বাঙালির বিজ্ঞানচর্চা | উচ্চমাধ্যমিক বাংলা প্রবন্ধ রচনা

প্রিয় ছাত্রছাত্রীরা, এখানে আমরা বাঙালির বিজ্ঞানচর্চা | উচ্চমাধ্যমিক বাংলা প্রবন্ধ রচনা নিয়ে আলোচনা করলাম। খুব সুন্দর করে গুছিয়ে এই প্রবন্ধ রচনাটি লেখা হয়েছে। আশা করি তোমাদের সবারই ভালো লাগবে। ধন্যবাদ

বাঙালির বিজ্ঞানচর্চা

আনিবার ইতিহাস অঙ্গারের প্রতিভাকে সঞ্চয়ের মত মনে ভেবে
মরণকে যা দেবার:জীবনকে যা দেবার সব
কঠিন উৎসবেঃদীন অন্তঃকরণে দিয়ে দেবে।”

– জীবনানন্দ দাশ

একুশ শতক বিজ্ঞানের শতক। জ্ঞানে-মনীষায় নতুন সমাজের প্রস্তাবনা এই শতকের অঙ্গীকার। আর সেই অঙ্গীকারে দৃপ্তকণ্ঠ বাঙালি। বাঙালি চিরকালই শক্তি অপেক্ষা বুদ্ধিকে অধিক গুরুত্ব দিয়েছে। আর সেই বুদ্ধিচর্চার উন্নত প্রসারণে ক্রমশ স্বরাট হয়ে উঠেছে সে। এভাবেই বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও গোটা পৃথিবীতে আলাদা মর্যাদার অধিকারী হয়ে উঠেছে বাঙালি।

চৈনিক পরিব্রাজক উয়াং চোয়াং-এর বিবরণ থেকে জানা যায়, বৌদ্ধযুগে বিজ্ঞানচর্চার পরিবেশ বর্তমান ছিল এবং তার কেন্দ্রে ছিল নিরীশ্বরবাদ তথা শূন্যবাদ বা জড়-জীবনদর্শন। এই সময়ে বৌদ্ধ বিহারগুলি হয়ে উঠেছিল বিজ্ঞানচর্চার প্রধান কেন্দ্র। উত্তর ও দক্ষিণ ভারত থেকে ব্রাক্ষ্মণদের আগমণে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে বাঙালির বিজ্ঞানসাধনা। মূলত চিকিৎসাবিজ্ঞান ও রসায়নশাস্ত্রে বাঙালির দক্ষতা এই সময়ে প্রকাশ পায়। চক্রপাণি দত্তের চরক ও সুশ্রুতের ওপরে লেখা বই আয়ুর্বেদ দীক্ষিকাও ভানুমতী উল্লেখযোগ্য।

এ ছাড়াও সর্বসারসংগ্রহ, চিকিৎসাসংগ্রহ, দ্রব্যগুণ ইত্যাদি চিকিৎসাবিজ্ঞানে স্মরণীয় সৃষ্টি। মল্লিকার্জুনের শিষ্যধী মহাচন্দ্র, শূরপালের বৃক্ষায়ুর্বেদ ও লৌহপদ্ধতি প্রাচীনকালের বিজ্ঞানসাধনার নিদর্শন হিসেবে উল্লেখযোগ্য। মধ্যযুগের ধর্মীয় সংঘাত, বৈদেশিক আক্রমণ ও সামাজিক নৈরাজ্যের কারণে প্রাচীনকালের বিজ্ঞানসাধনার শক্তিশালী ধারাটি ক্রমেই অবসিত হয়ে যায়। ইংরেজ শাসনকালে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার এই বিজ্ঞানসাধনায় আবার নতুন জোয়ার আনে। ১৭৮৪-তে এশিয়াটিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠা সাহিত্য ও শিল্পকলার সঙ্গে বিজ্ঞানচর্চাতেও বাঙালিকে উদ্বুদ্ধ করে। কলকাতা মেডিকেল কলেজ স্থাপন এই আগ্রহকে আরও বাড়িয়ে দেয়। আর এই সবের ফলশ্রুতিতেই বিজ্ঞানচর্চার কেন্দ্র হিসেবে ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কালটিভেশন অব সায়েন্স’।

