হিমবাহের ক্ষয়কার্যের ফলে সৃষ্ট ভূমিরূপের বর্ণনা দাও।

হিমবাহের ক্ষয়কার্যের ফলে সৃষ্ট ভূমিরূপের বর্ণনা দাও।    Class 10 | Geography | 5 Marks

উত্তর:-

হিমবাহের ক্ষয়কার্যের ফলে সৃষ্ট ভূমিরূপ :  হিমবাহের ক্ষয়কার্য শুধু উচু পর্বতের ওপরই সীমাবদ্ধ থাকে এবং এই ক্ষয়কার্যের ফলে উঁচু পার্বত্য অঞ্চলে বিভিন্ন প্রকার ভূমিরূপের সৃষ্টি হয়, যেমন—

1. করি বা সার্ক :
উৎপত্তি : হিমবাহের উৎসমুখী ক্ষয়কার্যের কারণে উঁচু পার্বত্য অঞ্চলে সার্ক বা করি সৃষ্টি হয়। হিমবাহ যখন উঁচু পার্বত্য অঞ্চল থেকে নীচের দিকে নামে তখন একইসঙ্গে হিমবাহের অবঘর্ষ ও উৎপাটন প্রক্রিয়ার দরুন পর্বতের ঢালের পিছনদিকে খাড়া দেয়াল, মধ্যভাগে অর্ধবৃত্তকার গহ্বর এবং সামনে ধাপসমন্বিত হাতলযুক্ত ডেকচেয়ারের মতাে ভূমিরূপ গঠিত হয়। এইরকম ভূমিরূপকে স্কটল্যান্ডে করি এবং ফ্রান্সে সার্ক বলা হয়।
গঠন : একটি করির তিনটি অংশ দেখা যায়— [i] খাড়া দেয়াল: করির পিছনদিকে একটি খাড়া দেয়াল থাকে [ii] অর্ধবৃত্তাকার গর্ত: করির মধ্যভাগে একটি অর্ধবৃত্তাকার গর্ত বা খাত থাকে এবং [iii] উটের কুঁজের মতাে অংশ: করির নীচের দিকে বা প্রান্তভাগে উটের কুঁজের মতাে একটি অংশ বর্তমান। হিমবাহ-গলা জল করিতে জমে হ্রদ সৃষ্টি হলে তাকে বলা হয় করি বা টার্ম হ্রদ, যেমন—হিমালয়, আল্পস প্রভৃতি হিমবাহ অধ্যুষিত পার্বত্য অঞলে এই প্রকার হ্রদ দেখতে পাওয়া যায়।
উদাহরণ: অ্যান্টার্কটিকায় অবস্থিত ওয়ালকট পৃথিবীর গভীরতম করি বা সার্ক।

2. এরিটি বা অ্যারেট :
উৎপত্তি : হিমবাহের উৎসমুখী ক্ষয়ের ফলে একই পর্বতশৃঙ্গের দুই দিকে দুটি করির সৃষ্টি হলে ও তাদের আয়তন ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকলে মধ্যবর্তী সংকীর্ণ খাড়া শিরা বা তীক্ষ্ম প্রাচীরের মতাে অংশকে বলা হয় এরিটি বা অ্যারেট
বৈশিষ্ট্য: [i] এরিটিগুলি প্রায় ছুরির ফলার মতাে ধারালাে হয়। [ii] কোনাে অংশ যদি ভেঙে যায় তাহলে এক সার্ক থেকে অন্য সার্কে যাওয়ার গিরিপথ’ সৃষ্টি হয়।
উদাহরণ : হিমালয় এবং কারাকোরাম পর্বতে অনেক এরিটি দেখা যায়। 

