টীকা লেখাে: ভীমবেটকা।

টীকা লেখাে: ভীমবেটকা।
অথবা, ভীমবেটকা সম্পর্কে লেখো।

উত্তর:-

ভূমিকা : মধ্যপ্রদেশের রায়সেন জেলায় ভূপাল শহরের ৪৫ কিমি দক্ষিণে বিন্ধ্যপর্বতের দক্ষিণ ঢালে ভিমবেটকার অবস্থান। ভীমবেটকাকে ২০০৩-এ অন্যতম ‘ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থল’ (UNESCO Heritage Site) বলে ঘোষণা করা হয়েছে। ইউনেস্কোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগের নথিতে এই স্থানটির প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় একটি বৌদ্ধ মঠ-জাতীয় নিদর্শন হিসেবে। পরবর্তীকালে বিষ্ণু ওয়াকাঙ্কর ভূপাল যাবার পথে এই অঞ্চলে স্পেন ও ফ্রান্সে দেখা প্রস্তরখণ্ডের অনুরূপ গঠন দেখতে পান। তিনি ১৯৫৭ সালে প্রত্নতাত্ত্বিকদের একটি দল নিয়ে এখানে উপস্থিত হন এবং অনেকগুলি গুহাবসতি আবিষ্কার করেন, তাঁর রচিত ‘Stone Age Painting in India’ গ্রন্থে, ভীমবেটকার কিছু গুহাচিত্র মুদ্রিত রয়েছে। জেরোম জ্যাকসনের গবেষণায় উল্লেখ আছে।

ভীমবেটকা অঞ্চলে গুহাশ্রয়গুলি বেলেপাথরের পর্বতগাত্রে ১৬০০-২০৫১ ফুট গড় উচ্চতায় আবিষ্কৃত হয়েছে। গুহাশ্রয়গুলি মুখের কাছে ৪-১৬ ফুট উঁচু, ১০-১৬ ফুট লম্বা (একেকটি ১৩০ ফুট লম্বা) এবং ৫ থেকে ৩০ ফুট গভীর। এখানে এক বা একাধিক পরিবার বসবাস করত। 

ভীমবেটকায় গুহাবসতিতে সবচেয়ে প্রাচীন ছবিগুলি আনুমানিক ৩০০০০ বছরের প্রাচীন। এখানে উদ্ভিজ উপাদান থেকে রঙ তৈরি করা হয়। এছাড়াও গুহাচিত্রগুলি যেহেতু গুহার গভীর অংশের দেওয়ালের গায়ে আঁকা হয়েছিল, তাই সময়ের সাথে সাথে রঙ খুব বেশি ক্ষয়প্রাপ্ত হয়নি। ভীমবেটকার প্রাপ্ত ছবিগুলিকে সময়সারণী অনুযায়ী নিম্নোক্তভাবে বর্ণনা করা যায়—

প্রথম যুগ (উচ্চ-পুরাপ্রস্তর যুগ):

এইপর্বের ছবিগুলি আঁকা হয়েছে সবুজ ও গাঢ় লাল রেখাচিত্র দ্বারা। ছবিগুলির বিষয়বস্তু মূলত বৃহাদাকার পশু—যেমন বাইসন, বাঘ, গন্ডার ইত্যাদি।

দ্বিতীয় যুগ (মধ্য-প্রস্তর যুগ):

এইপর্বে প্রাপ্ত ছবিগুলি অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্রাকার, রেখার নক্সা দ্বারা সজ্জিত। বিষয়বস্তুতে জীবজন্তু ছাড়াও মানুষের ছবি ও শিকারের ছবি আঁকা হয়েছে। শিকারের দৃশ্যে ব্যবহৃত অস্ত্র—কাঁটাওয়ালা বর্শা, ছুচালো লাঠি ও ধনুর্বানের নিদর্শন পাওয়া যায়। এছাড়াও গোষ্ঠীগত নাচ, পাখি, বাজনা, মা ও শিশু, গর্ভবতী মহিলা, মৃত পশু কাঁধে পুরুষ, পানভোজন ও মৃতের সমাধিস্থকরণের ছবি অঙ্কিত হয়েছে।

তৃতীয় যুগ (তাম্র-যুগ):

এই পর্বের ছবিগুলি থেকে বোঝা যায় সমসাময়িক গুহাচিত্র গুলির সাথে মালওয়া সমভূমির কৃষিজীবীদের বিনিময় প্রথা ভিত্তিক একটা যোগাযোগ বজায় ছিল। চতুর্থ যুগ (প্রাথমিক-ঐতিহাসিক যুগ) এই পর্বের ছবিগুলিতে প্রথম নান্দনিক লক্ষণ যুক্ত হয়েছে। ব্যবহৃত রঙ প্রধানত লাল, সাদা ও হলুদ।

ভীমবেটকায় ‘চিড়িয়াখানার পাথর’ রূপে পরিচিত একটি পাথরে হাতি, সম্বর ও বাইসন, হরিণের ছবি পাওয়া গেছে একটি পাথরে ময়ূর, সাপ, হরিণ ও সূর্যের ছবি পাওয়া গেছে। প্রাগৈতিহাসিক ছবির মধ্যে ধনুর্বান ও ঢাল-তলোয়ার ব্যবহারকারী শিকারীদের দেখা যায়।

ভীমবেটকায় রঙের ব্যবহার :

