তুলনামূলক শিক্ষার সংজ্ঞা দাও | তুলনামূলক শিক্ষার প্রকৃতি আলোচনা করো
উত্তর :
তুলনামূলক শিক্ষা একটি আলাদা বিষয়রূপে খুব অল্পদিনেই স্বীকৃতিলাভ করেছে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে মাইকেল স্যাডলার, নিকোলাস হ্যান্স, আই এল ক্যান্ডেল প্রমুখ শিক্ষাবিদের প্রচেষ্টা শিক্ষায় আলােচনার ক্ষেত্রে এক নতুন দিগন্তের উন্মােচন ঘটে। তুলনামূলক শিক্ষার ধারণাদান করা খুব সহজ ব্যাপার নয়। কারণ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন পদ্ধতি ও জায়গার গুরুত্ব অনুসারে তুলনামূলক শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে। ড. Halts-এর মতানুসারে, তুলনামূলক শিক্ষাপদ্ধতির পৃথক কোনাে শাখা নেই। অন্যান্য তুলনামূলক বিষয় আলােচনার পথ অনুসরণ করে এই শিক্ষা বিকাশলাভ করেছে। তুলনামূলক শিক্ষা বলতে নিজ দেশের শিক্ষার সঙ্গে অন্য কোনাে দেশের পরীক্ষা ব্যবস্থা, পাঠদান পদ্ধতি, পরিশাসন প্রভৃতির তুলনামূলক আলােচনাকেই বােঝায়। এই শিক্ষার দ্বারা বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করে সমস্ত দেশে শিক্ষার সাধারণ নীতি অনুসরণ করা হয়। Nicholas Hans-এর মতে, তুলনামূলক শিক্ষা একটি সামগ্রিক পরিবেশগত, রাজনৈতিক, আর্থ-সামাজিক শক্তি এবং ঐতিহাসিক উপাদান যা শিক্ষার গঠনমূলক দিককে সমস্ত দেশেই সাহায্য করে। Michkal Sadler-এর মতে, তুলনামূলক শিক্ষাকে বিদেশি শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে তুলনা করা হয়ে থাকে। আমরা আমাদের বিদ্যালয়ের চারপাশের পরিবেশকে যেমন ভুলতে পারি না এবং পড়াশােনার যে মূল্যবােধ তাও ভুলি না; সেইরূপ কোনাে বিদেশি শিক্ষাব্যবস্থার পদ্ধতি তুলনামূলকভাবে আমাদের শিক্ষার মানকে আরও বাড়িয়ে দেয় এবং আমরা নতুন কিছু ধারণালাভ করতে পারি। Krd-এর মতে, তুলনামূলক শিক্ষার উদ্দেশ্য হলাে আইন, তুলনা সাহিত্য কিংবা Anatomy। এই শিক্ষাব্যবস্থা বিভিন্ন দেশের শিক্ষার পার্থক্য আবিষ্কার করে শিক্ষার পদ্ধতিকে আরও গতিশীল করে তােলে। তিনি তাঁর বিখ্যাত পুস্তকে বলেছেন, তুলনামূলক শিক্ষা বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বিভিন্ন পদ্ধতি বিভাগ এবং প্রায়ােগিক ক্ষমতার অনুবন্ধন। এই শিক্ষার দ্বারা জাতীয় চেতনার বিকাশ হয়। তিনি সাংস্কৃতিক পদ্ধতির মূলভিত্তিকে তুলনামূলক শিক্ষায় তুলে ধরেছেন। যেকোনাে ঐতিহ্যগত পাঠের ক্ষেত্রে এই শিক্ষা অবশ্যম্ভাবী।
সুতরাং বিভিন্ন দেশে অবস্থিত শিক্ষাব্যবস্থা, শিক্ষানীতি ও তাদের শিক্ষাব্যবস্থার সাফল্যসূচক বৈশিষ্ট্যগুলিকে নিয়ে তুলনামূলক আলােচনা করাই হলাে তুলনামূলক শিক্ষার বিষয়। যেমন বিভিন্ন দেশের প্রাথমিক শিক্ষার প্রতি দৃষ্টিপাত করলে আমরা দেখতে পাই আমেরিকা, ইংল্যান্ড, রাশিয়া, জাপান এবং কিউবাতে শতকরা একশাে জন শিক্ষার্থী প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করছে। কিন্তু অপরদিকে ভারতবর্ষের চিত্রটি অন্য ধরনের। এখানে শতকরা 65 ভাগ শিক্ষার্থী প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করছে। অর্থাৎ অন্যান্য দেশের তুলনামূলক বিচারে আমরা ভারতবর্ষের স্থান জানতে পারি।
