ফরাজী আন্দোলন আলোচনা করো

ফরাজী আন্দোলন আলোচনা করো

উত্তর:

ভারতের গণসংগ্রামের ইতিহাসে ফরাজী বিদ্রোহ একটি উল্লেখযােগ্য অধ্যায় হিসাবে চিহ্নিত। ফরাজীরা ছিল হাজী শরিয়তুল্লা প্রতিষ্ঠিত একটি মুসলীম ধর্মীয় গােষ্ঠী। বর্তমান বাংলাদেশের ঢাকা, ফরিদপুর, ময়মনসিংহ ও বাখরগঞ্জ জেলাগুলিতে দরিদ্র মুসলমান কৃষকদের মধ্যে ফরাজী ধর্মীয় মতাদর্শ জনপ্রিয় হয়েছিল।

ফরাজীদের মতাদর্শ ও কর্মকান্ডের কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। জেমস্ ওয়াইস ফরাজীদের সম্পর্কে বলেছেন যে, কোরান অনুমােদন করেনি এরকম সমস্ত উৎসব ও ক্রিয়াকলাপ ফরাজীরা বর্জন করেছিল। শরিয়তুল্লা তাঁর অনুগামীদের বলেন যে, ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কারনে ভারতবর্ষ ‘দার-উল-হাবাব’ বা শক্রদেশে পরিণত হয়েছে, তাই এর প্রতিবাদে ফরাজীরা শুক্রবার নামাজ পড়বেন না এবং বছরে দুটি ঈদের অনুষ্ঠান পালন করবেন না। তিনি মুসলীমদের হিন্দুদের ধর্মীয় উৎসবে যােগ দিতে নিষেধ করেন। তবে এই ধর্মীয় বিধি নিষেধের পাশাপাশি কৃষকদের খাজনা না দেওয়ার নির্দেশও দেন শরিয়তুল্লা, এরজন্য একাধিকবার জেলেও যেতে হয়েছিল তাঁকে। ফরাজী মতাদর্শ ধর্মীয় গন্ডির সীমানা অতিক্রম করে একটি রাজনৈতিক রূপ পরিগ্রহ করেছিল।

Haji Shariatullah

এই মতাদর্শ স্থানীয় জমিদারদের আতঙ্কিত করে তুলেছিল, যা আবার মুসলীম কৃষকদের ঐক্যকে সুদৃঢ় করেছিল। এখানে উল্লেখ করা যায় যে, এই সকল অঞ্চলের কৃষকরা ছিলেন মুসলীম এবং তারা অত্যাচারিত হত মূলতঃ হিন্দু জমিদার ও মহাজনদের দ্বারা। তাছাড়া, যে নীল আবাদকারী সাহেবরা কৃষকদের জোর করে নীল চাষে বাধ্য করত, তাদের সমস্ত সহযােগী গােমস্তা ছিলেন মূলতঃ হিন্দু। তাই ফরাজী আন্দোলনের পরবর্তী নেতা, দুদুমিঞা, হিন্দু জমিদারদের অত্যাচার বিশেষ করে হিন্দু উৎসবের সময় মুসন্মান প্রজাদের কাছ থেকে জোর করে টাকা আদায়ের বিরােধিতা করেন এবং ইংরেজ সরকারের কাছে অভিযােগ জানিয়ে আবেদনও করেন। তাঁর মতে ‘শুদ্ধ মুসলমানরা অবৈধ জরিমানা দিতে অস্বীকার করলে তাদের উপর দ্বিগুণ অত্যাচার হতাে, এমনকি জমিদাররা রায়তদের মিথ্যা অভিযােগে ফৌজদারি মামলায় জড়িয়ে দিত।

ফলে এই আন্দোলন জমিদার-বিরােধী ও নীলকর-বিরােধী জঙ্গী চরিত্র ধারণ করেছিল। একেশ্বরবাদী ফরাজীরা তাদের বিশ্বাসের পরিপন্থী কোন প্রথা মেনে চলতে রাজী ছিলনা। তাই হিন্দু জমিদারদের চাপানাে আবওয়াব দিতে অস্বীকার করেছিল। ঐতিহাসিক বিনয়ভূষন চৌধুরীর মতে, “ফরাজীদের এ প্রতিবাদের তাৎপর্য শুধুমাত্র জমিদারদের আর্থিক ক্ষতি নয়; এটা আসলে জমিদারি এলাকায় তাদের দীর্ঘদিনের নিরঙ্কুশ আধিপত্যের উপর আঘাত”।

