বাংলা শব্দার্থ পরিবর্তনের কারণ ও ধারা সমূহ উদাহরণসহ বর্ণনা কর।
আমাদের এই পর্বের আলােচনার বিষয় হলাে – বাংলা শব্দার্থ পরিবর্তনের কারণ ও ধারা শব্দার্থ পরিবর্তনের কারাণ ও ধারাতে যাওয়ার পূর্বে বাংলা শব্দার্থ পরিবর্তন কাকে বলে ? শব্দার্থ তত্ত্ব কী? ইত্যাদি বিষয়ে আমাদের জানা দরকার। তাহলে চলাে আমরা জেনে নিই বাংলা শব্দার্থ তত্ত্ব কী ? ভাষা বিজ্ঞানের যে শাখায় শব্দের উৎপত্তি প্রকৃতি ও অর্থান্তর সম্পর্কে আলােচনা করা হয় তাকে শব্দার্থ তত্ত্ববলে। শব্দ হল কতকগুলি অর্থবহ ধ্বনির সমষ্টি ৷ ভাষার প্রধান প্রাণ সম্পদ হল শব্দার্থ l শব্দের অর্থকে অস্বীকার করে ভাষার বিশ্লেষণ সম্পূর্ণ হয় না। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শব্দের ধ্বনিগত যেমন পরিবর্তন ঘটে তেমনি অর্থেরও পরিবর্তন হয়ে থাকে।
এবার আমরা জেনে নেবাে সাধারণত, যে য়ে কারণে ধ্বনি পরিবর্তন ঘটে থাকে সে সমস্ত কারণগুলাে সম্পর্কে –
১) ভৌগােলিক কারণ :- একই শব্দ ভিন্ন ভিন্ন ভৌগােলিক পরিবেশে ভিন্ন ভিন্ন অর্থ প্রকাশ করে এবং এর ফলে যে ধ্বনি পরিবর্তন ঘটে সেই কারণকে ভৌগােলিক কারণ বলে। যেমন– ‘অভিমান’ কথাটির প্রকৃত অর্থ বা আদি অর্থ ছিল ‘অনুরাগ’ কিন্তু বর্তমানে হয়েছে ‘অহংকারা’ l আবার ‘শাক’ শব্দটি দক্ষিণ ভারতে ‘নিরামিষ আহার’ অর্থে প্রযােজ্য।
২) ঐতিহাসিক কারণ :- সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে বাঐতিহাসিক পরিবর্তনে শব্দের অর্থ পরিবর্তিত হয়। যেমন – প্রাচীনকালে বিবাহকথাটির অর্থ ছিল বিশেষভাবে ঘােড়ার পিঠে ‘বিবাহযােগ্য কন্যাকে হরণ করে আনা’ l কিন্তু বর্তমানে বিবাহ কথাটির অর্থ ‘পরিনয়’ l
৩) উপাদান জনিত কারণ :- কোনাে উপাদানের (যে সমস্ত বস্তু দ্বারা কোনাে একটি বিশেষ বস্তু তৈরি হয়) সাদৃশ্যে বস্তুটির সার্বিক নাম করণ ঘটলে শব্দের যে অর্থ পরিবর্তন হয় তাকে উপাদান জনিত পরিবর্তনের কারণ বলে।যেমন – কালাে রঙের তরল লেখার উপকরণের’ সাদৃশ্যে এখন যে কোনাে রঙের লেখার তরল উপকরণকে কালি বলে l যেমন – নীলকালি, লালকালি ।
৪) সাদৃশ্য জনিত কারণ :- সাদৃশ্য জনিত কারণে শব্দের অর্থ পরিবর্তিত হয়। যেমন – তিল এক প্রকার কাল রঙের ছােট দানা শস্য ৷এই সাদৃশ্যে মানুষের গায়ের যে কোনাে কালাে দাগকে ‘তিল’ বলা হয়।
