ভারতবর্ষে সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা কাকে বলে | প্রাথমিক শিক্ষা সর্বজনীকরণের সমস্যা এবং এর সমাধান

ভারতবর্ষে সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা কাকে বলে | প্রাথমিক শিক্ষা সর্বজনীকরণের সমস্যা এবং এর সমাধান গুলি আলোচনা করো

উত্তর :

ভারতবর্ষে সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা :

জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ নির্বিশেষে 6-14 বছর বয়স। পর্যন্ত প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণি অবধি এদেশের সকল শিশুর অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক। শিক্ষার অধিকারই হলাে সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা।

প্রাথমিক শিক্ষা সর্বজনীকরণের সমস্যা :

যে কারণের জন্য এখনও লক্ষ্যপূরণ । সম্ভব হয়নি সেই কারণগুলি হলাে—

1) সরকারের আর্থিক সমস্যা : অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা। প্রবর্তন করতে গেলে প্রচুর পরিমাণ অর্থের প্রয়ােজন। শিক্ষার জন্য অর্থের অভাব বিটিশ যুগ থেকে চলে আসছে। UNESCO এর প্রতিবেদন অনুযায়ী বেলজিয়াম, চিলি, ঘানা। প্রভৃতি ছােটো দেশেও শিক্ষার খাতে বরাদ্দের পরিমাণ জাতীয় বাজেটের 17%-20%। স্বাধীনতার পরে গঠিত কোঠারি কমিশন (1964-66) শিক্ষাখাতে বরাদ্দের পরিমাণ 6% করার পরামর্শ দিয়েছিল। কিন্তু আমাদের দেশে তা আজও 3% রয়ে গেছে।

জনসংখ্যার বিস্ফোরণ :

 বর্তমানে ভারতে যেভাবে দ্রুতহারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে সেই বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে না। ফলে প্রাথমিক শিক্ষার প্রসার ও উৎকর্ষতার ক্ষেত্রে নানান বাধার সৃষ্টি হচ্ছে।

সাধারণ মানুষের আর্থিক অসচ্ছলতা ও মানসিকতার অভাব :

 সাধারণ মানুষের আর্থিক অনটন প্রাথমিক শিক্ষায় বড়াে বাধা। আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে অভিভাবকগণ সন্তানদের স্কুলে না পাঠিয়ে কোনাে শিল্পকলকারখানায় কাজে পাঠাতে বেশি আগ্রহী। ফলে শুধুমাত্র অর্থের অভাবকেই দায়ী করা যায় না। দায়ী হলাে অভিভাবকদের মানসিকতাও। বর্তমানে দেখা যায় সরকারি পদক্ষেপ নেওয়া হলেও অভিভাবকদের সদিচ্ছার অভাবে। সন্তানগণ ন্যূনতম প্রাথমিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

অপচয় ও অনুন্নয়ন : 

প্রাথমিক শিক্ষার অগ্রগতির আরও একটি প্রধান বাধা হলাে অপচয় ও অনুত্তীর্ণতা। এই অপচয় বলতে বােঝায় যেসকল শিশু বিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও শিক্ষা সমাপ্তির আগেই বিদ্যালয় ছেড়ে দেয় এবং অনুন্নয়ন বলতে বােঝায় একই শ্রেণিতে বারবার করে উত্তীর্ণ না হওয়া। দুটিতেই শিক্ষার্থীরা মাঝপথে পড়াশােনা বন্ধ করে দেয়।

মেয়েদের শিক্ষায় বাধা :

 সর্বজনীন শিক্ষা কথার অর্থ হলাে—সকল বর্ণের ছেলে-মেয়েদের সমানভাবে শিক্ষায় অংশগ্রহণ করা। একবিংশ শতাব্দীতে পৌছে এখনও মানুষ সামাজিক কুসংস্কারে আচ্ছন্ন। অনেক পরিবারের অভিভাবকগণ মেয়েদের স্কুলে পাঠিয়ে পড়াশােনা শেখানাের চেয়ে সংসারের কাজকর্ম শেখাতে বেশি আগ্রহী। ফলে জনসংখ্যার একটা বড়াে অংশ শিক্ষালাভে বতি হচ্ছে। এতে সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা

ভাষার সমস্যা :

