ভারতে রেলপথ স্থাপনের উদ্দেশ্য কি ছিল | ভারতীয় অর্থনীতিতে রেলপথের প্রভাব আলোচনা করো

ভারতে রেলপথ স্থাপনের উদ্দেশ্য কি ছিল | ভারতীয় অর্থনীতিতে রেলপথের প্রভাব আলোচনা করো। Class 12 | History 8 Marks

উত্তর:

ভূমিকা : 19 শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে ভারতবাসীর অর্থনৈতিক জীবনে যেসব পরিবর্তন ঘটতে শুরু করেছিল তার মধ্যে রেলপথ ছিল অন্যতম নিয়ন্ত্রক। 1853 সালে লর্ড ডালহৌসির আমলে বোম্বাই থেকে থানেশ্বর পর্যন্ত রেল পথ তৈরি করেছিল। এই রেলপথ তৈরির দায়িত্ব পড়েছিল গ্রেট ইন্ডিয়ান পেনিনসুলার কোম্পানির হাতে। লর্ড ডালহৌসি রেলপথ স্থাপনের মাধ্যমে ভারতে অর্থনৈতিক,প্রশাসনিক সামরিক স্বার্থ চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে এ দেশে রেলপথ স্থাপনে উদ্যোগী হয়েছিল।

ভারতে রেলপথ স্থাপনের উদ্দেশ্য : রেলপথ স্থাপনের যে সমস্ত উদ্দেশ্যগুলি আছে সেগুলি হল যথা —

সরকারি উদ্দেশ্য : ভারতবর্ষের অর্থনৈতিক উন্নতিকে জলাঞ্জলি দিয়ে ইংরেজরা সম্পূর্ণভাবে নিজস্বার্থ চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে ভারতে রেলপথ স্থাপনের উদ্যোগী হয়েছিল। লর্ড ডালহৌসির উদ্দেশ্যে ভারতের প্রত্যন্ত ইংরেজ সেনাবাহিনী দ্রুত পৌঁছে দেওয়া,শিল্প বৃদ্ধি করা,দূরবর্তী অঞ্চল থেকে মালপত্র আমদানি করার জন্য রেলপথ স্থাপন করেন।

অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য : অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল ভারতের রেলপথ নির্মাণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য। ভারত থেকে কাঁচামাল সংগ্রহের জন্য রেল ব্যবস্থা অতি প্রয়োজনীয় ছিল। এছাড়াও ইংরেজরা মনে করেন যে রেলপথের বিস্তার হলে সেখানে বহু ইংরেজদের কর্মসংস্থানের সুযোগ মিলবে।

রাজনৈতিক ও সামরিক উদ্দেশ্য : রাজনৈতিক প্রয়োজনে রেলপথ প্রবর্তনের প্রয়োজনীয়তা দেখা যায়। বিশাল ভারতবর্ষে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কাজে দ্রুত যোগাযোগের জন্য ইংরেজরা রেল ব্যবস্থা চালু করেছিল। এছাড়াও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের ব্রিটিশ বিরোধী আইন দমন করতে,বহিঃশক্তির আক্রমণ,দুর্ভিক্ষের সময় সেনাবাহিনীর ত্রাণ,খাদ্য ও রসদ দেবার জন্য ব্রিটিশ সরকার রেলপথ স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করেছেন।

ভারতীয় অর্থনীতিতে রেলপথের প্রভাব : ভারতীয় অর্থনীতিতে রেলপথের প্রভাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে রেলপথের প্রচলন ঘটে ছিল যা ভারতীয় অর্থনীতিতে এক নতুন মাত্রা যোগ করে। এই সময় থেকে ভারতের যে স্থানে ব্রিটিশ মূলধন বিনিয়োগ হতে শুরু করে রেলপথ হল তাদের মধ্যে অন্যতম পাথেয়।

