বাংলা নাটকে দীনবন্ধু মিত্রের অবদান
উত্তর :
বাংলা নাটকে দীনবন্ধু মিত্রের অবদান
বাংলা নাটকের প্রথমযুগে যে দু’-একজন প্রতিভাবান নাট্যকারের আবির্ভাব ঘটেছিল তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন দীনবন্ধু মিত্র। মধুসূদন যেমন বাংলা পৌরানিক ও ঐতিহাসিক নাটকের সূত্রপাত করেছিলেন দীনবন্ধু মিত্র তেমনি বাস্তব জীবনচিত্র সম্বলিত সমসাময়িক সমাজ জীবনের উজ্জ্বল আলেখ্য রচনা করে খ্যাতিলাভ করেছিলেন। তার খ্যাতি মূলত ‘নীলদর্পন নাটকটির জন্য। এটি ছাড়াও তিনি আরও বেশ কয়েকটি নাটক ও প্রহসন রচনা করে বাংলা নাট্য সাহিত্যের ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন।
দীনবন্ধু মিত্র (১৮৩০- ১৮৭৩) নদীয়ার চৌবেরিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাল্যনাম ছিল গন্ধর্বনারায়ন মিত্র। কিন্তু বাল্যকালে তার সমবয়সীরা তাঁকে এইনামে খ্যাপাত বলে তার বাবা এই নাম পরিবর্তন করে রাখেন দীনবন্ধু। প্রথমে গ্রামে এবং পরবর্তীকালে কলকাতার বিভিন্নস্থানে পড়াশুনা করে দীনবন্ধু কর্মজীবনে ইংরেজ সরকারের অধীনে ভারতীয় ডাকবীভাগের উচ্চপদে চাকরি করেন। ব্যস্তকর্ম জীবন সামলানাের পাশাপাশি দীনবন্ধু চাকরি সূত্রে সমগ্র বাংলাদেশ ঘুরে ঘুরে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেন তাকে সম্বল করে সাহিত্যচর্চা শুরু করেন। এরফলে তিনি ‘নীলদর্পন সহ আরও বেশ কয়েকটি নাটক রচনা করে খ্যাতি লাভ করেন। | দীনবন্ধু প্রথম জীবনে ঈশ্বরগুপ্তের ‘সম্বাদ প্রভাকর পত্রিকার পৃষ্ঠায় কিছু কবিতা রচনা করলেও কবিতার ক্ষেত্রে সেভাবে সফল হননি। এসময় তিনি চাকরি সূত্রে বাংলার বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করতেন। তখন বাংলায় নীলচাষকে কেন্দ্র করেই ইংরেজ নীলকর সাহেবদের সাথে বাঙালী চাষীদের বিরােধ বেঁধেছিল। সেই বিরােধকে নিয়েই দীনবন্ধু তাঁর প্রথম নাটক ‘নীলদর্পণ” (১৮৬০) রচনা করেন। এরপর তিনি নবীন তপস্বিনী (১৮৬০), ‘লীলাবতী’ (১৮৬৭) এবং ‘কমলে কামিনী’ (১৮৭৩) নামক তিনটি কমেডিধর্মী নাটক রচনা করেন ও ‘বিয়ে পাগলা বুড়াে’ (১৮৬৬), সধবার একাদশী (১৮৬৬) এবং ‘জামাই বারিক (১৮৭২) নামক তিনটি প্রহসন রচনা করেন। তবে দীনবন্ধুর খ্যাতি মূলত তার ‘নীলদর্পণ’ নাটকটির জন্য।
আগেই বলেছি ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে নীলচাষকে কেন্দ্র করে ইংরেজ নীলকর সাহেবদের সাথে বাঙালী চাষীদের যে বিরােধ বেধেছিল তাকে মূলধন করেই দীনবন্ধু তার ‘নীলদর্পন নাটকটি রচনা করেন। এই নাটকটিতে দীনবন্ধুর বাস্তব অভিজ্ঞতা ও সহানুভুতির সার্থক প্রয়ােগ আছে। নাটকটির সাথে বাংলা
