ভারতে সামাজিক পরিবর্তনের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলি বা দিকগুলি উল্লেখ কর। ৮ Class 12 | Sociology (ভারতীয় সমাজ) 8 Marks
উত্তর:
কখনাে পরিকল্পিতভাবে আবার কখনাে অপরিকল্পিতভাবে সামাজিক পরিবর্তনের ধারা প্রবাহিত হয়। কখনাে পরিবর্তন ঘটে অত্যন্ত দ্রুতলয়ে এবং সকলের জ্ঞাতসারে। আবার কখনাে এবং কোথাও অত্যন্ত ধীরগতিতে ও জনসাধারণের অজ্ঞাতসারে পরিবর্তন ঘটে। মানুষের সমাজজীবনের কোন একটি ক্ষেত্রে বা বিষয়ে পরিবর্তন ঘটলে তার প্রতিক্রিয়া সমাজ জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রেও পরিলক্ষিত হয়।
ভারতে সামাজিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় : ভারতে সামাজিক পরিবর্তনের কতকগুলি গুরুত্বপূর্ণ কারণ উল্লেখ করা যায়। এই সমস্ত বিষয়ের মধ্যে সর্বাধিক উল্লেখযােগ্য হল ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট ভারতের স্বাধীনতা অর্জন। স্বাধীনতা অর্জনের পরবর্তী অধ্যায়ে এই দেশ ও দেশবাসীর জীবনে যুগান্তকারী পরিবর্তনের সূত্রপাত ঘটে। ভারত ও ভারতবাসীর জীবনধারায় বিভিন্ন বিষয়ে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূত্রপাত হয়েছে। এই সমস্ত বিষয়ের মধ্যে উল্লেখযােগ্য হল ও সার্বিক প্রাপ্তবয়স্কের ভােটাধিকারের ভিত্তিতে স্বাধীন ভারতে সংসদীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার প্রবর্তন; আর্থনীতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন সংস্কারমূলক আইনের প্রবর্তন, সমষ্টি উন্নয়ন পরিকল্পনা (Community Development Programme) গ্রহণ; আর্থনীতিক পরিকল্পনা গ্রহণ, সমাজতান্ত্রিক আদর্শ অনুসরণ; যােগাযােগ ব্যবস্থা ও গণসংযােগের মাধ্যমগুলির উল্লেখযােগ্য উন্নতি ও বিস্তার; আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার ব্যাপক প্রয়ােগ, ইংরেজি শিক্ষার বিস্তার; সর্বজনশ্রদ্ধেয় জননায়কদের ব্যক্তিগত, বলিষ্ঠ ও সক্রিয় নেতৃত্ব; নগরায়ণ, শিল্পায়ন পাশ্চাত্যীকরণ, আধুনিকীকরণ, সংস্কৃতায়ন প্রভৃতি। উপরিউক্ত বিষয়াদির পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের সমাজজীবনের নানা ক্ষেত্রে বিগত কয়েকটি দশক জুড়ে বিভিন্ন ধরনের পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। এতদসত্ত্বেও ভারতে সামাজিক পরিবর্তনের কতকগুলি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র উল্লেখ করা আবশ্যক।
প্রথমত, সামাজিক সচলতা বৃদ্ধি : বির্তমানে ভারতের অধিবাসীদের মধ্যে সামাজিক স্তরবিন্যাসের ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। বর্তমান সমাজব্যবস্থায় সামাজিক স্তরবিন্যাস নির্দিষ্ট হয় অর্জিত সামাজিক পরিচিতির পরিপ্রেক্ষিতে। বর্তমানে মানুষ জন্ম বা বর্ণানুসারী বৃত্তির বন্ধনে বাঁধা থাকে না।