ভীমবেটকা গুহাচিত্রে প্রায় ১৬টি রঙের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। প্রধান ব্যবহৃত রঙ ছিল সাদা ও হালকা লাল। তবে গাঢ় লাল, বাদামী হলুদ, পার্পেল, পান্না সবুজ, স্কারলেট, ভার্মেলিয়ন, কালো, কালচে বাদামী, কমলা, ঘন গৈরিক ইত্যাদি রঙের উপস্থিতিও লক্ষ্য করা গেছে। মূলত অজৈব প্রাকৃতিক পদার্থকে গুড়ো করে তাতে জল বা চর্বি বা ডিম মিশিয়ে রঙ তৈরি করা হত। গেরু মাটি থেকে লাল, চুনাপাথর দিয়ে সাদা ও সবুজ চ্যালসিডনি পাথর দিয়ে সবুজ রঙ তৈরি করা হত বলে পুরাতত্ত্ববিদরা অনুমান করেন। চিত্রগুলিতে এক বা একাধিক রঙের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। পশুর লোম বা কাঠবেড়ালির লেজ বা ‘সিমাল’ (রেশম তন্তু) দিয়ে রঙ করার তুলি তৈরি করা হত।

ভীমবেটকার চিত্রে জীবজন্তু :

ভীমবেটকা গুহাচিত্রে অধিকাংশ চিত্রে প্রাণীর ছবি রয়েছে। ভীমবেটকায় মোট ২৯ ধরনের প্রাণীর ছবি পাওয়া গেছে। এর মধ্যে চিতল সর্বাধিক। এছাড়াও বাঘ, চিতাবাঘ, হাতি, গন্ডার, সিংহ, বুনো মহিষ, কালো হরিণ, কাঠবেড়ালি ইত্যাদির ছবি লক্ষ্য করা যায়। পাখি, মাছ, ব্যাঙ, গিরগিটি, কাঁকড়া ইত্যাদির ছবি পাওয়া গেলেও সাপের ছবি পাওয়া যায় নি। পশুপাখির চিত্রগুলি কখনো বাস্তবধর্মী, কখনো অবাস্তব। বহুক্ষেত্রে পশুর দেহের বাইরের অবয়বটি রেখাচিত্রের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়; কখনো বা ‘এক্স-রে’ শৈলীতে পশুর দেহের ভিতরের অস্থি ও অঙ্গগুলি প্রকাশিত হয়। ভীমবেটকায় চিত্রিত শুকরের দেহ শুকরের মত, নাক গন্ডারের মত, ঠোঁট বা অধর হারিত মত। শিশুদের সঙ্গে বাঘ বা চিতাবাঘের চিত্র, খরগোশ লাফানোর দৃশ্য, হনুমান ঝোলার দৃশ্য দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

ভীমবেটকার মানুষ ও শিকারের চিত্র :

ভীমবেটকায় মানুষ, পশু ও শিকারের ছবিগুলি গতিময়। এককভাবে বা যৌথভাবে মানুষ শিরস্ত্রান ও অলঙ্কার পরে লাঠি, বর্শা, তির-ধনুক হাতে বা খালি হাতে শিকার করছে—এমন ছবি পাওয়া গেছে। কোথাও কোথাও শিকারীর সঙ্গে কুকুর চিত্রিত আছে। ভীমবেটকায় মানুষ ও পশুর অবয়ব ত্রিভূজ বা চতুর্ভূজ সৃষ্টি করে তৈরি করা হয়। পুরুষ প্রতিকৃতিগুলি দেশলাই কাঠির আকারে চিত্রিত; নারী শরীরের চিত্রায়ন অনেক বেশি সম্পূর্ণ। পুরুষদের চুল খোলা, মেয়েদের চুল বাঁধা। মনুষ্য প্রতিকৃতিগুলি পশুর ছাল, পাতা বা গাছের ছাল দিয়ে নির্মিত পোষাক পরিহিত। কিছু চওড়া প্রতিকৃতি জ্যামিতিক রেখা দ্বারা অলঙ্কৃত। এরা সম্ভবত নেতৃস্থানীয়। মুখোশ পরিহিত নৃত্যরত মানুষের চিত্রগুলি জাদুকর বলে অনুমান করা হয়। ভীমবেটকার চিত্র থেকে দেখা যায় পুরুষরা শিকার করে এবং নারী খাদ্য তৈরি করে। ভীমবেটকায় মানুষের ফল ও মধু সংগ্রহের চিত্র এবং নাচের চিত্র দেখতে পাওয়া যায়। ভীমবেটকার গুহার গায়ে হাত বা আঙুল বা হাতের তেলোর ছাপ এখনকার মতই কোনো সংস্কার বা বিশ্বাসের প্রতীক কিনা, সেবিষয়ে নিশ্চিতভাবে কিছু অনুমান করা যায় না।

মূল্যায়ন :

ভীমবেটকা গুহাচিত্র গুলি  উপর ভি. এস. ওয়াকাঙ্কার ছাড়াও যশোধর মাধপাল (১৯৭৪) এবং এরউইন ন্যুমেয়ার (১৯৮৩) গবেষণা চালিয়েছিলেন। পুরাতাত্ত্বিক গবেষণায় সমগ্র অঞ্চলটি থেকে প্রস্তরযুগের সংস্কৃতির ধারাবাহিকতার প্রমাণ পাওয়া গেছে (অন্ত্য-আগুলিয়ান থেকে মধ্য-প্রস্তর যুগের শেষভাগ পর্যন্ত)। বিশ্বের প্রাচীনতম পাথরের মেঝেও দেওয়ালও এখানেই দেখা গেছে। এখানে প্রাপ্ত বেশ কিছু কাঁচামাল নিকটবর্তী বারখেড়া অঞ্চল থেকে সংগৃহীত বলে নির্ণয় করা হয়েছে।

Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।

3 thoughts on “টীকা লেখাে: ভীমবেটকা।”

Leave a Comment