নাট্যসাহিত্য, নাট্যমঞ্চ, স্বাদেশিকতা, নীল আন্দোলন ও বাংলার সমাজের গভীর যােগ ছিল। নীলকরদের অত্যাচারে স্বরপুর গ্রামের বসু পরিবার ও ঘােষ পরিবার নামক দুটি পরিবার কিভাবে ধৃংস হয়ে গিয়েছিল তা-ই এই নাটকের মূল উপজীব্য। নীলকরেরা নীলচাষের নামে বাঙালীদের উপর কীরূপ অত্যাচার চালাতেন তার বাস্তব চিত্র এই নাটকে আছে। এই নাটকটি বাংলার সমাজ জীবনে এতটাই প্রভাব ফেলেছিল যে অনেকেই একে মার্কিন ঔপন্যাসিক স্টো রচিত ‘Uncle Toms Cabin’- গ্রন্থটির সাথে তুলনা করেন।
‘নীলদর্পন নাটকটি দীনবন্ধু স্বনামে প্রকাশ করতে পারেন নি। তিনি এটি ‘কেনাচিৎ পথিকেন’ ছদ্মনামে প্রকাশ করেন। এই নাটকটি প্রকাশিত হবার পরেই ‘The Indigo Planting Mirror’- নামে মধুসূদন ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। তবে এই অনুবাদটিতেও অনুবাদকের কোন নাম ছিলনা। যাইহােক এই নাটকটি তৎকালীন বাঙালী জনমানসে এতটাই প্রভাব ফেলেছিল যে নীলকরদের অত্যাচারে রাশ টানার জন্য ইংরেজ সরকার ভাবিত হন। নীলকরদের অত্যাচার সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়ার জন্য ইংরেজ সরকার Indigo Commission বসাতে বাধ্য হন।
বাংলা নাটকের প্রথমযুগের নাটক হওয়ায় দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’ নাটকটিতে অনেক শিল্পগত ত্রুটি ছিল। দীনবন্ধু ট্রাজেডি হিসাবে নাটকটি রচনার পরিকল্পনা করলেও এটি একটি সার্থক ট্রাজেডি হয়ে ওঠেনি। তবুও বাংলা নাট্য সাহিত্যের ইতিহাসে এই নাটকটি ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। এই নাটকটি তৎকালীন বিভিন্ন রঙ্গমঞ্চে বহুবার অভিনীত হয়েছে। ফলে নাটকটির এবং নাট্যকার দীনবন্ধুর জনপ্রিয়তাও অনেক বেশি ছড়িয়ে পড়েছে। | ‘নীলদর্পণ’ ছাড়াও দীনবন্ধু ‘নবীন তপস্বিনী’, ‘লীলাবতী’, ‘কমলে কামিনী’ নামক তিনটি কমেডিধর্মী নাটক রচনা করেন। এর মধ্যে ‘নবীন তপস্বিনী’ নাটকের জলধর চরিত্রটি শেক্সপীয়ারের ‘Merry Wives of Windsor’-এর ফলস্টাফের অনুকরণে অঙ্কিত। এই জলধর আপন ব্যক্তি বৈশিষ্ট্যে ও কৌতুকরসে দীনবন্ধুর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদ। দীনবন্ধু ‘লীলাবতী’ নাটকে সমকালীন নাগরিক জীবনের হাস্য পরিহাস ও নায়ক-নায়িকার মিলন সংক্রান্ত এক জটিল কাহিনির উপস্থাপন করেছেন। নায়ক ললিত এবং নায়িকা লীলাবতীর প্রণয়, বিবাহ এই নাটকের মূল ঘটনা হলেও কয়েকটি রংদার উৎকট শ্রেনির চরিত্র এই নাটকের একটি বড়াে সম্পদ। আর ‘কমলেকামিনী’ নাটকটিতে দীনবন্ধু ব্রহ্মরাজ ও মনিপুররাজের বিরােধ, সংঘাত ও মিলন-এর পটভূমিকায় হাস্যরসের মাধমে কাহিনির অবতাড়ণা করেছেন।
