নীল বিদ্রোহের কারণ গুলি সংক্ষেপে আলােচনা করো। এই বিদ্রোহের ফলাফল আলােচনা করাে।

অথবা, নীল বিদ্রোহের প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য গুলি আলােচনা করো।

উত্তর – নীল চাষ ভারতের একটি প্রাচীন চাষ। বাংলার নীলচাষিরা ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে নীলচাষ তথা নীলকর সাহেবদের যে বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল, তা ‘নীল বিদ্রোহ’ নামে পরিচিত। 

নীল বিদ্রোহের কারণ: নীল বিদ্রোহের পিছনে একাধিক কারণ সক্রিয় ছিল। যথা— 

 i) নীলকরদের অত্যাচার: নীলকররা নীলচাষিদের নানাভাবে অত্যাচার করে নীলচাষ করতে বাধ্য করত। অনিচ্ছুক চাষিদের প্রহার করা, আটকে রাখা, স্ত্রী-কন্যার সম্মানহানি করা, চাষের সরঞ্জাম লুঠ করা, ঘরে আগুন লাগিয়ে দেওয়া প্রভৃতি নানাভাবে চাষিদের অত্যাচার করত। 

ii) দাদন প্রথা : নীলকররা চাষিদের দাদন বা অগ্রিম অর্থ দিত। অভাবের সময় চাষিরা অগ্রিম নিত। প্রতি বিঘায় ২ টাকা অগ্রিম দিয়ে চাষির সবচেয়ে ভালো জমিতে নীলচাষ করাতে বাধ্য করত। একবার কেউ দাদন নিলে সে আর নীলচাষের ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে আসতে পারত না। 

iii) প্রতারণা ও কারচুপি: নীলকররা নীলচাষিদের বিভিন্নভাবে প্রতারিত করত। নীল কেনার সময় নীলের ওজন কম দেখাত, কম দামে নীল বিক্রি করতে বাধ্য করত; তা ছাড়া জোর করে বিভিন্নভাবে অর্থ আদায় করত।

iv) পঞ্চম আইন : ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে লর্ড উইলিয়ম বেন্টিঙ্ক পঞম আইন পাস করে ঘোষণা করেন যে, কোনো চাষি দাদন নিয়ে নীলচাষ না করলে তাকে গ্রেফতার করা হবে ও তার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হবে। এর ফলে নীলচাষিদের উপর অত্যাচার অনেক বেড়েছিল। 

 v)অবিচার : অত্যাচারিত নীলচাষিরা আদালতে গিয়েও সুবিচার পেত না। আইন ছিল নীলকরদের স্বার্থরক্ষার জন্য, চাষিদের জন্য নয়। তাছাড়া পুলিশ, প্রশাসন সবই ছিল নীলকরদের পক্ষে। 

vi) পত্রপত্রিকার প্রভাব : নীলচাষিদের উপর নীলকরদের অবর্ণনীয় অত্যাচারের কথা সে সময়কার বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ও লেখায় প্রকাশিত হয়েছে। হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকা এবং দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ’ নাটক-এ বিষয়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে। 

উপরোক্ত কারণগুলির ফলস্বরূপ নীলচাষিরা বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস ও দিগম্বর বিশ্বাসের নেতৃত্বে নীলকরদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। নীল বিদ্রোহের প্রথম সূচনা হয় তৎকালীন নদিয়া জেলার চৌগাছা গ্রামে। ক্রমে এই বিদ্রোহ বর্ধমান, বাঁকুড়া, মালদা, মুরশিদাবাদ, দিনাজপুর, পাবনা, ফরিদপুর, খুলনা প্রভৃতি অঞলে ছড়িয়ে পড়ে।

নীল বিদ্রোহের ফলাফল/তাৎপর্য/গুরুত্বঃ  

i) এই বিদ্রোহের ফলে সরকার 1860 খ্রিস্টাব্দের 31 ডিসেম্বর নীল তদন্ত কমিশন গঠিত করে। 

ii) কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী 1868 খ্রিস্টাব্দে নীল চুক্তি আইন’রদ করা এবং নীলচাষ সম্পূর্ন চাষীদের ইচ্ছাধীন হয়। নীলকররা এখানে নীলচাষে অর্থ বিনিয়োগ বন্ধ করে বিহার ও পার্বত্য এলাকায় চা শিল্পে বিনিয়োগ করতে শুর করে।

iii) নীল বিদ্রোহের সাফল্য বাঙালি জাতীয়তাবাদ প্রসারে সহায়তা করেছিল। শিশির কুমার ঘোষ লিখেছেন,“নীল বিদ্রোহই সর্বপ্রথম – ভারতবাসীকে সংঘবদ্ধ রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা শিখিয়েছিল”।

