ছন্দ বলতে কি বােঝ | ছন্দের স্বরূপ ও বৈশিষ্ট্য আলােচনা করাে

ছন্দ বলতে কি বােঝ ? ছন্দের স্বরূপ ও বৈশিষ্ট্য আলােচনা করাে ?
অথবা, ছন্দের সংজ্ঞা দাও। বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে ছন্দের প্রয়ােজনীয়তা কি?

উত্তর:

ছন্দ বাংলা কাব্যের ভাষাকে সচল করে, গতি দেয়, প্রানচঞ্চল করে তােলে। মানুষের মনের আবেগ ভাষা ও ছন্দের মধ্যে সঞ্চারিত হয়ে তাকে স্পন্দিত ও রসঘন করে তােলে। বিশেষ করে কবিতার ভাব ও গতি বােঝার জন্য ছন্দ জানা ও পড়া ভীষণ জরুরি। বাংলা গদ্য ও পদ্য পাঠকের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে উঠে ছন্দের কারণে। গদ্য-পদ্যের সৌন্দর্য-মাধুর্য সৃষ্টি করে ছন্দ। তাই ছন্দ পড়া ও জানা দুইই দরকার। যে কোন কবিতা পড়া ও বলার জন্য ছন্দের তাল ও লয়টি পাঠক কে জানতে হবে। ছন্দ কবিতার বাচ্যার্থের অতিরিক্ত ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করে কবিতাকে উৎকর্ষের চরম সীমায় পৌঁছে দেয়। ছন্দ তাই কবিতার ভূষণ, কবিতের সঙ্গে ছন্দের সম্পর্ক ঘনিস্ট। তাই যে বাক্যের শ্রুতিধ্বনির সঙ্গে অর্থ ধ্বনি সুসামঞ্জস্য হয় ,তার ছন্দ অত্যন্ত সরস ও সুন্দর হয়।

সাধারণ ভাবে ছন্দ বলতে আমরা বুঝি ‘কাব্যের রসঘন ও শ্রুতি মধুর বাক্যে সুশৃঙ্খল ধ্বনি বিন্যাসের ফলে যে সৌন্দর্য সৃষ্টি হয় তাকে ছন্দ বলে। ছন্দ সমস্ত কাব্য শিল্পের শ্রুতি গ্রাহ্য ধ্বনি সােন্দর্য।

ছন্দের উপকরণ:

(১) স্বরধ্বনি ও ব্যঞ্জনধ্বনি: যে ধ্বনি বাগযন্ত্র থেকে নিঃসরনের সময় বাধা পায় না, তাকে স্বরধ্বনি বলে। স্বরধ্বনি অন্য ধ্বনির সাহায্য ছাড়াই উচ্চারিত হয়। যেমন – অ,আ, ই,ঈ। স্বরধ্বনি দুই প্রকার। যথা (ক) মৌলিক স্বরধ্বনি – অ,আ,ই,ঈ,উ,ঊ। (খ) যৌগিক স্বরধ্বনি – ঐ, ঐ। মৌলিক স্বরধ্বনির সহযােগে বা মিলনে যে যুক্ত ধ্বনির সৃষ্টি হয়, তাকে যৌগিক স্বরধ্বনি বলে। ঐ (অ+ই ও+ই), ঔ (অ+উ ,ও +উ)।

(২) অক্ষর: বাগযন্ত্রের স্বল্পতম প্রয়াসে বা এক ঝোঁকে শব্দের যে হ্রস্বতম অংশ উচ্চারিত হয় ,তাকে অক্ষর বা দল বলে। একটি অক্ষরের মধ্যে একটি মৌলিক বা যৌগিক স্বরধ্বনি থাকে, তার বেশী স্বরধ্বনি থাকতে পারে না। আজ কোনাে কাজ নয় – এখানে ‘আজ’ (আজ) শব্দের একটি স্বরধ্বনি (‘আ’) সঙ্গে একটি ব্যঞ্জনধ্বনি (জ) আছে। তাই একটি অক্ষর দ্রষ্টব্য, স্বরধ্বনিটির পরে ব্যঞ্জনধ্বনিটির অবস্থান।

যে অক্ষরে শুধু স্বরধ্বনি থাকে বা যে অক্ষরের শেষে স্বরধ্বনি থাকে, তাকে স্বরান্ত অক্ষর বলে। উদাহরন এলাে – এ+(লে+ও)। এখানে প্রথম অক্ষরটি একটি স্বরধ্বনি নিয়ে গঠিত এবং দ্বিতীয় অক্ষরটিতেও একটি ব্যঞ্জনের শেষে একটি স্বরধ্বনি আছে। সুতরাং অক্ষর দুইটি স্বরান্ত।

যে অক্ষরের শেষে ব্যঞ্জনধ্বনি থাকে তাকে ব্যঞ্জনান্ত অক্ষর বলে। উদাহরন – গাছ (গ+আ+ছ) এই অক্ষরটির শেষে ‘ছ’ ব্যঞ্জনধ্বনি আছে। সুতরাং এটি একটি ব্যঞ্জনান্ত অক্ষর।