এক ‘নীলদর্পণ’ ছাড়া অন্য নাটকগুলির ক্ষেত্রে দীনবন্ধু ততটা সফল না হলেও প্রহসন রচনার ক্ষেত্রে দীনবন্ধু যথেষ্ট সফল। এ ব্যাপারে মধুসূদনকে আদর্শ করে তিনি বিয়ে পাগলা বুড়াে’, ‘জামাই বারিক ও ‘সধবার একাদশী’ নামে তিনটি প্রহসন রচনা করেছেন। এর মধ্যে বিয়ে পাগলা বুড়াে’ প্রহসনে এক বিবাহ বাতিক গ্রস্থ বৃদ্ধের নকল বিয়ের আয়ােজন করে স্কুলের অকাল পরিপক্ক ছেলেরা কিভাবে তাকে নাস্তানাবুদ করেছিল তার কৌতুককর কাহিনির বিবরণ দিয়েছেন। আর ‘জামাই বারিক’ প্রহসনে তৎকালীন যুগে ধনী পরিবারে ঘরজামাই পােষার প্রবণতাকে হাসি ঠাট্টার মাধ্যমে ব্যঙ্গ করেছেন। অনেকের মতে দীনবন্ধুর এই প্রহসনটির লক্ষ্য ছিল কলকাতার কোন এক প্রসিদ্ধ অভিজাত পরিবার।
তবে প্রহসনের ক্ষেত্রে দীনবন্ধু সবচেয়ে সফল তার ‘সধবার একাদশী’-তে। মধুসূদনের ‘একেই কি বলে। সভ্যতা’ প্রহসনের আদর্শে রচিত এই প্রহসনটিতে দীনবন্ধু সেযুগের কলকাতার উচ্চশিক্ষিত এবং অর্ধশিক্ষিত যুব সম্প্রদায়ের পাণাসক্তি, লাম্পট্য, পরস্ত্রীহরণ প্রভৃতি চরিত্রভ্রষ্টতার কাহিনি বর্ণনা করেছেন। এটি প্রহসন হলেও পুরােপুরি নাটকের রীতিতে রচিত। এরমূল চরিত্র নিমচাদ দত্তের সুখ দুঃখ, মাতলামির ঝােকে হাস্যকর উক্তি ও আচরণ এখানে অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে অঙ্কিত হয়েছে। এই নাটকের নিমৰ্চাদ সেযুগের প্রতীক চরিত্র। সেযুগের উচ্চশিক্ষিত ও আদর্শবাদী যুবকেরা কিভাবে সংযমের অভাবে মদের স্রোতে ভেসে যেত তা এই নিমৰ্চাদের মাধ্যমেই অঙ্কিত। | এভাবে দীনবন্ধু মিত্র বেশ কয়েকটি নাটক ও প্রহসন রচনা করে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে নিজের স্থান করে নিয়েছেন। নীলদর্পণ’ সহ তার বেশ কয়েকটি রচনায় এটি থেকে গেছে। একারনে দীনবন্ধু নানাভাবে সমালােচিত হয়েছেন। তার ‘নীলদর্পণ’ ও ‘সধবার একাদশী আলােচনা করতে গিয়ে অনেকেই বলেন দীনবন্ধু নাকি রুচির মুখ রক্ষা করতে পারেন নি। কিন্তু এ ব্যাপারে দীনবন্ধুর অকৃত্রিম ও অভিন্ন হৃদয় বন্ধু বঙ্কিমচন্দ্র বলেছিলেন
“তােরপের সৃষ্টিকালে তােরাপ যে ভাষায় রাগ প্রকাশ করে তাহা বাদ দিতে পারিতেন না, নিমৰ্চাদ | গড়িবার সময়ে নিমচাদ যে ভাষায় মাতলামি করে তাহা ছাড়িতে পারিতেন না, রুচির মুখ রক্ষা করিতে গেলে ছেড়া তােরাপ, কাটা আদুরি, ভাঙ্গা নিমচাদ আমরা পাইতাম।” দীনবন্ধ বেশিকাল জীবিত ছিলেন না। তাই ড. অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন
“মাত্র তেতাল্লিশ বছর বয়সে তার আকালে মৃত্যু হয়, তিনি আর একটু দীর্ঘজীবি হলে বাংলা | নাটকের যে কত উন্নতি হত তা আমরা কল্পনাও করিতে পরি না।”
Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।