ব্যক্তি এখন তার যােগ্যতা অনুযায়ী একটি বৃত্তি ছেড়ে অপর বৃত্তি সচ্ছন্দে গ্রহণ করতে পারে। মানুষ মাত্রেই বর্তমানে কর্মদক্ষতা ও যােগ্যতা অনুসারে বৃত্তি অবলম্বন করতে পারে। অর্থাৎ বৃত্তির ক্ষেত্রে বৈচিত্র্য ও বিশেষীকরণ ঘটেছে। এবং এই সবের স্বাভাবিক ফলশ্রুতি হিসাবে সামাজিক গতিশীলতা বিশেষভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। স্বাধীন ভারতে শিল্পবাণিজ্য ও কলকারখানার ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে। তার ফলে বহুবিধ কাজকর্ম ও নতুন নতুন বৃত্তির সৃষ্টি হয়েছে। মানুষের সামনে এখন রুজি-রােজগারের বিভিন্ন উৎস বর্তমান। বর্তমানে ভারতের মানুষ জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে এই সমস্ত কাজকর্ম নির্বিবাদে গ্রহণ করতে পারে। এবং এই সুবাদে সকলেই আর্থিক সঙ্গতি বৃদ্ধির পথ সুগম করতে পারে। বর্তমানে সমাজব্যবস্থায় সামাজিক মর্যাদা বা স্তরবিন্যাস হয় বহুলাংশে সমাজব্যবস্থার আর্থিক অবস্থা বা প্রতিপত্তির পরিপ্রেক্ষিতে স্থিরীকৃত৷ এইভাবে সমাজে মর্যাদানুসারী শ্রেণির সৃষ্টি হয়। অর্থাৎ আধুনিক ভারতে সামগ্রিক বিচারে সামাজিক সচলতা (social mobility) বিশেষভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
দ্বিতীয়ত, জাতিভেদ প্রথার কঠোরতা হ্রাস : আর্থনীতিক ক্ষেত্রে উল্লেখযােগ্য পরিবর্তনসাধনের ব্যাপারে জমিদারী প্রথার উচ্ছেদসাধন, কৃষিক্ষেত্রে বর্গাদারদের স্বার্থ সংরক্ষণ, জমিজমার মালিকানার ঊধ্বসীমা নির্ধারণ প্রভৃতি বিষয়ক আইনের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে ভারতে জাতিগত বা বর্ণগত বৃত্তির বিন্যাস কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। জাতিভেদ প্রথার অর্থনীতিক ভিত্তি এখন হীনবল হয়ে পড়েছে। জাতিভেদ ব্যবস্থার কঠোরতা বর্তমানে বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছে। মানুষ বহু ক্ষেত্রে অবস্থার চাপে হােটেল-রেস্টুরেন্টে খায় বা খেতে বাধ্য হয়। নিষ্ঠাবান ব্রাত্মণ জুতাের ব্যবসা করছেন, এখন এমন নজিরেরও অভাব নেই। অসবর্ণ বিবাহের সংখ্যা বর্তমানে ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। মানুষ এখন অনেক ক্ষেত্রে জাতপাতের নিয়ম-নিষেধ লঙ্ঘন করতে বাধ্য হচ্ছে। অধিকাংশ মানুষই এখন জাতিভেদ প্রথার নিগড় ভেঙে ফেলার পক্ষপাতী।
তৃতীয়ত, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কল্যাণে মানসিকতার পরিবর্তন : ভারতে আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার ব্যাপক প্রসার ও প্রয়ােগ ঘটেছে। তার ফলে মানুষের মানসিক পরিমণ্ডলের পরিবর্তন ঘটেছে। সমাজস্থ ব্যক্তিবর্গের চিরাচরিত ধ্যান-ধারণা, বিশ্বাস, দৃষ্টিভঙ্গি, মনােভাব প্রভৃতি বদলে গেছে। সাবেকী মূল্যবােধ ও মনােভাবের আমূল পরিবর্তনের প্রবণতা অত্যন্ত স্পষ্ট। সামগ্রিক বিচারে ভারতীয়দের দৃষ্টিভঙ্গি ও জীবনদর্শনের ক্ষেত্রে মৌলিক পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। প্রকৃত প্রস্তাবে মানুষ বর্তমানে অনেক বেশি বাস্তববাদী হয়েছে। আগেকার দিনে অদৃষ্টবাদ, জন্মান্তরবাদ, কর্মবাদ প্রভৃতি ভারতীয়দের জীবনধারা আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। মানুষ এখন সেই প্রভাব বহুলাংশে কাটিয়ে উঠেছে। জনজীবনে জন্মনিয়ন্ত্রণ আজ আর পাপাচার হিসাবে নিন্দিত নয়। ভারতের সকল অধিবাসীই এখন ছােট সংসারের পক্ষপাতী। ভারতের কৃষিজীবীরাও বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার আধুনিক কলাকৌশলকে সাদরে গ্রহণ করেছে এবং ব্যাপকভাবে প্রয়ােগ করছে। চাষ-আবাদের ক্ষেত্রে এখন উন্নত রাসায়নিক সার, উচ্চফলনশীল বীজ, কীটনাশক ঔষধ অপরিহার্য বিবেচিত হয়।