৫) সংস্কার জনিত কারণ :- অনেক সময় সংস্কার জনিত কারণের ফলেও শব্দের অর্থ পরিবর্তিত হয় ৷ যেমন – ক্ষেত্র বিশেষে ‘সাপ’ কথাটি ‘লতা’ অর্থে ব্যবহৃত হয়। ঘরে কিছু না থাকলে বলা হয় ‘বাড়ন্ত’ l
৬) অজ্ঞতা জনিত কারণ :- অজ্ঞতা বা না জানার ফলেও শব্দের অর্থ পরিবর্তিত হয় ৷ যেমন – ‘পাষন্ড’ কথাটির অর্থ ছিল ‘বৌদ্ধ সন্ন্যাসী’ কিন্তু বর্তমানে অর্থ হয়েছে ‘নিষ্ঠুর’ l
৭) শব্দ সংক্ষেপ জনিত কারণ :- বড় শব্দকে সংক্ষিপ্ত করার প্রয়াসে শব্দের অর্থ পরিবর্তন ঘটে। যেমন – ‘নিউজ পেপার’ থেকে ‘পেপার’ l
৮) আলংকারিক প্রয়ােগ জনিত কারণ :- অনেক সময় অমার্জিত অনৈতিক শব্দকে মার্জিত নৈতিক করে উচ্চারণ করা হয় একে আলংকারিক প্রয়ােগ বলা হয়। যেমন – ‘জেলখানা’> ‘শীঘর’,’ব্যবসায় ক্ষতিকে’ বলা হয় ‘গণেশ উল্টানাে’ l
এবার আমরা চলে আসছি, শব্দার্থ পরিবর্তনের ধারা গুলোতে
সজীব ভাষার ধর্মই হলো পরিবর্তন শীলতা l স্থান ও সময়ের প্রবাহে পরিবর্তিত হয় শব্দের আদি অর্থ বা মূল অর্থ l একই শব্দে আসে অর্থর নতুনত্বের ব্যঞ্জনা, শব্দের এই অর্থ পরিবর্তনের ধারাকে ভাষাবিজ্ঞানীরা পাঁচটি ভাগে ভাগ করেছেন l যথা –
১) অর্থ বিস্তার বা প্রসার :- আমরা অর্থ বিস্তার প্রসার নামটির মধ্যে দিয়েই বুঝতে পারছি যে, কোনাে শব্দ তার সংকীর্ণ বা ক্ষুদ্র অর্থ পরিত্যাগ করে ব্যাপক বা বৃহৎ অর্থে গৃহীত হবে।
তাহলে অর্থ বিস্তার প্রসারের সংজ্ঞা হিসেবে আমরা বলতে পারি যে অনেক সময় দেখা যায় কোন শব্দ তার বুৎপত্তিগত অর্থ বা সীমাবদ্ধ অর্থ পরিত্যাগ করে ব্যাপকতর কোনাে অর্থ প্রকাশ করে l শব্দের অর্থ পরিবর্তনের এরূপ ধারাকে শব্দের অর্থ বিস্তার বা প্রসার বলে।
যেমন – ‘তেল’ কথাটির আদি অর্থ ছিল ‘তিলের নির্যাস’ l কিন্তু বর্তমানে তার অর্থ হয়েছে ‘যে কোনাে দানা শস্যের নির্যাস’। একটি বিশেষ দানা শস্যের নির্যাস থেকে সব ধরনের দানা শস্যের নির্যাস অর্থে গ্রহন করার ফলে অর্থের বিস্তার প্রসার বা ঘটেছে ।
২ )অর্থ সংকোচ :- এটি হল অর্থ বিস্তারের বিপরীত প্রক্রিয়া।নামটির মধ্যে দিয়েই আমরা বুঝতে পারছি যে কোনাে শব্দের অর্থ পূর্বে বিস্তারিত ছিল বা ব্যাপক অর্থে গৃহীত হত কিন্তু বর্তমানে সংকীর্ণ অর্থে গৃহীত হয় l
তাহলে আমরা অর্থ সংকোচের সংজ্ঞা হিসেবে বলতে পারি যে, শব্দ যদি তার ব্যাপক অর্থ হারিয়ে অপেক্ষাকৃত সংকীর্ণতর অর্থে ব্যবহৃত হয় তবে সেই প্রক্রিয়াকে অর্থের সংকোচ বলে।
