ভারতে ধর্মনিরপেক্ষতার পথে প্রতিবন্ধকতাসমূহ আলােচনা কর

ভারতে ধর্মনিরপেক্ষতার পথে প্রতিবন্ধকতাসমূহ আলােচনা কর। Class 12 | Sociology (সাম্প্রতিক কালের সামাজিক বিচার্য বিষয়) | 8 Marks

উত্তর:

পবিত্র ভারতভূমিতে বহু ভাষা ভাষী ও ধর্মাবলম্বী মানুষের বাস সত্ত্বেও ভারত ধর্মনিরপেক্ষ দেশ। কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতা সম্পর্কে এখনাে ধারনা স্পষ্ট নয়। ভারতের মতাে ধর্ম-নিরপেক্ষ রাষ্ট্রকে বহু ও বিবিধ । সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। এর কারণগুলি নিম্নরূপ :

1. ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণা ও তার প্রয়ােগ প্রসঙ্গে সমস্যা : ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রব্যবস্থার সামনে বহু ও বিভিন্ন বাধা-বিপত্তি বর্তমান। এই সমস্ত বাধা-বিপত্তির মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণা সম্পর্কিত। বিভ্রান্তি উল্লেখযােগ্য। ধর্মের সঙ্গে সম্পর্কহীনতা, নাকি সকল ধর্মের প্রতি সমভাব বা সকল ধর্মের প্রতি সমর্থন রাষ্ট্রের দিক থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা হিসাবে বিবেচিত হবে — এ বিষয়ে মতানৈক্য বর্তমান। এ বিষয়ে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র মধ্যপন্থা অবলম্বন করেছে। ভারত-রাষ্ট্র কোনাে ধর্মের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করে

কিন্তু সকল ধর্মের সঙ্গে একধরনের সম্পর্ক বজায় রেখে চলে। ধর্মনিরপেক্ষতার অন্যতম ব্যাখ্যা হিসাবে। ‘সর্ব ধর্ম সমভাব’—এই ধারণার কথা বলা হয়। কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতার এই ব্যাখ্যা হল সরকারের আধিকারিকদের ধর্মনিরপেক্ষতার বিরােধী কাজকর্মকে যুক্তিসঙ্গত প্রতিপন্ন করা। সর্ব ধর্ম সমভাব’ বা সকল ধর্মের প্রতি সমশ্রদ্ধা এবং ধর্মনিরপেক্ষতা বা ধর্মীয় বিষয়াদিতে রাষ্ট্রের নিরপেক্ষ অবস্থান সমার্থক নয়। ধর্মনিরপেক্ষতার এই ব্যাখ্যায় সাম্প্রদায়িকতার অবসান বা ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয় রাজনীতির উপর জোর। দেওয়া হয় নি, বরং সাম্প্রদায়িকতাকে জনকল্যাণের ধারণার আবরণে আচ্ছাদিত করা হয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষতার এই ব্যাখ্যায় বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের অস্তিত্বকে স্বীকার করে নিয়ে বিদ্যমান ধর্মীয় সম্প্রদায়সমূহের মধ্যে মানিয়ে চলার কথা বলা হয়। ধর্মনিরপেক্ষতার এই ধারণায় ধর্মনিরপেক্ষতার কতকগুলি মৌলিক বিষয়কে উপেক্ষা করা হয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষতার এই মূল বিষয়গুলি হল ও ধর্মীয় মতান্ধতা ও কুসংস্কার থেকে রাষ্ট্রকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র করা; আধ্যাত্মিকতার প্রভাব-প্রতিক্রিয়া থেকে সমাজজীবনকে স্বতন্ত্র করা।

সকল ধর্মের প্রতি সমভাব ধর্মনিরপেক্ষতার বিপজ্জনক ধারণা : সকল ধর্মের প্রতি সমপৃষ্ঠপােষকতা বা কৃষ্টিগত কল্যাণসাধন ধর্মনিরপেক্ষতা বলে বিবেচিত হতে পারে না। কারণ কোনাে রাষ্ট্রই দেশের সকল ধর্মীয় সম্প্রদায়কে সমভাবে সন্তুষ্ট করতে পারে না। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র পবিত্রতা অ-পবিত্রতার ধারণা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হবে। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের কার্যকলাপ ধর্মনিরপেক্ষ এলাকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে; আধ্যাত্মিকতার এলাকায় কোনােভাবে প্রবেশ করবে না। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিরা ধর্মীয় পীঠস্থানের পূজা-অর্চনার উদ্যোগ-আয়ােজন থেকে নিজেদের মুক্ত রাখবেন। এ ধরনের রাষ্ট্র কোনাে ধর্মীয় সম্প্রদায় বা পীঠস্থানের প্রতি আর্থিক বা অন্যবিধ আনুকূল্য প্রদর্শন করবে না। 

