্বশান্তি লঙ্ঘনকারীর বিরুদ্ধে যাতে পদক্ষেপ নেওয়া যায় তার জন্য সম্মিলিত রাষ্ট্রপুঞ্জের সনদে ব্যবস্থার উল্লেখ আছে। সনদে উল্লিখিত এই সব নিয়মকানুন রাষ্ট্রের সার্বভৌমিকতাকে সীমিত করেছে। রাষ্ট্রগুলি স্বেচ্ছায় এই সীমিতকরণের প্রয়াসকে মেনে নিয়েছে। কারণ, তারা মনে করেছে, রাষ্ট্রের সার্বভৌমিকতাকে সীমিত না করলে বিশ্বসভ্যতা ধ্বংস হবে। আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাকে মেনে নেবার কারণগুলি হল:
প্রথমত: বর্তমানে পারমাণবিক যুগে যুদ্ধের প্রকৃতির পরিবর্তন ঘটেছে। এখন এই যুদ্ধ হল সামগ্রিক যুদ্ধ। এতে আমরা সবাই জড়িয়ে পড়বো এবং সবাই মরবো। তাই রাষ্ট্রগুলি বাঁচার জন্যে বিভিন্ন জোট তৈরী করতে বাধ্য হচ্ছে। এই জোটের শর্ত মানতে গিয়ে রাষ্ট্র তার সার্বভৌমিকতাকে কিছুটা বিসর্জন দিচ্ছে। ফলে সার্বভৌমিকতার সংকট তৈরী হয়েছে।
দ্বিতীয়ত: আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার পক্ষে বিশ্ব জনমত প্রবলতর হচ্ছে। বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি জাতিপুঞ্জের সাধারণ সভায় আজ সোচ্চার হচ্ছে। এই বিশ্বজনমতকে উপেক্ষা করা সম্ভব নয়।
তৃতীয়ত: বর্তমানে রাষ্ট্রগুলি পরস্পরের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। কোন রাষ্ট্র একাকী বিচ্ছিন্ন হয়ে চলতে পারে না। এই অবস্থায় কোন রাষ্ট্র নিজের খেয়ালখুশি মতো বিদেশের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে এককভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। তাই অন্য রাষ্ট্রের ইচ্ছা-অনিচ্ছার দিকে লক্ষ্য রেখে কোন রাষ্ট্রের বিদেশ নীতি নির্ধারণ করতে হচ্ছে। এর ফলে তার সার্বভৌমিকতাকে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করতে হচ্ছে। তাঁ থেকে সংকট তৈরী হচ্ছে।
চতুর্থত: বর্তমানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যেভাবে ব্যাপক উন্নতি ঘটেছে, তাতে কোন রাষ্ট্রের সার্বভৌমিকতাকে পুরোপুরি স্বীকার করে নিলে বিশ্বে বিবাদ ঘনিয়ে আসবে। কারণ, কোন কোন রাষ্ট্র বিজ্ঞানের উন্নতি ঘটিয়ে পারমাণবিক
অস্ত্রভাণ্ডারে সজ্জিত হয়েছে। আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে তারা নিশ্চয়ই সার্বভৌম ক্ষমতা প্রয়োগ করবে। তাতে বিশ্বের কোন ক্ষতি হবে না। কিন্তু বাহ্যিক ক্ষেত্রে এই সব শক্তিধর রাষ্ট্র যদি সার্বভৌম ক্ষমতা প্রয়োগ করে সারা বিশ্বে নিজেদের প্রভুত্ব কায়েম করার চেষ্টা করে, তাহলে বিশ্বশান্তি বিঘ্নিত হবে।
পঞ্চমত: সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলি নিজেদের জন্যে কাঁচামাল সংগ্রহ ও উৎপাদিত জিনিস বিক্রি করার জন্যে পৃথিবীর বাজার খোঁজে। এই বাজার দখল করতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত তারা অন্য দেশের ভূখণ্ডকে অধিকার করে নেয়। কবির ভাষায়, “পোহালে শর্বরী, বণিকের মানদণ্ড দেখা দিল রাজদণ্ড রূপে। ” এটি বিশ্বশান্তির সহায়ক নয়। তাই এই আগ্রাসী সার্বভৌমিকতাকে সীমিত করতে বিশ্বজনমত গড়ে উঠেছে।
ষষ্ঠত: বর্তমানে সব রাষ্ট্র, বিশ্বজনমতের চাপে আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলতে বাধ্য হচ্ছে। এর ফলে রাষ্ট্রের সার্বভৌমিকতা কিছুটা সীমিত হয়ে পড়েছে।
মুল্যায়নঃ
এই পরিবর্তিত চিন্তাভাবনার প্রেক্ষাপটে বিশ্বের সব রাষ্ট্র আজ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নিজেদের সার্বভৌমিকতাকে কিছুটা সংকুচিত করে নিচ্ছে। অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলি নিজেদের আর্থিক উন্নয়নের স্বার্থে বিদেশের সাহায্য নিতে নিজেদের সার্বভৌমিকতাকে কিছুটা সীমিত করছে। শক্তিধর রাষ্ট্রগুলি সরাসরি সার্বভৌম ক্ষমতাকে প্রয়োগ করতে চাইছে না। কারণ, তাতে বিশ্বজনমত তাদের বিরুদ্ধে চলে গেলে তাদের বাজার নষ্ট হবে। তাই তারা নয়া-উপনিবেশবাদী পদ্ধতি গ্রহণ করেছে। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলি আদর্শগত কারণে রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতার বিরোধী। কারণ, তাদের মূল লক্ষ্য হল, -বিশ্ব থেকে শোষণ নির্মূল করা। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, বিশ্বশান্তির স্বার্থে প্রতিটি রাষ্ট্র তাদের বাহ্যিক সার্বভৌমিকতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। তাই বলে কেউ সার্বভৌমিকতাকে একেবারে বিসর্জন দিতে চায় না। কারণ, সার্বভৌমিকতাকে বিসর্জন দিলে তাদের অস্তিত্ব থাকবে না। সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের সনদে তাই সার্বভৌমিকতা সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছে। কারণ, সনদের রচয়িতারা মনে করেছিলেন, সার্বভৌমিকতাকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করার কথা বললে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা যাবে না। তাই সীমিত সার্বভৌমিকতার পটভূমিতে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।
Read Also
ভারতের সংবিধান প্রস্তাবনার গুরুত্ব বা তাৎপর্য আলোচনা করো
ভারতের রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও পদমর্যাদা আলোচনা করো
Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।