ক্যান্টন বাণিজ্য: ক্যান্টন ছিল চীনের দক্ষিণ উপকূল- এ অবস্থিত একটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দর। এই বন্দরটি তাং যুগ (618-907 খ্রিঃ) থেকেই গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য কেন্দ্র হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিল। নানকিং এর সন্ধির আগে পর্যন্ত গোটা চীন বিদেশিদের কাছে রুদ্ধ থাকলেও একমাত্র ক্যান্টন ছিল বিদেশিদের কাছে উন্মুক্ত বন্দর। চীনা আদালত (1759 খ্রিঃ) এক নির্দেশনামা দ্বারা একমাত্র ক্যান্টন বন্দর কেই বৈদেশিক বাণিজ্যের জন্য উন্মুক্ত বলে ঘোষণা করে। এভাবে ক্যান্টন বন্দরকে কেন্দ্র করে চীনে বিদেশিদের এক বন্দরকেন্দ্রিক বাণিজ্য প্রথার সূচনা হয় তা ‘ক্যান্টন বাণিজ্য প্রথা ‘নামে পরিচিত। এই প্রথা 1842 খ্রিঃ ইংল্যান্ড ও চীনের মধ্যে সম্পাদিত নানকিং এর সন্ধি স্বাক্ষরিত হওয়ার আগে পর্যন্ত বহাল ছিল। ক্যান্টনের বাণিজ্যে প্রথম পর্বে পাের্তুগিজরা এবং পরে ব্রিটেনসহ অন্যান্য ইউরােপীয় জাতিগুলি নিজেদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করে।
ক্যান্টন বাণিজ্যের বৈশিষ্ট্য:
1) রুদ্ধদ্বার নীতি: ক্যান্টন বাণিজ্যে অংশগ্রহণকারী বিদেশি বণিকদের চিনা ভাষা ও আদবকায়দা শিক্ষা নিষিদ্ধ ছিল। তারা ক্যান্টনে চিনা ফৌজদারি ও বাণিজ্যিক আইন মেনে চলতে বাধ্য ছিল। বিদেশি বাণিজ্য কুঠিতে মহিলা ও আগ্নেয়াস্ত্রের প্রবেশ, দাসী নিয়ােগ প্রভৃতি নিষিদ্ধ ছিল। বাণিজ্যের মরশুম শেষে ক্যান্টনে আসা বিদেশি বণিকদের এই বন্দর ছেড়ে চলে যেতে হত। চিনে বিদেশি বণিকদের প্রতি এই কঠোর নীতি ‘রুদ্ধদ্বার নীতি’ নামে পরিচিত।
2) মূল শহরে প্রবেশে বাধা: ক্যান্টন বন্দরে বাণিজ্য করতে আসা ইউরােপীয় বণিকরা শহরের প্রধান ফটকের বাইরে একটি নির্দিষ্ট স্থানে। বসবাস ও বাণিজ্যিক কার্যকলাপ চালাতে বাধ্য হত। বণিকরা ক্যান্টন শহরের প্রাচীরের বাইরে বাস করলেও তাদের স্ত্রী-সন্তানদের রেখে আসতে হত ম্যাকাও-এ।
3) কো-হং প্রথা: বিদেশি বণিকরা চিনের ক্যান্টন বন্দরে এসে স্বাধীনভাবে বা সরাসরি এখানকার বাণিজ্যে অংশ নিতে পারত না। কেন না, বিদেশি বণিকদের কোনাে অবস্থাতেই চিনের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে দেওয়া হত না বা অন্য যে-কোনাে বণিকদের কাছ থেকেও সস্তা দরে তাদের মাল কেনার অধিকার ছিল না। চিন সরকার একমাত্র ‘কো-হং’ নামক বণিকসংঘকে একচেটিয়া বাণিজ্য করার অধিকার দিয়েছিল এবং বিদেশি বণিকরা ক্যান্টন বন্দরে একমাত্র কো-হং বণিকদের কাছ থেকেই মাল কিনতে বাধ্য ছিল।
4) কো-হং-দের দুর্নীতি: ক্যান্টনের একচেটিয়া বাণিজ্যের অধিকার পেয়ে কো-হং বণিকরা অত্যন্ত দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। একচেটিয়া তারা চিনা রাজদরবার, আদালত ও শুল্ক অধিকর্তাকে বিপুল অর্থ উৎকোচ হিসেবে দিত। বাণিজ্যের বেশির ভাগ লভ্যাংশ কো-হং বণিকরা আত্মসাৎ করত।
5) ব্যক্তিগত বাণিজ্য: ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি-সহ অন্যান্য ইউরােপীয় দেশের বণিকরা চিনের ক্যান্টন বন্দরে যে বাণিজ্য করত তা ছিল মূলত ব্যক্তিগত মালিকানাভিত্তিক বাণিজ্য। এই বাণিজ্যের জন্য চিনের সঙ্গে বিদেশি বণিকদের কোনাে কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তােলার প্রয়ােজন পড়ত না।
6) ব্রিটিশ বণিকদের প্রাধান্য: ক্যান্টন বাণিজ্যে প্রথমদিকে পাের্তুগিজরা প্রবেশ করলেও পরবর্তীকালে ব্রিটিশ বণিকরা এই বাণিজ্যে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে। ক্যান্টনে ব্রিটিশ বণিকদের চায়ের বাণিজ্য সর্বাধিক উল্লেখযােগ্য ছিল। এ ছাড়া তারা রেশম, মৃৎপাত্র, দারুচিনি, ঔষধপত্র প্রভৃতি ইংল্যান্ডে রপ্তানি করত। তারা ইংল্যান্ড থেকে পশম বস্ত্র, লােহা, টিন, সিসা, পশুর লােম প্রভৃতি চিনে আমদানি করত। চিনের সঙ্গে ইংল্যান্ডের এই বাণিজ্য দেশীয় বাণিজ্য নামে পরিচিত ছিল।
