বাংলার উৎসব – মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা
উত্তর:
বাংলার উৎসব
‘বাঙালির বারাে মাসে তেরাে পার্বণ’— বাঙালি জাতির উৎসবপ্রিয়তার কথা মাথায় রেখেই এই কথার প্রচলন হয়েছে। কে আপন করে নেওয়ার দুর্লভ গুণ বাঙালির সহজাত—আর উৎসব মানেই তাে তাই, পারম্পরিক মিলন, ভাবের আদানপ্রদান। সেই কারণেই হয়তাে বাঙালির জীবনে উৎসবের এই প্রাধান্য। অনেক প্রাকৃতিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা টালমাটাল করে দিয়েছে বাঙালির জীবন। বন্যা, খরা, দুর্ভিক্ষ আঘাত হেনেছে বাংলাদেশের সবুজ, কোমল প্রান্তরে। দেশভাগের যন্ত্রণা, দাঙ্গার ক্ষত বুকে বয়ে নিয়েও বাঙালি আবার উঠে দাঁড়িয়েছে। ‘উদার ছন্দে, পরমানন্দে’ নরদেবতাকে সঙ্গে নিয়ে আবার উৎসবের আয়ােজন করেছে।
দৈনন্দিন জীবনের একঘেয়েমি যখন মানুষকে ক্লান্ত করে তােলে, তখন সেই প্রাত্যহিকতায় এক ঝলক মুক্ত হাওয়া বয়ে আনে উৎসব। রােজকার রুটিনবাঁধা জীবন থেকে ছাড়া পেয়ে সবাই তাই খুশিতে মেতে ওঠে। উৎসব তাই আমাদের মানসিক পরিচর্যা ঘটিয়ে আবার নতুন উদ্যমে কাজের জগতে ফিরিয়ে নিয়ে আসে। সাময়িক বিরাম তাই মানুষকে আরও বেশি কর্মক্ষম করে তােলে। বর্তমানের ব্যস্ততাময় জীবনে আমরা বড়াে বেশি আত্মসর্বস্ব হয়ে পড়েছি। সবাই সবসময় ছুটে চলেছে, কারও দিকে তাকাবার অবকাশ নেই। কিন্তু সেই অবকাশটা এনে দেয় উৎসব—যে আনন্দ আমরা সবাই মিলে ভাগ করে নিই। উৎসবের মূল সুরই তাে তাই—“আমার আনন্দে সকলের আনন্দ হউক, আমার শুভে সকলের শুভ হউক, আমি যাহা পাই তাহা পাঁচজনের সহিত মিলিত হইয়া উপভােগ করি—এই কল্যাণী ইচ্ছাই উৎসবের প্রাণ”।
উৎসবপ্রিয় বাঙালির উৎসবের জন্য কোনাে বিশেষ উপলক্ষ্য লাগে না। প্রাণের উৎসবে মাতােয়ারা বাঙালির উৎসবগুলিকে তাও কয়েকটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়—জাতীয় উৎসব, ঋতু উৎসব, ধর্মীয় উৎসব, সামাজিক ও পারিবারিক উৎসব।
এইভাবে শ্রেণিভুক্ত করলেও দেখা যায় একটি উৎসবের সঙ্গে অন্য একটি উত্সব কখনও সূক্ষ্মভাবে কখনও ব্যাপকভাবে সম্পৃক্ত হয়ে আছে। জাতীয় উৎসবগুলি হল—স্বাধীনতাদিবস, প্রজাতন্ত্র দিবস, মহাত্মা গান্ধির জন্মদিন। এই দিনগুলিতে সমগ্র ভারতবর্ষের সঙ্গে বাঙালিও উৎসবে মেতে ওঠে। এ ছাড়া আছে নেতাজির জন্মদিন, রবীন্দ্রজয়ন্তী ইত্যাদিও। এইগুলি বাঙালির নিজস্ব জাতীয় উৎসব। বাঙালি জাতির অপার সৌভাগ্য যে, ছয় ঋতু তার সৌন্দর্যের ডালি নিয়ে বছরের বিভিন্ন সময়ে বাঙালির দরজায় এসে উপস্থিত হয়। বাঙালিও সেই আহ্বানে সাড়া দিতে কখনও কার্পণ্য করে না। বাংলা কৃষিপ্রধান দেশ—তাই নতুন ধান ঘরে তােলার উৎসব সে পালন করে নবান্ন উৎসবের মধ্য দিয়ে। তবে প্রাকৃতিক উৎসবগুলি অনেক সময়ই উপস্থাপিত হয় ধর্মীয় মােড়কে। যেমন—নতুন শস্য রােপণের উৎসবটির প্রতীক হিসেবে পালিত হয় ইতুলক্ষ্মীর ব্রত উৎসব। এ ছাড়া বসন্ত যখন চারদিক রাঙিয়ে তােলে তখন বাঙালিও নিজেদের রাঙিয়ে নেয় দোল উৎসবের মধ্য দিয়ে। বাঙালির উৎসবের একটা বড় অংশ জুড়ে আছে বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসব। তার মধ্যে যেমন আছে দুর্গাপুজো, কালীপুজো, জগদ্ধাত্রীপুজো, রাস উৎসব, রথযাত্রা, সরস্বতী পুজো, বাসন্তী পুজো, গুরুপুর্ণিমা, তেমনি আছে ইদ-উল-ফেতর, ইদুজ্জোহা, মহরম, বড়ােদিন প্রভৃতি। সাম্প্রদায়িকতা কখনওই বাঙালির উৎসবমুখরতার মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করতে পারেনি। একজনের আনন্দ কীভাবে পাঁচজনের আনন্দ হয়ে উঠতে পারে তার সফল দৃষ্টান্ত বাঙালির সামাজিক উৎসবগুলি। বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর যে কল্যাণী ইচ্ছার কথা বলেছেন তার সার্থক প্রকাশ পাই অন্নপ্রাশন, উপনয়ন, বিবাহ ইত্যাদি উৎসবের মধ্যে। এ ছাড়াও আছে ভাইফোঁটা, জামাইষষ্ঠীর মতাে পারিবারিক উৎসবের মধ্যে সুখ খুঁজে নেওয়া।
উৎসব তাই বাঙালির জীবন জুড়ে। ব্যক্তিগত আবেগে সামাজিক উচ্ছাসে বাঙালি উৎসবকে বরণ করে নেয়। এর মধ্যেই নিহিত আছে বাঙালির অতীত বর্তমান-ভবিষ্যৎ l কোনাে প্রাকৃতিক অথবা রাজনৈতিক দুর্বিপাক যাকে ভাঙতে পারেনি।
আরো পড়ুন
মানবধর্ম – মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা
হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা – মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা
শিক্ষাবিস্তারে গণমাধ্যম | মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা
সর্বশিক্ষা অভিযান – মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা
বিজ্ঞানসাধনায় ভারত – মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা
Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।