যেমন – ‘অন্ন’ কথাটির আদি অর্থ ছিল ‘যেকোনাে ধরনের খাদ্য’ কিন্তু বর্তমানে এর অর্থ হয়েছে ‘চাল থেকে প্রস্তুত বিশেষ এক ধরনের খাদ্য’ l সব ধরনের খাবার থেকে কেবল মাত্র একটি বিশেষ খাবার অর্থ গ্রহণ করার ফলে এর অর্থের সংকোচ ঘটেছে।
৩) অর্থের রূপান্তর বা অর্থ সংশ্লেষ বা অর্থ সংক্রম :- অর্থের রূপান্তর বলতে আমরা বুঝতে পারছি যে, কোনাে শব্দ তার পূর্ব অর্থ বা আগের অর্থকে অস্বীকার করে এক সম্পূর্ণ নতুন অর্থে গৃহীত হবে ৷
তাহলে আমরা অর্থের রূপান্তর বা অর্থ সংশ্লেষ বা অর্থ সংক্রম – এর সংজ্ঞা নির্দেশ করতে পারি এভাবে – শব্দ যদি তার প্রচলিত আদি অর্থ পরিত্যাগ করে সম্পূর্ণ নতুন অর্থে ব্যবহৃত হয়, তবে শব্দার্থ পরিবর্তনের সেই ধারাকে অর্থ সংশ্লেষ বা অর্থ সংক্রম বা অর্থের রূপান্তর বলে।
যেমন – সন্দেশ কথাটির আদি অর্থ ছিল ‘খবর’ বা বার্তা কিন্তু বর্তমানে এর অর্থ হয়েছে মিষ্টান্ন বিশেষ এখানে অর্থের সম্পূর্ণ পরিবর্তন বা রূপান্তর ঘটেছে।
৪) অর্থের উৎকর্ষ :- নামটির মধ্যে দিয়েই আমরা বুঝতে পারছি যে, কোনাে শব্দ তার সাধারণ অর্থ পরিত্যাগ করে উৎকর্ষবাচক বা ভালাে কোনাে অর্থে বা কোনাে উৎকৃষ্ট অর্থে গৃহীত হবে।
তাহলে আমরা অর্থের উৎকর্ষের সংজ্ঞ হিসেবে বলতে পারি যে, শব্দ যদি তার সাধারণ অর্থ পরিত্যাগ করে অপেক্ষাকৃত উন্নত বা উৎকর্ষবাচক অর্থে গৃহীত হয় তবে শব্দের অর্থ পরিবর্তনের সেই ধারাকে অর্থের উৎকর্ষ বলা হয়।
যেমন – ‘মন্দির’ কথাটির আদি অর্থ ছিল মানুষের গৃহ কিন্তু বর্তমানে এর অর্থ হয়েছে ‘দেবতার আলয়া’ আমরা জানি যে মানুষের গৃহ থেকে দেরতার আলয় যথেষ্ট উৎকৃষ্টবাচক।
৫) অর্থের অপকর্ষ :- অর্থের উৎকর্ষের বিপরীত প্রক্রিয়া হল অর্থের অপকর্ষী l অর্থাৎ কোনাে শব্দ তার উৎকর্ষবাচক অর্থ হারিয়ে অপকৰ্ষাত্মক অর্থে গৃহীত হবে।
তাহলে অর্থের অপকর্ষের সংজ্ঞা হিসেবে আমরা বলতে পারি, শব্দ যদি তার প্রচলিত অর্থ ত্যাগ করে অপেক্ষাকৃত হীন বা নিকৃষ্ট অর্থে ব্যবহৃত হয়, তবে শব্দের অর্থ পরিবর্তনের সেই ধারাকে অর্থের অপকর্ষ বলে।
যেমন – ‘ঠাকুর’ শব্দটির আদি অর্থ ছিল ‘দেবতা’ কিন্তু বর্তমানে তার অর্থ হয়েছে ‘বাঁধুনি ঠাকুর’ বা ‘পাঁচক’ l ঠাকুর বা ‘দেবতা’ থেকে সাধারণ পাঁচক অবশ্যই নিকৃষ্ট।
Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।
এই নোট টি খুব উপকারী