তুলনামূলক শিক্ষার প্রকৃতি :
বর্তমানে নানা দেশের শিক্ষাব্যবস্থার অন্তর্নিহিত পার্থক্যের কারণগুলি তুলনামূলক শিক্ষার আলােচনার মাধ্যমেই আবিষ্কার করা সম্ভব। কিন্তু নানা দেশের শিক্ষাধারার সাদৃশ্যমূলক আলােচনায় কেবল সংশ্লিষ্ট শিক্ষাব্যবস্থার নির্মাণরীতির দিকটিই প্রধান হয়ে ওঠে। জাতি ও রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য, রাজনৈতিক মতাদর্শ ও তত্ত্ব-সাংস্কৃতিক আদর্শ প্রভৃতি এই বিশ্লেষণে অগ্রাধিকার লাভ করে। এইভাবে নানা রাষ্ট্রের শিক্ষাব্যবস্থার ভিত্তি সম্পর্কে অবহিত হওয়া সম্ভব। এই তুলনামূলক বিশ্লেষণের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের শিক্ষাব্যবস্থার লক্ষণগুলির সাদৃশ্য এবং বৈসাদৃশ্য প্রতিভাত হয়। এই আলােচনার মাধ্যমে অভিন্ন সমস্যাগুলি সম্পর্কে নানা দেশ সচেতন হয়ে ওঠে এবং নানা দেশ নানা রাজনৈতিক, সামাজিক পরিস্থিতিতে কীভাবে এই সমস্যা সমাধান করছে তা উপলব্ধি করতে পারে।
কোনাে জাতি শিক্ষার মাধ্যমে নাগরিকের ব্যক্তিগত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য গঠনের প্রয়াস করে। এইভাবে জাতীয় রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও উদ্দেশ্য শিক্ষার মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়। দেশের রাজনৈতিক আদর্শ শিক্ষাব্যবস্থাকে প্রভাবিত করে। আবার শিক্ষাদর্শ রাজনৈতিক ধ্যানধারণা গড়ে তােলে। নাৎসি আদর্শের শিক্ষাব্যবস্থা জার্মান জাতির মনে যুদ্ধের উন্মাদনা জাগ্রত করেছিল। কমিউনিস্ট নিয়ন্ত্রিত রাশিয়ার মিত্র দেশগুলিতে সােভিয়েত সাম্যবাদী আদর্শ শিক্ষাক্ষেত্রেও প্রবল প্রভাব বিস্তার করেছে। দেশের শিক্ষাব্যবস্থার প্রকৃতি ও রূপ প্রণয়নে রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রভাব সুদূরপ্রসারী। শিক্ষাব্যবস্থার প্রকৃতি গঠনে রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রভাব অসামান্য।
অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে শিক্ষা ধীরে ধীরে জাতীয়তাবাদের সঙ্গে সঙ্গে একাত্ম হয়ে ওঠে এবং জাতি ও রাষ্ট্রের অন্তর্গত বিষয়ে পরিণত হয়। তাই শিক্ষায় জাতি ও জাতীয়তাবাদের প্রভাব মূল্যায়ন করার জন্য জাতি ও রাষ্ট্রব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য উপলব্ধি করা প্রয়ােজন। সামাজিক স্থায়িত্বের ভিত্তিতে শিক্ষার প্রগতি ও প্রসারের উপর অপরিসীম প্রাধান্য দেওয়া হয়। তাই পরিবর্তনশীল বিশ্বপরিস্থিতিতে শিক্ষার প্রসারের বিষয়টি দেশকে উদবিগ্ন করে তুলেছিল। ব্যক্তি ও সমাজের সম্পর্ক শিক্ষার নিয়ন্ত্রণ, মানােন্নয়ন, শিক্ষার বিষয় ও পদ্ধতি নির্ধারণ, শিক্ষার আর্থিক দায়িত্ব প্রভৃতি প্রশ্নের সমাধান রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থা তথা রাজনীতির উপর নির্ভরশীল।
Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।