 অন্যান্য সমস্যার মতাে ভাষা সমস্যাও প্রধান। বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষায় ভাষা ব্যবহৃত হয় 15টা। কিন্তু ভারতে 875 টি ভাষা ব্যবহৃত হয়। কিছু ভাষা সহস্রাধিক লােক ব্যবহার করে তাদের কোনাে নির্দিষ্ট পাঠ নেই। এই অবস্থায় প্রাথমিক স্তরে ভাষা নির্বাচন একটা বিরাট সমস্যা।

উপরিউক্ত কারণগুলি ছাড়াও রয়েছে বহুবিধ কারণ। যেমন — বাড়ি থেকে বিদ্যালয়ের দূরত্ব, কর্মহীনতা, বেকারত্ব, ভৌগােলিক অবস্থান, স্কুলভবনের সমস্যা প্রভৃতি প্রাথমিক শিক্ষার সর্বজনীকরণে বাধা সৃষ্টি করে চলেছে।

প্রাথমিক শিক্ষার সমস্যাগুলির সমাধান :

প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে সমস্যা রয়েছে। সেগুলি সমাধানের জন্য যেসকল ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায় সেগুলি হলাে—

1) বিদ্যালয়ের সংখ্যাবৃদ্ধি : ভারতবর্ষের জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে। প্রতি এক বর্গ কিলােমিটারের মধ্যে একটি করে প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে হবে। যাতে সবাই বিদ্যালয় যেতে পারে।।

2) আর্থিক বরাদ্দ বৃদ্ধি : প্রাথমিক শিক্ষার জন্য সরকারি বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে, যা শিক্ষার গুণগত ও পরিমাণগত মান বৃদ্ধিতে সাহায্য করবে।

3) আকর্ষণীয় পাঠ্যক্রম : প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ্যক্রমকে আকর্ষণীয় করতে হবে। কারণ এই পাঠ্যক্রম শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করবে, উদ্দীপিত করবে এবং শিক্ষার্থী এটি গ্রহণে আগ্রহী হবে। অর্থাৎ বাস্তব জীবনের সঙ্গে সংগতি রেখে প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ্যক্রম রচনা। করতে হবে।।

4) শিক্ষার্থীদের উৎসাহ প্রদান : প্রাথমিক শিক্ষা বিষয়ে শিক্ষার্থীদের উৎসাহ প্রদান করা প্রয়ােজন। তারা যাতে প্রাথমিক শিক্ষাগ্রহণে আগ্রহী হয়, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে।।

5) প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক নিয়োেগ : একজন উপযুক্ত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকই পারেন ছাত্রদের সবচেয়ে বেশি উদ্দীপিত করতে, তাই তাদের সঠিক জ্ঞান ও সঠিক শিক্ষণই শিক্ষার্থীদের আদর্শ ব্যক্তিতে পরিণত করতে পারবে।

6) অপচয় ও অনুন্নয়ন রােধ : প্রাথমিক শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হলে এরূপ সমস্যাকে সর্বপ্রথম দূর করতে হবে এবং এর জন্য প্রয়ােজনীয় সরকারি ব্যবস্থা নিতে হবে।

7) পরিকাঠামােগতসংস্কার : শুধু বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠানইনয়, তারসঙ্গে পরিকাঠামােগত প্রয়ােজনীয়তাগুলাের দিকেও নজর দিতে হবে। যেমন—আলাে, বাতাসযুক্ত শ্রেণিকক্ষ, আসবাবপত্র ও অন্যান্য প্রয়ােজনীয় জিনিসপত্র।

8)  মিড-ডে মিলের ব্যবস্থা করা : আমাদের মতাে দরিদ্র দেশে বেশিরভাগ শিশু দু’বেলা খেতে পারে না। তাই তারা খাবার সংস্থানের চিন্তায় পড়াশােনাকে মূল্যহীন মনে করে বিদ্যালয়মুখী হয় না। এই অসুবিধা দূর করার জন্য বিদ্যালয়ে মিড-ডে মিল-এর ব্যবস্থা রাখতে হবে।

9) শিশুশ্রম আইন প্রয়ােগ করা : সরকার শিশুশ্রম রােধ করার জন্য যে আইন তৈরি। করেছিল তা যাতে বাস্তবে প্রয়ােগ করা হয় তা দেখা। তবেই অভিভাবকরা সচেতন হবে। এবং প্রাথমিক শিক্ষার প্রসার ঘটবে।।

সুতরাং সবশেষে বলা যায়, উপরিউক্ত ব্যবস্থাগুলি যদি সরকারিভাবে নেওয়া যায়, তাহলে এই সমস্যাগুলির যথাযথ সমাধান করা যাবে

Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।

Leave a Comment

error: Content is protected !!