এই বিদ্রোহে এমন কয়েকটি বৈশিষ্ট্য ছিল যা অন্যান্য বিদ্রোহগুলিতে ছিল না। 

নীল বিদ্রোহের বৈশিষ্ট্য :

i)নীলকরবিরোধী বিদ্রোহ: নীল বিদ্রোহ ছিল নীলকরবিরোধী বিদ্রোহ এটি অন্যান্য বিদ্রোহের মতো জমিদার বা মহাজনবিরোধী বিদ্রোহ ছিল না। নীলকর সাহেবদের অকথ্য অত্যাচার ও জোরজবরদস্তির বিরুদ্ধে নীলচাষিরা সংঘবদ্ধ হয়েছিল। তাদের লক্ষ্য ছিল নীলচাষ প্রথার পুরোপুরি অবসান ঘটানো 

ii) কৃষকদের কঠোর মনোভাব : নীল বিদ্রোহের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল কৃষকদের কঠোর মনোভাব। এই বিদ্রোহে কৃষকরা দৃঢ়তার সঙ্গে মনস্থির করেছিল যে, মরব তবু নীলচাষ করবনা। শেষপর্যন্ত বিদ্রোহী কৃষকরা বাংলা থেকে নীলচাষ বন্ধ করেছিল। 

iii)আন্দোলনে প্রথম ধর্মঘটের প্রয়োগ : এল নটরাজন বলেছেন, নীলচাষ করতে অস্বীকার করে বাংলার কৃষকরা ভারতের ইতিহাসে প্রথম ধর্মঘটের নজির সৃষ্টি করে। ভারতে কৃষক বিদ্রোহের ইতিহাসে এই ঘটনা ছিল অভিনব।

iv) ধর্মনিরপেক্ষ বিদ্রোহ: ওয়াহাবি, ফরাজি, সাঁওতাল, মুণ্ডা প্রভৃতি বিদ্রোহের অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি ছিল ধর্ম। কিন্তু নীল বিদ্রোহে তা  ছিল না।নীল বিদ্রোহ ছিল মূলত কৃষকদের অধিকার রক্ষার বিদ্রোহ। নীল বিদ্রোহে হিন্দু-মুসলমান সব সম্প্রদায়ের মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলনে শামিল হয়েছিল। 

v) বিদ্রোহে খ্রিস্টান মিশনারিদের সমর্থন : নীল বিদ্রোহে খ্রিস্টান মিশনারিরা  বিদ্রোহীদের সমর্থন করেছিল। তারা নীলচাষিদের উপর নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধেও সোচ্চার হয়েছিল। জেমস লঙ নীলদর্পণ নাটক ইংরেজিতে অনুবাদ করে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। এজন্য তাঁকে জেলেও যেতে হয়েছিল।

উপসংহারঃ- পরিশেষে বলা যায়, নীল বিদ্রোহ বাঙালি সমাজে ব্যাপক চাঞ্চল্য ও আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। বাঙালি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় নীলচাষিদের বিদ্রোহকে সমর্থন করেছিল। হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় তার হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকায় নীলচাষিদের সমর্থনে নিয়মিত লেখা প্রকাশ করতেন। তা ছাড়া অন্যান্য পত্রপত্রিকা ও নাটকে যেভাবে নীল বিদ্রোহকে সমর্থন করা হয়েছিল তা ছিল অভূতপূর্ব।

Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।

3 thoughts on “নীল বিদ্রোহের কারণ গুলি সংক্ষেপে আলােচনা করো। এই বিদ্রোহের ফলাফল আলােচনা করাে।”

  1. ওটা (সরকার 1860 খ্রিস্টাব্দের ১ ডিসেম্বর নীল তদন্ত কমিশন গঠিত হয) হবে না গঠিত করে হবে ৷

    Reply

Leave a Comment