ভূমি সংস্কারের অর্থ কী? পশ্চিমবঙ্গের ভূমিসংস্কার সম্বন্ধে আলােচনা কর। এর ব্যর্থতার দিকগুলি আলােচনা কর। Class 12 | Sociology (ভারতে সমাজতত্ত্ব) 8 Marks
উত্তর:
সাবেকী ও স্বীকৃত অর্থে ভূমি সংস্কার হল চাষি ও ক্ষেতমজুরদের সুবিধার্থে ভূসম্পত্তির পুনর্বণ্টন এবং কৃষি উন্নয়নের পক্ষে যে সকল প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিবন্ধকতা আছে সেগুলি অপসারিত করা। আধুনিক অর্থে ভূমিসংস্কার হল প্রাতিষ্ঠানিক ও প্রযুক্তিগত বিশেষ কিছু পরিবর্তন।
ভূমি সংস্কার হল জমির মালিকানা স্বত্ব এবং জমির পরিচালন সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনসূচী বা অবস্থার পরিপেক্ষিতে সংশােধন ও সংযােজনের মাধ্যমে যুগসামঞ্জস্যরূপ ধারন।
ভূমিসংস্কার পশ্চিমবঙ্গের পরিপ্রেক্ষিত:
১৯৫৩ এবং ১৯৫৫ সালে যথাক্রমে জমিদারী অধিগ্রহণ আইন এবং পশ্চিমবঙ্গ ভূমি সংস্কার আইন পাশ হয়। জমিদারী অধিগ্রহণ আইনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ত্রুটি হল— জমির উর্ধ্বসীমা ২৫ একরে নির্ধারিত করা। এই উর্ধ্বসীমা ছিল ব্যক্তিভিত্তিক তা পরিবারভিত্তিক ছিল না। এর ফলে পরিবারের বিভিন্ন সদস্য আত্মীয় গােষ্ঠী এবং বিভিন্ন বেনামে জমিগুলিকে বণ্টন করে উর্ধ্বসীমা আইন থেকে জমিগুলিকে লুকিয়ে ফেলল। তাছাড়া অকৃষি জমি যেমন দেবােত্তর জমি, বাস্তুভিটা, বাগীচা, মেছাে ভেরী, প্রভৃতিকে এই আইনের বাইরে রাখা হল। এইভাবে এই আইনের আওতায় প্রচুর জমি বেনামে হস্তান্তরিত হতে লাগল। তাই উদ্বৃত্ত জমি আইনের চোখে আর বিশেষ কিছু রইল না। সেই মুষ্টিমেয় জোতদারের হাতেই জমিগুলি থেকে গেল।
১৯৭৮ সালে রাজনৈতিক পালা বদলের সাথে সাথে ভূমি সংস্কার সংক্রান্ত নীতিগুলির বাস্তবায়নের লক্ষ্যপথও পরিবর্তিত হতে থাকে। বামফ্রন্ট সরকারের নেতৃবর্গ ভূমি সংস্কারের মাধ্যমে ভূমি বণ্টন ভাগচাষীদের মধ্যে শষ্যের ভাগ এবং নথিভুক্ত আইন রূপায়নে সচেষ্ট হয়ে “অপারেশন বর্গা” প্রথা চালু করেন। এই প্রথার মাধ্যমে প্রশাসনকে বর্গাদারদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। পঞ্চায়েত ও কৃষক সংগঠনগুলির সাহায্যে বর্গা রেকর্ডের কর্মসূচী তরাতি করা হয়েছে। এই কর্মসূচীটি আমলাতান্ত্রিক পথ থেকে সরে ক্রমশঃ জনমুখী হয়ে উঠেছে। ভাগচাষীদের উৎসাহিত করতে সরকারী ভূমিদপ্তরের আধিকারিকগণ নানাবিধ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। তাছাড়া বর্গাদারদের তালিকা রচনা, জমির মালিক ও ভাগচাষীর মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় রাখা ইত্যাদি ক্ষেত্রেও বিশেষ নজর দেওয়া হয়েছে। ১৯৭৮-১৯৯৯ পর্যন্ত বর্গা রেকর্ডধারীর সংখ্যা ১৪.৯১ লক্ষ দাঁড়িয়েছে।
ভূমি সংস্কার আইনের ত্রুটি-বিচ্যুতি লাঘবের জন্য ১৯৮১ সালে দ্বিতীয় পশ্চিমবঙ্গ ভূমি সংস্কার আইন পাশ হয়। রাষ্ট্রপতি কিছু সংশােধনী প্রস্তাবসহ বিলটিতে সম্মতি প্রদান করেন ১৯৮৬ সালে। এই সংশােধনীতে অকৃষি জমিগুলিকে উর্ধ্বসীমা আইনের আওতায় আনা হয়। জমির বেনামী হস্তান্তর ও বেআইনি রূপান্তরের উপরও ‘আইন বলবৎ করা হয়। এর ফলে উদ্বৃত্ত জমির পরিমাণ বৃদ্ধি ও তার বিলি-বণ্টন বরাদ্দ হয়। স্বাধীনতার ৫০ বছরে মাত্র ৫২ লক্ষ একর জমি বণ্টিত হয়েছে। যার ২০ শতাংশই হয়েছে পশ্চিমবঙ্গে।
ভূমি সংস্কারের পাশাপাশি জলসেচের প্রসার, উচ্চ ফলনশীল বীজ ও সারের প্রয়ােগ, জেলাওয়ারী কৃষি গবেষণাগার স্থাপন প্রভৃতির প্রভাবে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির সম্ভাবনা আরও উজ্জ্বল হয়েছে। এরাজ্যে চাষযােগ্য জমির যতটা অনুপাতে চাষ হয় তা বেশ বেশী। এই অনুপাত বাড়ানাে সম্ভব নয়। এইদিক থেকে বিচার করলে “অপারেশন বর্গা” কর্মসূচী আর্থ-সামাজিক দিক থেকে এক প্রয়ােজনীয় পদক্ষেপ বলা যায়। “সেন্টার ফর মনিটারিং ইণ্ডিয়ান ইকনমির” তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায় যে, ১৯৭০-৭১ থেকে ১৯৮১-৮২ এই সময়ের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ খাদ্য উৎপাদনে পিছিয়ে ছিল। কিন্তু ১৯৮১-৮২ থেকে ১৯৯১-৯২ এই সময়ের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ খাদ্য উৎপাদনে প্রভূত সাফল্য লাভ করে।
উপসংহার:
বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী ভূমি সংস্কারের কর্মসূচী বেশ খানিকটা সফলতার মুখ দেখেছে বলে দাবী করেন। আবার গরীব, নিরক্ষর চাষীদের অজ্ঞানতা, শ্রেণী স্বার্থ ও আইনী জটিলতার ফলে এই কর্মসূচী অনেকাংশেই ব্যাহত হচ্ছে একথাও ঠিক। বাস্তবিক অর্থে ভূমি সংস্কার গ্রামােন্নয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। ভূমি সংক্রান্ত প্রতিক্রিয়াশীল গােষ্ঠীগুলি আজও সমাজে লুকিয়ে আছে। সামান্যতম অবহেলার সুযােগে সেগুলি মাথাচাড়া দিতে পারে; সে বিষয়েও সরকার তথা কৃষক সংগঠন সকলকেই সজাগ থাকতে হবে। তবে এটুকু বলা যায় যে ইতিমধ্যেই পশ্চিবঙ্গের ভূমিসংস্কার আইনের বাস্তবায়ন এবং তার প্রভাব জাতীয় তথা আন্তর্জাতিক স্তরে দৃষ্টাকর্ষন করেছে।
Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।