ফরাজীদের মূল উদ্দেশ্য ছিল জমিদারি শােষন-ব্যবস্থা ও নীলচাষ প্রথার সম্পূর্ণ অবসান ঘটান। ১৮৩৮ সালে দুদুমিঞা তার অনুগামী কৃষকদের জমিদারি খাজনা দিতে নিষেধ করেন। ফরাজী বিদ্রোহীরা ফরিদপুর অঞ্চলের নীলকুঠিগুলি আক্রমণ করন। এরা অধিকাংশ হাজি মুসলমান ও দরিদ্র রায়ত ছিল। যশাের ও বাখরগঞ্জের হাজিরাও সমাবেশে যােগ দিয়ে দুদুমিঞাকে তাদের নেতা নির্বাচন

করেন। দুদুমিঞার আন্দোলনের অভিনব বৈশিষ্ট্য ছিল—ফরাজীরা নিজস্ব আইন প্রনয়ণ করেছিলেন এবং তাদের নিজেদের আদালত ছিল। তারা সরকারী আদালতগুলি বর্জন করার নীতি গ্রহণ করেছিল। ফরাজী আদালতের বিচারকদের মুন্সী’ বলা হত। এক একজন মুন্সীর এক্তিয়ারে দু-তিনটি গ্রাম থাকত। মুন্সী দেওয়ানী ও ফৌজদারী মামলার নিষ্পত্তি করতেন। এই আদালতগুলি সেই সময় যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের কৃষকদের বিশ্বাস তৈরী হয়েছিল যে এই আদালতগুলি তাদের জমিদারি উৎপীড়নের হাত থেকে রক্ষা করবে। তবে দুদুমিঞা ও তার অনুগামীরা ফরাজী ধৰ্মীয় মতাদর্শের বিরােধীদের বিরুদ্ধে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপকে অনুমােদন করতেন। এই কারনে কোন হত্যাকে ‘পাপ’ বলে মনে করতেন না।

দুদুমিঞার নেতৃত্বে তৎকালীন পূর্ববঙ্গের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে ফরাজী রাজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তিনি পূর্ববঙ্গকে কয়েকটি বিভাগ বা সার্কেলে বিভক্ত করে প্রতিটি বিভাগে একজন করে ‘খলিফা নিযুক্ত করেন। এদের কাজ ছিল নিজ নিজ এলাকার খবরাখবর সংগ্রহ করা। অনুগামীদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করা হত যা ‘ফরাজী কর’ নামে পরিচিত ছিল। এই অর্থ সরকারী আদালতে দরিদ্র কৃষকদের মামলার কাজে এবং আন্দোলন পরিচালনার কাজে ব্যয় করা হত।

উনবিংশ শতকের বাংলায় দুদুমিঞা এক উল্লেখযােগ্য নাম। প্রায় পঁচিশ বছর ধরে তিনি এক বিতর্কিত চরিত্র হিসাবে নিজের উপস্থিতি প্রমাণ করেছিলেন। তাঁরই নির্দেশে ফরাজীরা একটি স্বাধীন রাষ্ট্রতন্ত্র গড়ে তােলার প্রয়াস চালিয়েছিল। যদিও শেষ পর্যন্ত কোম্পানী-সরকার, নীলকর সাহেব, জমিদার-মহাজনের সম্মিলিত শক্তিজোটের কাছে পরাস্ত হয়েছিলেন।

১৮৬২ সালে ঢাকায় দুদুমিঞা দেহত্যাগ করেন। তার মৃত্যুর পরও এই আন্দোলন চলেছিল। তবে আন্দোলনের নেতাদের অস্পষ্ট রাজনৈতিক চেতনা এবং সংগ্রামের লক্ষ্য সম্পর্কে অস্বচ্ছ ধারণা এই সংগ্রামকে উন্নত স্তরে নিয়ে যেতে ব্যর্থ হয়েছিল। তাছাড়া, দুদুমিঞার বিকল্প কোনাে যােগ্য নেতৃত্বের অভাবও স্পষ্ট ছিল। তবে নােয়ামিঞার নেতৃত্বে ফরাজীদের ১৮৮০-র দশক পর্যন্ত ফরিদপুর, বাখরগঞ্জ ও মালদায় জমিদার-বিরােধী কৃষক বিদ্রোহ অব্যাহত ছিল।

Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।

Leave a Comment

error: Content is protected !!