ক্যান্টন বাণিজ্যের অবসানের কারণ:
1) বাণিজ্যিক কার্যকলাপ বন্ধ: ক্যান্টন বাণিজ্য প্রথার অন্তর্গত ইউরােপীয় দেশগুলির ওপর বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা দূরীকরণের জন্য বিদেশি শক্তিসমূহ চিনের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্কস্থাপন করার চেষ্টা করে। কিন্তু চিন বিদেশিদের প্রতি উদারনৈতিক বাণিজ্যিক অবস্থান গ্রহণ করেনি, বরং চিনের সাথে তাদের সবরকম বাণিজ্যিক কার্যকলাপ নিষিদ্ধ করে দেওয়া হবে বলে জানায়।
2) আফিম যুদ্ধ: চিনের ক্যান্টন বাণিজ্যে প্রবেশ করার উদ্দেশ্যে ব্রিটেন আঠারাে শতক থেকে চিনে দূত পাঠাতে শুরু করে। কিন্তু কেউই সফল হতে পারেননি। ব্রিটিশ বণিকরা উনিশ শতকের প্রথম থেকে ভারত থেকে চোরাপথে চিনে আফিম রপ্তানি করতে থাকে। ফলে ক্যান্টন বাণিজ্যের চরিত্র বদলাতে শুরু করে। আফিমের ব্যাবসাকে কেন্দ্র করে চিনের সঙ্গে ব্রিটেনের বিরােধের ফলে প্রথম আফিম যুদ্ধ বা প্রথম ইঙ্গ- চিন যুদ্ধ (1839-42 খ্রি.) সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধে চিনের পরাজয়ের ফলে ক্যান্টন ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে।
3) অন্যান্য বন্দরের উত্থান: 1842 খ্রিস্টাব্দের নানকিং চুক্তির ফলে নানকিং, সাংহাই, নিংপাে প্রভৃতি বন্দর বিদেশি বণিকদের জন্য খুলে দেওয়া হয়। এর ফলে ক্যান্টন বিদেশি বাণিজ্যের ক্ষেত্রে তার একাধিপত্য হারায়। 1859 খ্রিস্টাব্দে ক্যান্টন বাণিজ্য সাপিং দ্বীপে স্থানান্তরিত হয়। ইতিমধ্যে চিনের সাথে বিদেশি বাণিজ্যের কেন্দ্র হয়ে ওঠে হংকং এবং অন্যান্য উত্তরের বন্দরগুলি। এই বন্দরগুলি বেজিং এবং হােয়াংহাে নদী যা চিনের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ, তার নিকটে অবস্থিত হওয়ায় বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে এদের গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। 1866 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে অধিকাংশ বিদেশি শক্তি ক্যান্টন থেকে তাদের কার্যালয় হংকং-এ স্থানান্তরিত করে। এর ফলে ক্রমে ক্যান্টন বাণিজ্য প্রথার অবসান ঘটে।
উপসংহার: ব্রিটিশ বণিকরা উনিশ শতকের প্রথম থেকেই ভারত থেকে চোরাপথে চিনে আফিম রপ্তানি করতে থাকে। ফলে ক্যান্টন বাণিজ্যের চরিত্র বদলাতে শুরু করে। আফিমের ব্যাবসাকে কেন্দ্র করে চিনের সঙ্গে ব্রিটেনের বিরােধের ফলে প্রথম আফিম যুদ্ধ বা প্রথম ইঙ্গ-চিন যুদ্ধ (1839-42 খ্রি.) সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধে চিনের পরাজয়ের ফলে ক্যান্টন ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। চিন ক্যান্টন-সহ বেশ কয়েকটি বন্দর বিদেশি বণিকদের জন্য খুলে দিতে বাধ্য হয়।
Read Also:
HS History Suggestion 2022 PDF Download
জাদুঘরের শ্রেণীবিভাগ বা প্রকারভেদ আলােচনা করাে।
অতীতকে স্মরণ করার ক্ষেত্রে কিংবদন্তি এবং স্মৃতিকথার ভূমিকা আলােচনা করাে।
ব্রিটিশ আমলে ভারতের ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থার সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।
ঔপনিবেশিক ভারতে অবশিল্পায়নের কারণ ও ফলাফল ব্যাখ্যা করো।
জাদুঘর কাকে বলে? অতীত পুনর্গঠনে জাদুঘরের ভূমিকা আলােচনা করাে।
ক্যান্টন বাণিজ্য কি? ক্যান্টন বাণিজ্যের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি লেখাে। এই বাণিজ্যের অবসানের কারণ আলােচনা করাে।
নৌ বিদ্রোহের কারণ ও তাৎপর্য আলােচনা করাে।
Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।
Ans ta khub sundar.
Thank you