2. জাতিসত্তার স্বাতন্ত্র্যজনিত অতিসচেতনতা : ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শের বাস্তবায়নের জন্য দেশবাসীর মধ্যে একটি যৌগিক জীবনধারা গড়ে তােলা দরকার এবং আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে সংহতিসাধনের ব্যাপারে সদর্থক উদ্যোগ-আয়ােজন আবশ্যক। দেশের বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে মাত্রাতিরিক্ত আত্মসচেতনতা এবং স্বতন্ত্র ধর্মীয় অভিব্যক্তি ধর্মনিরপেক্ষতার পথে প্রতিবন্ধক হিসাবে প্রতিপন্ন হয়।

3. ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ-ভিত্তিক আন্দোলনের অভাব : ভারতীয়দের মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শে আস্থাশীল মানুষের অভাব নেই। কিন্তু ভারতের এই ধর্মনিরপেক্ষ মানুষগুলিকে সংগঠিত করার কোনাে সদর্থক উদ্যোগ-আয়ােজন পরিলক্ষিত হয় না।

4. মুসলমানদের জন্য পৃথক ব্যক্তিগত আইন : বিবাহ, উত্তরাধিকার, নারীজাতির অধিকার। প্রভৃতি পারিবারিক জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বিভিন্ন বিধি-ব্যবস্থা বর্তমান। সমাজজীবনের এই সমস্ত ক্ষেত্রে বিভিন্ন জনসম্প্রদায়ের স্বতন্ত্র ধর্মীয় বিধি-বিধান ধর্মনিরপেক্ষতার পথে প্রতিবন্ধক হিসাবে প্রতিপন্ন হয়। ভারত সরকার শিখসমেত সকল হিন্দুদের জন্য একই দেওয়ানি বিধি। প্রণয়ন ও প্রবর্তন করছে। কিন্তু মুসলমানদের এই দেওয়ানি বিধির আওতায় আনা হয় নি।।

5. পাকিস্তানের সঙ্গে উত্তেজনাপূর্ণ সম্পর্ক : পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের নিরবচ্ছিন্ন উত্তেজনাপূর্ণ। সম্পর্কও এ দেশে ধর্মনিরপেক্ষতার পথে অন্যতম প্রতিবন্ধক হিসাবে প্রতিপন্ন হয়।

6. শরিয়তের বিধি-ব্যবস্থাকে ধর্মনিরপেক্ষ দেওয়ানী বিধির অন্তর্ভুক্ত করা : শাহবান মামা সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্তকে অতিক্রম করার জন্য সমকালীন ভারত সরকারের উদ্যোগও ভারতের ধর্মনির শক্তিকে আঘাত করেছে।

7. রাজনীতিক দল ও নেতাদের ভূমিকা : দেশের রাজনীতিক প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন রাজনীতিক দল ও রাজনীতিক নেতাদের ভূমিকা ভারতকে যথার্থ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে তােলার পথে একটি প্রবল প্রতিবন্ধক হিসাবে প্রতিপন্ন হয়। শুধুমাত্র মৌলবাদীরা বা সাম্প্রদায়িক রাজনীতিবিদরাই নয়, দেশে রাজনীতিক দলগুলি এবং রাজনীতিকরাও বিদ্যমান রাজনীতিক প্রক্রিয়াকে কলুষিত করে। ব্যবহারিক রাজনীতিতে তারা ধর্মকে ব্যবহার করতে দ্বিধাবােধ করেন না।

8. সংরক্ষণের সরকারি নীতি : ভারতে কেন্দ্রীয় সরকার ও বিভিন্ন রাজ্য সরকারের সংরক্ষণ নীতিও ধর্মনিরপেক্ষতার পথে একটি বড় বাধা হিসাবে বিবেচিত হয়।

9. মানবিক মূল্যবােধ ও সভ্য জীবনযাত্রা পদদলিত : আর্থনীতিক বৈষম্য, নিদারুণ দারিদা ও বঞনা ভারতে ধর্মনিরপেক্ষতার বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আর একটি বড় বাধা। ভারতে ন্যায়সঙ্গত আর্থনীতিক ব্যবস্থা বিকশিত হয় নি।

10. ভারতে ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তি দুর্বল : ভারতের অধিকাংশ অধিবাসী ঐতিহ্যবাদী, ধর্মভীরু এবং রক্ষণশীল। নতুন আদর্শ ও ধ্যান-ধারণাকে গ্রহণ করতে এরা অপারগ। সনাতন জীবনধারার লােকাচারলােকনীতি ও প্রথা-প্রকরণের প্রভাব-প্রতিক্রিয়া থেকে এরা মুক্ত নয়। সনাতন জীবনধারার এই প্রভাব কাটিয়ে উঠতে না পারলে ধর্মনিরপেক্ষতার পথ প্রশস্ত হতে পারে না।