(৩) ছেদ ও যতি: কোন বাক্য পড়ার সময় তার সমগ্র বা আংশিক অর্থ পরিস্ফুটনের জন্য ধ্বনি-প্রবাহে যে উচ্চারন-বিরতি আবশ্যক হয়, তাই ছেদ বা অর্থ-যতি। উদাহরন – “আমরা আরম্ভ করি, শেষ করি না; আড়ম্বর করি, কাজ করি না।” কোন বাক্য পড়ার সময় শ্বাস গ্রহণের জন্য সুপরিকল্পিত কালান্তরে যে উচ্চারণবিরতি আবশ্যক হয়, তাকে যতি বা ছন্দ-যতি বলে। শ্বাসগ্রহণের জন্য যে বিরতির প্রয়ােজন হয় তা সুপরিকল্পিত কালান্তরে বিন্যস্ত হলে তাকে শ্বাস-যতি না বলে ছন্দ-যতি বলাই সঙ্গত; কারণ ছন্দের খাতিরেই শ্বাস-যতি বাক্যের মধ্যে নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে।

অতএব ইহা স্পষ্ট যে, অর্থ-যতি বা ছেদ বাক্যকে অর্থ অনুযায়ী এবং ছন্দ-যতি বাক্যকে সুপরিকল্পিত ছক অনুযায়ী বিভক্ত করে। মনে রাখতে হবে,ছন্দঃশাস্ত্রের আলােচনায় ছন্দ-যতিই অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। যেমন-

সাতকোটি সন্তানেরে, / হে মুগ্ধ জননী।।
রেখেছ বাঙালী করে, / মানুষ করনি।। —— রবীন্দ্রনাথ।

বাক্যের উচ্চারন কালে শ্বাস গ্রহণের জন্য যে অল্পক্ষণবিরতির প্রয়ােজন হয় তাকে হ্রস্ব-যতি বলে এবং যে বেশীক্ষণ বিরতির প্রয়ােজন হয় তাকে পূর্ণ-যতি বলে। এই দুইয়ের মাঝামাঝি আর একটি যতি আছে তাকে মধ্য-যতি বলে।

(৪) পর্ব ও পৰ্বাঙ্গঃহ্রস্ব: যতির দ্বারা নির্দিষ্ট খণ্ডিত ধ্বনিপ্রবাহকে পর্ব বলে। যেমন- রাত পােহাল। ফর্সা হল। ফুটল কত ফুল। ‘রাত পােহাল’, ‘ফর্সা হল’, ‘ফুটল কত’, ‘ফুল’,— এই গুলি এক একটি পর্ব। কবিতা পাঠের সময় তার প্রতিটি পর্বে কণ্ঠস্বরের যে হ্রাসবৃদ্ধি ঘটে, যাতে পর্বে যে দুটি বা তিনটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিভাগ অস্পষ্ট অনুভূত হয়, তাদের এক একটি পৰ্বাঙ্গ বলে। যেমন — রাতপাে । হাল । ফুটল । কত । ফুল। এখানে ১ম পর্ব – ‘রাত পােহাল’ পড়ছি ‘রাতপাে’, ‘হাল’। ‘রাতপাে’ বলেই কণ্ঠস্বর হ্রাস পাচ্ছে। তাই রাতপাে পর্বের একটি অঙ্গ।

পর্ব তিন প্রকার —( ১) পূর্ণ পর্ব (২) প্রান্তিক পর্ব (৩) অতি পর্ব।

(৫) মাত্রা: একটি অক্ষর বা দল উচ্চারণে যে সময়ের প্রয়ােজন হয়, তাকে মাত্রা বা কলা বলে।

(৬) শ্বাসাঘাত: কোন কোন চরণের এক একটি পর্বে আদি অক্ষরের উপর যে সুস্পষ্ট জোর বা বল দেওয়া হয়, তাকে শ্বাসাঘাত বলে।

(৭) লয়: কবিতা পাঠের সময় পঠনের গতিভঙ্গি থেকে যে সুরের সৃষ্টি হয়, তাকে লয় বলে। 

(৮) পদ ও চরণ: মধ্য যতির দ্বারা বিছিন্ন ও পর্ব থেকে বৃহত্তর বাক্যাংশকে পদ বলে। পূর্ণ যতির দ্বারা নির্দিষ্ট ধ্বনিপ্রবাহকে চরণ বলে। চরণমাত্রই এক বা একাধিক পর্ব থাকে।

(৯) স্তবক: কবিতায় চরণগুচ্ছ লইয়া যে সুশৃঙ্খল ছন্দগ্রন্থি রচিত হয়, তাকে স্তবক বলে।

(১০) মিল: একাধিক পর্ব বা পদ বা চরণের অন্তিম ধ্বনিসাম্যকে মিল বলে।

Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।

Leave a Comment