Class 11 Class 11 Education বাংলার নবজাগরণে বিদ্যাসাগরের বহুমুখী অবদান সংক্ষেপে লেখাে।

বাংলার নবজাগরণে বিদ্যাসাগরের বহুমুখী অবদান সংক্ষেপে লেখাে।

বাংলার নবজাগরণে বিদ্যাসাগরের বহুমুখী অবদান সংক্ষেপে লেখাে।

উত্তর : 

বাংলার নবজাগরণে বিদ্যাসাগরের বহুমুখী অবদান : 

উনবিংশ শতাব্দীতে বাংলায় নবজাগরণের অন্যতম পুরােধা ছিলেন বিদ্যাসাগর। সমাজসংস্কার, শিক্ষাসংস্কার ও সাহিত্যসৃষ্টির মধ্য দিয়ে জাতির জাগরণে তিনি বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন একজন মহান শিক্ষাসংস্কারক। তিনি প্রাথমিক শিক্ষা, স্ত্রীশিক্ষা, উচ্চশিক্ষা, সর্বজনশিক্ষা প্রভৃতি প্রসারে উল্লেখযােগ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। 

[1] সমাজসংস্কারমূলক কাজ : সমাজসংস্কারের ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগরের সবচেয়ে বড়াে ভূমিকা হল বিধবাবিবাহ প্রচলন। বিদ্যাসাগর বহুবিবাহ, বাল্যবিবাহ, কৌলীন্যপ্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তােলেন। তাঁর প্রচেষ্টায় 1856 খ্রিস্টাব্দে বিধবাবিবাহ আইন পাস হয়। তৎকালীন গভর্নর জেনারেলের কাছে বহুবিবাহ বন্ধ করার জন্য তিনি আবেদন জানান। 1857 খ্রিস্টাব্দে মহাবিদ্রোহ শুরুর কারণে প্রথাটি আইন করে বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু বহুবিবাহের কুফল সম্পর্কে জনমত গড়ে তােলা সম্ভব হয়েছিল।

[2] গ্রাথমিক শিক্ষার প্রসার : বিদ্যাসাগর এদেশের প্রাথমিক শিক্ষার দুর্দশা উপলদ্ধি করেন। তিনি তৎকালীন বড়ােলাট লর্ড ডালহৌসির কাছে প্রাথমিক শিক্ষার ব্যাপারে কতকগুলি বিষয়ে সুপারিশ করেছিলেন, তার মধ্যে উল্লেখযােগ্য ছিল— (i) সর্বজনশিক্ষার প্রসার, (ii) প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন, (iii) শিক্ষক-শিক্ষণের ব্যবস্থা (iv) বিদ্যালয় পরিদর্শন ও প্রশাসনিক উন্নয়ন করা। সেইসময় তার প্রচেষ্টায় 20টি মডেল স্কুল গড়ে ওঠে এবং উপযুক্ত শিক্ষক প্রশিক্ষণের জন্য নর্মাল স্কুল স্থাপিত হয়। এইসমস্ত স্কুলে পাঠ্যসূচিতে মাতৃভাষার মাধ্যমে ভাষা, নীতিকথা, জ্যামিতি, ইতিহাস, ভূগােল, জীবনবৃত্তান্ত বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার পাঠদান। করা হত। 

[3] বাংলা ভাষার উন্নতিসাধন : তিনি বাংলা ভাষাকে সহজসরল করে তােলেন। তিনি বাংলা ভাষায় পুস্তকের প্রয়ােজনীয়তা অনুভব করেন। বাংলা ভাষায় তার অনবদ্য সৃষ্টি হল বর্ণপরিচয়’– বর্ণপরিচয় প্রথম ভাগ (1855 খ্রিস্টাব্দ); বর্ণপরিচয় দ্বিতীয় ভাগ (1855 খ্রিস্টাব্দ)। শিশুপযােগী করে স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণের বৃষলত্ব হ্রাস করেন। তিনি কথ্য ভাষার ওপর জোর দেন এবং বাক্যের মধ্যে যতি চিহ্নের প্রচলন করেন। এ ছাড়া অত্যন্ত সহজ বাংলায় সংস্কৃত ব্যাকরণের ওপর গ্রন্থরচনা করেন এবং অনুবাদ সাহিত্য রচনা করেন। 