11. মৌলবাদী মুসলমানদের অনমনীয় মনােভাব : ভারতে ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি ও আদর্শের সীমাবদ্ধতার জন্য মৌলবাদী মুসলমানদের দায়িত্বকেও অস্বীকার করা যায় না। ভারতে বসবাসকারী মুসলমানদের একটি অংশ হিন্দুদের পাশাপাশি সম্ভাব-সম্প্রীতির সঙ্গে বসবাস করতে অপারগ বা অক্ষম।

12. সাম্প্রদায়িকতার সমস্যা : সাম্প্রদায়িকতার অভিশাপ ধর্মনিরপেক্ষতার পথে একটি অন্তরায়। ভারতকে একটি যথার্থ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে তােলার জন্য সাম্প্রদায়িকতার অবসান অপরিহার্য। এবং এ ক্ষেত্রে ভারতের সকল অধিবাসীর সদর্থক উদ্যোগ-আয়ােজন আবশ্যক।

13. শিক্ষাব্যবস্থার ব্যর্থতা: ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণার বিকাশ ও বিস্তারের ক্ষেত্রে সহায়ক শিক্ষাব্যবস্থার সদর্থক ভূমিকার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। ভারতের শিক্ষাব্যবস্থার ভূমিকা এ ক্ষেত্রে হতাশজনক।

14. বড়মাপের জাতীয়তাবাদী নেতাদের অকালমৃত্যু : ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শের আশানুরূপ বিকাশের ক্ষেত্রে জাতীয়তাবাদী ধ্যান-ধারণা ও জাতীয়তাবাদী নেতাদের অনুকূল ভূমিকা অনস্বীকার্য। ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন তথা স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রাক্কালে দেশের সমকালীন জননেতারা ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শকে তুলে ধরেছিলেন। মহাত্মা গান্ধী, রফি আহমেদ, মৌলানা আবুল কালাম আজাদ, জাকির হােসেন, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বােস, পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু, গােবিন্দবল্লভ পন্থ, লালবাহাদুর শাস্ত্রী প্রমুখ সর্বজনশ্রদ্ধেয় অবিসংবাদিত জাতীয় নেতা ছিলেন ধর্মনিরপেক্ষ ভারত-রাষ্ট্রের জন্য নিবেদিতপ্রাণ। কিন্তু ভারত ও ভারতীয়দের দুর্ভাগ্য যে এই সমস্ত জাতীয় নেতারা দীর্ঘজীবী হন নি। তার ফলে ধর্মনিরপেক্ষতার বিকাশ ও বিস্তারের জন্য সদর্থক সংগ্রাম দীর্ঘস্থায়ী হয় নি। ভারতবাসী এ রকম বড় মাপের জাতীয়তাবাদী নেতা পরে আর পায় নি। 

15. বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকার সীমাবদ্ধতা : স্বাধীন ভারতকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে তােলার ক্ষেত্রে দেশের বুদ্ধিজীবীদের দায়িত্বও কম ছিল না। কিন্তু বুদ্ধিজীবীরা সে ভূমিকা পালন করেন নি।

16. সুবিধাবাদী রাজনীতিকদের ভূমিকা : পণ্ডিত নেহরু এবং লালবাহাদুর শাস্ত্রীর পরবর্তীকালের রাষ্ট্রকর্ণধাররা ধর্মনিরপেক্ষতার বিকাশ ও বিস্তারের ক্ষেত্রে এবং সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সংগ্রামের ক্ষেত্রে নৈতিক দৃঢ়তা এবং উদ্যোগের আন্তরিকতার পরিচয় প্রদান করতে পারেন নি।

উপসংহার : ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রব্যবস্থা নতুন মাত্রাযুক্ত হওয়া দরকার। সংবিধানে ঘােষিত উদ্দেশ্য অনুযায়ী ভারত হল একটি উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। এই সাধু ঘােষণাকে বাস্তবায়িত করার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সকলের সাধ্যমত সক্রিয় হওয়া দরকার। ভারতের মত উন্নয়নশীল দেশের পক্ষে ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ অনুসরণ করা একান্তভাবে অপরিহার্য। এই কারণে ধর্মনিরপেক্ষতার পথের প্রতিবন্ধকসমূহকে অতিক্রম করার জন্য প্রয়ােজনীয় উদ্যোগ-আয়ােজন গৃহীত হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সকলের। সদর্থক সহযােগিতা অভিপ্রেত।

Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।

Leave a Comment