3. পিরামিড চূড়া :
উৎপত্তি : পার্বত্য উপত্যকায় হিমবাহের উৎসমুখী ক্ষয়কার্যের অন্যতম নিদর্শন হল পিরামিড চূড়া। একটি পর্বতের বিভিন্ন দিকে পাশাপাশি তিন-চারটি বিপরীতমুখী করি’র সৃষ্টি হলে সেগুলি ক্রমাগত মস্তকদেশের দিকে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে একটি  পিরামিডের মতাে আকৃতির চূড়া গঠন করে। এজন্য এর নাম পিরামিড চূড়া বা হর্ন।
উদাহরণ: আল্পস পর্বতের ম্যাটারহর্ন এরকম একটি বিখ্যাত পিরামিড চূড়া। গঙ্গোত্রীর কাছে নীলকণ্ঠ শৃঙ্গও পিরামিড চূড়ার নিদর্শন।

চিত্র: করি, এরিটি ও পিরামিড চূড়া

4. ঝুলন্ত উপত্যকা :
উৎপত্তি: অনেকসময় পার্বত্য অঞ্চলে সৃষ্ট অপেক্ষাকৃত বেশি শক্তিশালী ও গভীর প্রধান হিমবাহ উপত্যকায় দু-পাশ থেকে অনেক কম শক্তিশালী অগভীর ছােটো ছােটো হিমবাহ এসে মেশে। গভীরতার এই পার্থক্যের জন্য উপহিমবাহ যেখানে প্রধান হিমবাহে মেশে, সেই মিলনস্থলে দুই উপত্যকার উচ্চতার মধ্যে পার্থক্য দেখা যায়। মনে হয় যেন উপহিমবাহ উপত্যকা প্রধান হিমবাহ উপত্যকার ওপর ঝুলন্ত অবস্থায় আছে। এইভাবে ঝুলে থাকা উপহিমবাহ উপত্যকাকে বলা হয় ঝুলন্ত উপত্যকা
উদাহরণ: হিমালয় পর্বতে বদ্রীনাথের কাছে ঋষিগঙ্গা উপত্যকা এরকম একটি ঝুলন্ত উপত্যকা।

চিত্র: ঝুলন্ত উপত্যকা।

5. U-আকৃতির উপত্যকা বা হিমদ্রোণি:
উৎপত্তি: হিমবাহ পার্বত্য অঞলে যে উপত্যকার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়, তাকে হিমদ্রোণি বলে। ওই উপত্যকায় হিমবাহের পাশ্বক্ষয় ও নিম্নক্ষয় প্রায় সমানভাবে হয় বলে উপত্যকাটি প্রশস্ত, তলদেশ অনেকটাই মসৃণ এবং পার্শ্বদেশ খাড়া ঢালবিশিষ্ট উপত্যকায় পরিণত হয়। অর্থাৎ, উপত্যকাটির আকৃতি ইংরেজি U অক্ষরের মতাে দেখতে হওয়ায় একে U-আকৃতির উপত্যকা বলে।

চিত্র : U-আকৃতির উপত্যকা বা হিমদ্রোণি। 

6. ক্র্যাগ অ্যান্ড টেল:
উৎপত্তি: হিমবাহের গতিপথে অনেকসময় কোনাে কঠিন শিলা উঁচু হয়ে অবস্থান করে, যেমন—কোনাে আগ্নেয় উদবেধ এবং তার পিছনে থাকে কোমল শিলা। এরকম ক্ষেত্রে কঠিন শিলা কোমল শিলাকে হিমবাহের ক্ষয়কার্য থেকে কিছুটা রক্ষা করে। ফলে কোমল শিলা গঠিত অংশ তখন উঁচু ঢিবির আকারে থাকা কঠিন শিলার পিছনে পুচ্ছ (tail) বা ল্যাজের মতাে বিস্তৃত থাকে। এর মধ্যে এবড়ােখেবড়াে উঁচু ঢিবিটিকে ক্র্যাগ এবং পুচ্ছটিকে টেল বলে।
বৈশিষ্ট্য: [i] ক্র্যাগ অ্যান্ড টেলের ক্র্যাগ অমসৃণ আর টেল মসৃণ হয়। [ii] টেল 2 কিমি পর্যন্ত দীর্ঘ হয়ে থাকে।
উদাহরণ: স্কটল্যান্ডের এডিনবরায় একটি সুবৃহৎ ক্র্যাগ অ্যান্ড টেল আছে।