চতুর্থত, পারিবারিক সংগঠনের পরিবর্তন : ভারতে বর্তমানে একক পরিবারের জনপ্রিয়তা বিশেষভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। সনাতন ভারতবর্ষের সাবেকী একান্নবর্তী পরিবারব্যবস্থা ক্রমশ ভেঙ্গে পড়েছে। বর্তমানে দম্পতি-কেন্দ্রিক একক পরিবারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার প্রবল প্রবণতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। এবং এই প্রবণতা প্রধানত শহরাঞ্চলেই প্রকট হয়ে পড়েছে। এই প্রবণতার পিছনে বহুবিধ কারণ বর্তমান। এই সমস্ত কারণের মধ্যে উল্লেখযােগ্য হল সমাজস্থ ব্যক্তিবর্গের মধ্যে স্বাতন্ত্র্যবােধের আধিক্য, বিচ্ছিন্নতার মনােভাব, আত্মকেন্দ্রিকতা প্রভৃতি।
পঞ্চমত, মহিলাদের সামাজিক মর্যাদা ও ভূমিকার পরিবর্তন : স্বাধীনতাপ্রাপ্তির পরবর্তী পর্যায়ে ভারতে মহিলাদের মর্যাদা ও সামাজিক ভূমিকা বিশেষভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। স্বাধীন ভারতে মহিলাদের মর্যাদাবৃদ্ধি যেমন ঘটেছে, তেমনি স্বনির্ভর জীবনযাপনের পথ প্রশস্ত হয়েছে। এক্ষেত্রে আধুনিক সমাজব্যবস্থার কতকগুলি সহায়ক বিষয়ের কথা উল্লেখ করা দরকার। এই বিষয়গুলি হল জন্মনিয়ন্ত্রণ ও সন্তান প্রতিপালনের সহজলভ্য সুযােগ-সুবিধা, বিবাহ-বিচ্ছেদের আইনগত স্বীকৃতি, মহিলাদের চাকরি-বাকরি ও অর্থোপার্জনের সুযােগ-সুবিধার সম্প্রসারণ প্রভৃতি। এক্ষেত্রে সহায়ক কতকগুলি আইনের কথা বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। এই আইনগুলি হল Special Marriage Act, 1954, Hindu Marriage Act, 1955, Hindu Succession Act, 1956, পণপ্রথা বিরােধী আইন, 1961 প্রভৃতি। আধুনিক ভারতে পুরুষের পাশাপাশি মহিলারাও জীবনযুদ্ধের সকল ক্ষেত্রেই সমানতালে পা ফেলে চলেছে। যেমন- ভারতের প্রাক্তন মহিলা প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, প্রাক্তন বিশ্ববন্দিত মহিলা রাজ্যপাল শ্ৰীমতী বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিত ও শ্রীমতী পদ্মজা নাইডু প্রভৃতি।
ষষ্ঠত, যােগাযােগ ব্যবস্থার উন্নতি : বর্তমানে রাস্তাঘাট, যানবাহন ও যােগাযােগ ব্যবস্থার অভাবনীয় উন্নতি ও বিস্তার ঘটেছে। আধুনিক ভারতের জনজীবনে বেতার, সংবাদপত্র প্রভৃতি গণমাধ্যমসমূহ বিশেষভাবে জনপ্রিয় ও সহজলভ্য হয়ে উঠেছে। সম্প্রতি কমপিউটার, ইলেকট্রো-দৃশ্যমাধ্যম, ইনটারনেট প্রভৃতির উন্নতি গােটা দুনিয়াকেই আমাদের সামনে উন্মুক্ত করেছে। পৃথিবী যেন একটি গ্রামে পরিণত হয়েছে। গ্রামাঞ্চলের জীবনধারার উপর শহরাঞ্চলের অধিবাসীদের আচার-বিচার, আদব-কায়দা, চলন-বলন প্রভৃতি প্রভাব-প্রতিক্রিয়ার ফলস্বরূপ গ্রামীণ লােকসমাজ ও মানুষজনের মূল্যবােধ ও দৃষ্টিভঙ্গির মৌলিক পরিবর্তন ঘটেছে। তবে এ ক্ষেত্রে শিল্পায়ন ও নগরায়ণের প্রভাব-প্রতিক্রিয়াকে অস্বীকার করা যায় না।
Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।