[4] স্ত্রীশিক্ষার প্রসার : নারীর অধিকার ও শিক্ষা সম্পর্কে তৎকালীন সমাজ অত্যন্ত উদাসীন ছিল। তিনি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপনে বিশেষ উদ্যোগী ছিলেন। নারীদের শিক্ষাবিস্তারে তিনি প্রবল উৎসাহী ছিলেন। 1849 খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত ‘হিন্দু ফিমেল স্কুল’ পরবর্তীকালে নাম ‘বেথুন স্কুল। তিনি এই স্কুলে সম্মানীয় সম্পাদক ছিলেন ও সেইসময়ে বিদ্যাসাগর নিজে বিদ্যালয় পরিদর্শক ছিলেন। এইসময় তিনি বাংলার বিভিন্ন জেলায় মেয়েদের জন্য বিদ্যালয় স্থাপন করেন। তাঁর প্রচেষ্টায় 1858 খ্রিস্টাব্দে হুগলিতে 23টি, বর্ধমানে 11টি, মেদিনীপুর জেলাতে 3টি ও নদিয়ায় টি মােট 35টি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি বিদ্যালয়ে শিক্ষকদের বেতনসহ অন্যান্য ব্যয়ভার বহন করতেন। বিদ্যালয়ের ব্যয়ভার চালানাের জন্য তিনি একটি অর্থভাণ্ডারও গড়ে তুলেছিলেন।

[5] সংবাদপত্র ও জনশিক্ষা : গণশিক্ষার প্রসারে তিনি সর্বদা সচেষ্ট ছিলেন। এর জন্য তিনি তত্ত্ববােধিনী, সর্বশুভকরী, সােমপ্রকাশ, Hindu Patriot প্রভৃতি পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এই ধরনের পত্রপত্রিকাতে তিনি জনশিক্ষা ও সমাজ সম্পর্কে বিভিন্ন মতামত প্রকাশ করতেন। 1853 খ্রিস্টাব্দে গণশিক্ষার প্রথম প্রয়ােজনের কথা ভেবে বিশেষ প্রতিবেদন রচনা করেন। 

[6] উচ্চশিক্ষার প্রসার : উচ্চশিক্ষা প্রসারে বিদ্যাসাগরের ভূমিকা অনস্বীকার্য। তাঁর প্রচেষ্টায় ‘মেট্রোপলিটন ইন্সস্টিটিউশন (1864) নামক বিদ্যালয়টি উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়

(অধুনা বিদ্যাসাগর কলেজ)। এটি প্রথম ভারতীয় কলেজ (First Indian College) আইনের কোর্স (1884), স্নাতক (সাম্মানিক) (1885) এবং স্নাতকোত্তর বা MA কোর্স এই প্রতিষ্ঠানে শুরু হয়। প্রতিষ্ঠানের গৃহ নির্মাণের খরচ সম্পূর্ণভাবে বিদ্যাসাগর বহন করেছিলেন। এই প্রতিষ্ঠানের শ্যামপুকুর শাখা (1884), বউবাজার শাখা (1885), বড়ােবাজার শাখা (1887) ইত্যাদি শাখা ছিল। তিনি সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন আবার পরীক্ষা পর্ষদ (Board of Examiners) -এর সদস্য ছিলেন। এইসব পদ অলংকৃত করার সময় তিনি উচ্চশিক্ষার আমুল পরিবর্তনের প্রচেষ্টা করেন। এ ছাড়া উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়-এর প্রতিষ্ঠা কমিটির সদস্য ছিলেন (1855 খ্রিস্টাব্দ)। 1857 খ্রিস্টাব্দে তিনি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ফেলাে’-রূপে মনােনীত হয়েছিলেন। 

[7] সাহিত্যের উন্নতি : সাহিত্যের উন্নতিসাধনে তাঁর। ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য, যা জাতিকে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করেছে। অনেকের মতে তিনি বাংলা গদ্যের জনক। অক্ষর জ্ঞানের জন্য বর্ণপরিচয় ছাড়া ভাষা শিক্ষার জন্য তিনি রচনা করেন কথামালা’ এবং বােধােদয়। তিনি সংস্কৃত সাহিত্য, ইংরেজি সাহিত্য-এর বহু পুস্তক বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেন। এদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য হল— ‘বেতাল পঞ্চবিংশতি, শকুন্তলা’, ‘ভ্রান্তিবিলাস’, ‘বাঙলার ইতিহাস’ ইত্যাদি। তিনি ব্যাকরণ শিক্ষার জন্য বাংলা ভাষায় লেখেন—উপক্রমণিকা, ব্যাকরণ কৌমুদী যা সংস্কৃত কলেজের পাঠক্রমে স্থান পেয়েছিল। 

উপসংহার :

বাংলা তথা ভারতবর্ষে ঊনবিংশ শতাব্দীতে। যেসব মনীষী নবজাগরণে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন তাঁর মধ্যে বিদ্যাসাগর ছিলেন অনন্য। তিনি সমাজসংস্কার, শিক্ষাসংস্কার ও জাতীয়তাবােধের মধ্য দিয়ে জাতিকে জাগিয়ে তুলেছিলেন। বিদ্যাসাগরের চিন্তা, কর্ম, বাস্তবতাবােধ যা আজও জাতির কাছে পাথেয়।

Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।

Leave a Comment