চিত্র: ক্র্যাগ অ্যান্ড টেল।

7. রসে মতানে :
উৎপত্তি: হিমবাহের প্রবাহপথে শিলাখণ্ড ঢিবির আকারে উঁচু হয়ে থাকলে ক্ষয়কার্যের ফলে হিমবাহের প্রবাহের দিকে অবঘর্ষ প্রক্রিয়ায় শিলাখণ্ডটি মসৃণ এবং বিপরীত দিকে উৎপাটন প্রক্রিয়ায় এবড়ােখেবড়াে বা অসমৃণ হয়। এই ধরনের ঢিবির নাম রসে মতানে
বৈশিষ্ট্য: [i] রসে মতানে একটি মাত্র শিলার ওপর গঠিত হয়। [ii] রসে মতানের মসৃণ ঢালকে স্টস এবং অমসৃণ খাড়া ঢালকে লি বলে। [iii] এর উচ্চতা বেশি। [iv] এর বিস্তৃতি ও দৈর্ঘ্য কম।
উদাহরণ: কাশ্মীরে ঝিলামের উপনদী লিডার উপত্যকায় রসে মনে আছে।

চিত্র: রসে মতানে। 

8. ফিয়র্ড :
উৎপত্তি: হিমবাহের ক্ষয়কার্যের ফলে সমুদ্রোপকূলসংলগ্ন পার্বত্যভূমিতে বহু খাত তথা হিমবাহ উপত্যকা সৃষ্টি হয়। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এগুলির গভীরতা বেশি হলে অলটি বরফমুক্ত হওয়ার পর এগুলিতে সমুদ্রের জল প্রবেশ করে। জলপূর্ণ এই খাত বা উপত্যকাগুলিকেই ফিয়র্ড বলে। এর মধ্যে ক্ষুদ্রাকৃতি অগভীর ফিয়র্ডকে ফিয়ার্ড বলা হয়।
বৈশিষ্ট্য: [i] ফিয়র্ড উপকূলে জলের গভীরতা খুব বেশি হয়। [ii] ফিয়র্ডের মাঝের তুলনায় প্রান্তভাগের জলের গভীরতা কম হয়।
উদাহরণ: নরওয়ের সােভনে বা সােজনে পৃথিবীর গভীরতম ফিয়র্ড।

চিত্র: ফিয়র্ড। 

৩. কর্তিত স্পার বা শৈলশিরা :
উৎপত্তি: পার্বত্য উপত্যকা দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার সময় হিমবাহ উপত্যকার দু-পাশের পর্বতশৃঙ্গের পাদদেশীয় বা প্রসারিত অংশগুলিকে ক্ষয় করে এগিয়ে যেতে থাকে। এর ফলে ক্ষয়প্রাপ্ত ও প্রসারিত পার্বত্য অংশগুলি ত্রিভুজাকৃতির যে শৈলশিরার সৃষ্টি করে, সেগুলিকে বলে কর্তিত স্পার বা শৈলশির

Read Also:

বায়ুর ক্ষয়কার্যের ফলে সৃষ্ট ভূমিরূপের চিত্রসহ বর্ণনা দাও।

বায়ুর ক্ষয়কার্যের প্রভাব কোথায় সর্বাপেক্ষা বেশি?

হিমবাহের ক্ষয়কার্যের ফলে সৃষ্ট ভূমিরূপের বর্ণনা দাও।

নদীর ক্ষয়কার্যের ফলে সৃষ্ট ভূমিরূপগুলির বর্ণনা করাে।

বায়ুর ক্ষয়কার্যের ফলে গঠিত ভূমিরূপগুলি বর্ণনা করাে।

Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।

2 thoughts on “হিমবাহের ক্ষয়কার্যের ফলে সৃষ্ট ভূমিরূপের বর্ণনা দাও।”

Leave a Comment