সুফল : ভারতীয় অর্থনীতিতে রেলপথের যে সমস্ত সুফল দিক গুলি আছে সেগুলি হল যথা —

পরিবহন ব্যবস্থার পরিবর্তন : রেলপথ প্রবর্তনের ফলে ভারতে চিরাচরিতভাবে পরিবহন ব্যবস্থার এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে। এরপূর্বে পরিচালিত সড়ক ও নৌকা ছিল ব্যয়বহুল, সময়সাপেক্ষ ও বিপদজনক। তাই রেল ব্যবস্থার ফলে যোগাযোগব্যবস্থা দ্রুত,নিরাপদ ও সহজ হয়।

বাণিজ্যের প্রসার : রেলপথ ভারতীয় অর্থনীতিতে পণ্য আনা-নেওয়ার ক্ষেত্রে পরিবর্তনের সূচনা ঘটায়। যার ফলে রেলপথ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। এছাড়াও রেলপথ ধরে গ্রামগঞ্জে বিপন্ন বিলাতি পণ্য ঢুকে যায়।

আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে যোগাযোগ : পূর্বে কৃষি ছিল আঞ্চলিক ও প্রয়োজনভিত্তিক। কিন্তু রেলপথ স্থাপনের ফলে ভারতীয় কৃষি পণ্যকে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সংযুক্ত করে কৃষিকে বেশি মাত্রায় বাণিজ্য পণ্য ও অর্থ ব্যয় পণ্য উৎপাদনের আগ্রহী করে তোলে।

রপ্তানি আমদানি বৃদ্ধি : পূর্বে কৃষিপণ্য খুব সামান্যই বাইরে রপ্তানি করা হতো। কিন্তু রেলপথের মাধ্যমে যোগাযোগের ফলে বিদেশে ভারতীয় পণ্যের রপ্তানি বৃদ্ধি পায়। গম,চাল, চামড়া,তেল,বীজ প্রভৃতি বিদেশে পাঠিয়ে এবং শিল্পজাত বস্তু দেশে এনে অর্থনৈতিক বাজার চাঙ্গা করে তোলে।

কর্মসংস্থান : রেলপথ নির্মাণের ফলে ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভূমিহীন কৃষক অদক্ষ শ্রমিক হিসেবে রেলে নিযুক্ত হয়ে তাদের রুটি-রোজগারের ঠিকানা খুঁজে পায়। এছাড়াও রেলপথের মাধ্যমে বৈদেশিক বাণিজ্য বৃদ্ধি পাওয়ার জন্য বন্দর এলাকায় কর্মসংস্থান ও জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায়।

কুফল : বেশকিছু উপকারিতা থাকা সত্ত্বেও এ দেশে রেলপথ প্রবর্তন এর কিছু অকল্যাণকর দীর্ঘ ছিল, সেগুলি হল —

১) ভারতীয় সম্পদের বহির্গমন ও নিষ্কাশন এর জন্য রেলপথ বহুলাংশে দায়ী ছিল। তাই রেলে পুঁজি বিনিয়োগ করে ব্রিটিশ শিল্পপতিরা গ্যারান্টি প্রথার মাধ্যমে ভারতীয় অর্থকে শোষণ করে ব্রিটেনে নিয়ে যায় যার ফলে গ্রামীণ অর্থনীতি রক্তশূন্য হয়ে পড়ে।

২) রেল যোগাযোগের ফলে ইংল্যান্ড জাতীয় পণ্যাদির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় না পেরে ভারতীয় কুটির শিল্প ধ্বংস প্রাপ্ত হয়। রেলে অধিকাংশ শ্রমিকের কর্মসংস্থান হলেও অন্যান্য পরিবহন সংস্থার শ্রমিকদের কাজের সুযোগ কমে যায়।

৩) রেলপথের অন্যতম কুফল ছিল ভারত থেকে চাল গম সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য ইংল্যান্ডে রপ্তানি করা হয়। যার ফলে দেশীয় প্রয়োজনে খাদ্যশস্যের অভাব দেখা দেয়।

উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে সারা দেশজুড়ে রেলপথের মায়াজাল বৃস্তিত হওয়ায় দেশবাসীর শাসকের বজ্রাঘাত আরো সুদৃঢ় হয়। এমনকি কৃষিকেন্দ্রিক ও শিল্পভিত্তিক অর্থনীতি রূপান্তরিত হলে গ্রামীণ জীবন রক্তশূন্য হয়ে পড়ে।

Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।

Leave a Comment