ছুটি গল্পের নামকরণ কতখানি সার্থক তা আলোচনা করো

ছুটি গল্পের নামকরণ কতখানি সার্থক তা আলোচনা করো । MARK 5 | Class 11 Bengali | ছুটি

উত্তর :

সাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হল নামকরণ। কাহিনিপাঠের পূর্বেই কাহিনির অন্তর্নিহিত মর্মবস্তুটি পাঠকের মনে গভীরভাবে রেখাপাত করে নামকরণের মাধ্যমেই। নামকরণ চরিত্রপ্রধান, বিষয়কেন্দ্রিক, ব্যঞ্জনাধর্মী—নানা প্রকারের হতে পারে। এখন আমাদের আলোচনা করে দেখতে হবে ‘ছুটি’ গল্পের নামকরণটি কোন্ প্রকৃতির এবং কতখানি সার্থক হয়েছে।

সজীব গ্রাম্য প্রকৃতির কোলে একটু একটু করে বেড়ে উঠতে থাকা প্রাণবন্ত কিশোর ফটিকের অশ্রুমর্মর কাহিনি হল ‘ছুটি’ গল্পটি। নিত্যনতুন দুষ্ট বুদ্ধির উদ্ভাবনে ফটিক ছিল তার বাল্যবন্ধুদের মধ্যে সর্দার। পড়াশোনায় তার কোনো মনোযোগ ছিল না, এমনকি তার দুষ্টুমিতে তার মা-ও তার প্রতি যথেষ্ট বিরক্ত ছিলেন। উচ্ছৃঙ্খল অবাধ্য ছেলেকে নিয়ে মায়ের মনে সর্বদাই চিন্তা থাকত কোনোদিন হয়তো ফটিক তার ভাই মাখনের না-কোনো দুর্ঘটনা ঘটায়। * এমন সময় একদিন ফটিকের মামা বিশ্বম্ভরবাবু ভগিনীর বাড়িতে আসেন । ভগিনীর মুখে ফটিকের কথা শুনে তিনি ফটিকের পড়াশোনার দায়িত্ব নেন এবং তাকে কলকাতায় নিয়ে যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন। দাদার প্রস্তাবে ফটিকের মা শুধু নয়, ফটিকও আনন্দ পায়। ফটিক আনন্দ পায় এই ভেবে যে, মামার বাড়িতে গেলে মা ও ভাইয়ের লাঞ্ছনার হাত থেকে সে কিছুকালের জন্যও ছুটি পাবে।

বলা বাহুল্য, যে স্নেহ-ভালোবাসা ১৩-১৪ বছরের ফটিক খুঁজেছিল, ভেবেছিল মামার বাড়িতে হয়তো সেই স্নেহ-ভালোবাসার সন্ধান সে পাবে, কিন্তু এখানেও সে আশাহত হয়েছে। ফটিকের বালকোচিত সরল ব্যবহার, তার চলাফেরা, কথাবার্তা—সব কিছুই তার মামীর চোখে বিরক্তির কারণ হত। ফটিক মামীকে নানাভাবে খুশি করতে চাইলেও, ফটিকের কোনো কাজকেই মামী ভালোভাবে মেনে নিতে পারেনি। ক্রমে ফটিক অনুভব করে, সে মামীর সংসারে অনাহুত এবং বেমানান। কলকাতার স্কুলেও সে নির্বোধের মতো সঙ্গীহীন; এমনকি মামাতো ভাইরাও তার পরিচয় দিতে কুণ্ঠাবোধ করত, বিদ্রুপ করত তার নির্বুদ্ধিতা নিয়ে। ক্রমে ফটিক কলকাতার চার দেয়ালের মধ্যে হাঁপিয়ে ওঠে। গ্রামের মুক্ত পরিবেশের কথা, বন্ধুদের কথা, দিগন্তবিস্তৃত মাঠে ছুটোছুটির কথা, নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ার কথা, ঢাউস ঘুড়ি নিয়ে বোঁ বোঁ করে দৌড়ে বেড়ানো তার মনে পড়ে—বন্দি জীবন থেকে সে ছুটি পাবার অপেক্ষা করতে থাকে।

এরূপ অবস্থায় একদিন ফটিক তার স্কুলের বই হারিয়ে ফেলে। সে-কথা ফটিক তার মামীকে জানালে সেখানেও তার কপালে জোটে গঞ্জনা। সেই রাতেই ফটিক জ্বরে পড়ে। সে বুঝতে পারে মামী জ্বরের কথা জানতে পারলে তাকে আরও যন্ত্রণা পেতে হবে। যন্ত্রণা থেকে ছুটি পেতে ফটিক গভীর রাতে বেরিয়ে পড়ে তার গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে—তার মায়ের কাছে ফিরে যেতে। কিন্তু সে মায়ের কাছে যেতে পারেনি। পরের দিন সন্ধ্যায় প্রচণ্ড জ্বরে আক্রান্ত ফটিককে পুলিশ যখন তার মামার বাড়িতে পৌঁছে দেয় তখন তার সারা শরীর ভিজে, কর্দমাক্ত–থরথর করে কাঁপছে। জ্বর ক্রমে বাড়তে থাকে, জ্বরের ঘোরে সে বলে “মামা আমার ছুটি হয়েছে কি?” সে খালাসীদের মতো বলতে থাকে—“এক বাঁও মেলে না, দো বাঁও মেলে না।” ফটিকের জ্বরের কথা শুনে গ্রামের বাড়ি থেকে উদ্ভ্রান্তের মতো তার মা ছুটে আসে; তখন ফটিক তার শেষ কথাটি বলে—“মা এখন আমার ছুটি হয়েছে, মা এখন আমি বাড়ি যাচ্ছি।”

এখানেই ‘ছুটি’ শব্দটি গভীর ব্যঞ্জনাময় হয়ে উঠেছে। ইহলোকের সকল বন্ধন থকে ছুটি নিয়ে ফটিক চিরতরে চলে গেছে পরলোকে। এক গাছে পরবে যন্ত্রণাপূর্ণ স্নেহহীন বালকের জীবনে প্রকৃত মুক্তি এসেছে মৃত্যুর পথ ধরে। এই বিশ্বসংসারে কেউ ফটিককে বুঝতে চায়নি। প্রকৃতির একান্ত আপন তাই যেন শেষ মুহূর্তে প্রকৃতির কোলেই চির নিন্দ্রা নিয়েছে। গল্পের সমাপ্তিতে ফটিকের এই চিরবিদায় গল্পের নামকরণকে ব্যাঞ্জনাগর্ভ ও হৃদয়স্পর্শী করে তুলেছে। তাই ব্যাঞ্জনাধর্মী নামকরণ হিসেবে ‘ছুটি’ যথার্থ ও সার্থক হয়েছে।

Read Also

‘ উৎসাহে তাহার রাত্রে নিদ্রা হয় না ।—উদ্দিষ্টের উৎসাহের ‘পিছনে লেখক যে ট্র্যাজিক আভাস দিয়েছেন তা বর্ণনা করো ।

‘ তেরো-চৌদ্দ বৎসরের ছেলের মতো পৃথিবীতে এমন বালাই আর নাই ।—মন্তব্যটির তাৎপর্য বিশ্লেষণ করো।

‘ উৎসাহে তাহার রাত্রে নিদ্রা হয় না ।—উদ্দিষ্টের উৎসাহের ‘পিছনে লেখক যে ট্র্যাজিক আভাস দিয়েছেন তা বর্ণনা করো ।

Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।

Leave a Comment