আধুনিক যুগের বাঙালির বিজ্ঞানসাধনার কথা বলতে গেলে প্রথমেই মনে আসে জগদীশচন্দ্র বসু, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় এবং সত্যেন্দ্রনাথ বসুর নাম । জগদীশচন্দ্রের মানুষের মস্তিষ্কের স্মৃতিশক্তির অজৈব মডেল, বিদ্যুৎ-চুম্বক তরঙ্গ সম্পর্কে গবেষণা বিজ্ঞান সাধনায় স্মরণীয় সংযোজন। বেতারবার্তার উদ্ভাবকও তিনিই। ‘ক্রেস্কোগ্রাফ’ যন্ত্র আবিষ্কার করে তিনি উদ্ভিদের বৃদ্ধি ও অনুভূতি ক্ষমতাকে প্রমাণিত করেন। ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে বসু বিজ্ঞান মন্দির’ প্রতিষ্ঠা করে বাঙালির বিজ্ঞানসাধনার ক্ষেত্রকে তিনি উন্মুক্ত করে দেন। এই বিজ্ঞানসাধনার স্বীকৃতিস্বরূপ জগদীশচন্দ্র বসু ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে রয়াল সোসাইটির ফেলো, ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের সভাপতি এবং ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে ভিয়েনার একাডেমি অব সায়েন্স-এর বৈদেশিক সদস্য নির্বাচিত হন।

আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় ‘মারকিউরাস নাইট্রেট’ যৌগ আবিষ্কার করে রসায়ন বিজ্ঞানে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। ‘বেঙ্গল কেমিক্যালস্’ প্রতিষ্ঠা তাঁর বিশেষ কীর্তি। ‘হিন্দু রসায়ন শাস্ত্রের ইতিহাস’ প্রফুল্লচন্দ্রের এক অনবদ্য রচনা। প্রফুল্লচন্দ্রের বিশিষ্ট ছাত্র জ্ঞান মুখোপাধ্যায় কোলয়েড রসায়নের আবিষ্কার করেন। এ ছাড়া রসিকলাল দত্ত, পুলিনবিহারী সরকার, নীলরতন ধর, হেমেন্দ্রচন্দ্র সেন প্রমুখ প্রফুল্লচন্দ্রের ছাত্ররা বিজ্ঞানসাধনায় উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন।

কোয়ান্টাম তত্ত্বের ওপর ফিলোজফিক্যাল ম্যাগাজিনে সত্যেন্দ্রনাথ বসুর গবেষণাপত্র ‘প্ল্যাঙ্কের সূত্র ও আলোককোয়ান্টাম প্রকল্প’ প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি করে গোটা বিশ্বজুড়ে। আর এরই ভিত্তিতে তৈরি হয় ‘বোস-আইনস্টাইন থিওরি’। মেঘনাদ সাহা পরমাণু বিভাজনের ‘সাইক্লোট্রন’ যন্ত্র বসিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণাকর্মে নতুন মাত্রা আনেন। তাঁর প্রবন্ধ ‘On Ionisation in the Solar Chromosphere’ গোটা বিশ্বকে আলোড়িত করে। অনেকে এই অভিমত পোষণ করেছেন যে, গ্যালিলিও-র দূরবীক্ষণ যন্ত্র আবিষ্কারের পর যে দশটি আবিষ্কার জ্যোতির্বিজ্ঞানে শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার, মেঘনাদ সাহার তাপীয় সমীকরণ সূত্র তাদের মধ্যে অন্যতম। পারমাণবিক গবেষণার জন্য ১৯৪৮-এ তাঁর প্রচেষ্টাতেই তৈরি হয় ইন্সটিটিউট অব রেডিয়ো ফিজিক্স’ (বর্তমানের ‘সাহা ইন্সটিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্স’ প্রতিষ্ঠানটি।)

এ ছাড়াও পরিসংখ্যান বিজ্ঞানে প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ এবং তাঁর প্রতিষ্ঠিত ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইন্সটিটিউট’ স্মরণীয় নাম। কালাজ্বরের প্রতিষেধক আবিষ্কারক ইউ এন ব্রত্নচারী, পলিপরিন-এর আবিষ্কারক ড. সহায়রাম বসু চিকিৎসাবিজ্ঞানে বিখ্যাত হয়ে আছেন। পদার্থবিদ্যায় শিশিরকুমার মিত্র, নৃতত্ত্ববিজ্ঞানে নির্মলকুমার বসু কিংবা সাম্প্রতিক সময়ে চিকিৎসাবিজ্ঞানে ড. সুভাষ মুখোপাধ্যায়, জীববিজ্ঞানে ড. আনন্দমোহন চক্রবর্তী উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন।

বসু বিজ্ঞান মন্দির, সাহা ইন্সটিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্স, ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিকাল ইন্সটিটিউট কিংবা কালটিভেশন অব সায়েন্সকে কেন্দ্র করে বাঙালির বিজ্ঞানসাধনা আজও ক্রিয়াশীল। উন্নত মেধা, সহজাত সৃষ্টিশীলতা এবং উপযুক্ত গবেষণার পরিকাঠামোর সমন্বয়ে বাঙালি আবার বিশ্বজয় করবে এটাই সমগ্র জাতির বুকের মধ্যে লালিত শ্রেষ্ঠ সুখস্বপ্ন।

Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।

Leave a Comment